Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

মোনাজাতউদ্দিন— ছিন্ন পাতায় স্মৃতির আখ্যান

সাংবাদিক ও লেখক মোনাজাতউদ্দিন। জন্ম: ১৮ জানুয়ারি, ১৯৪৫— মৃত্যু: ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৯৫।

ডাঙার দেশ উত্তরের রংপুরে ১৮ জানুয়ারি, ১৯৪৫ তারিখে জন্ম তাঁর। এক দুর্নিবার সংবাদ-সাধকের পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে উত্তরেরই রাক্ষসী যমুনার দুর্বিনীত জলে ডুবে অকাল প্রয়াণের শিকার হয়ে তিনি নিজেই একদিন হয়ে যান সংবাদের শিরোনাম। তিঁনি সাংবাদিকতা জগতের এক অমর শিল্পী— মোনাজাতউদ্দিন।

ব্যতিক্রমী, সত্যনিষ্ঠ, সৃষ্টিশীল আধুনিক মফস্বল সাংবাদিকতার দিকপাল তিনি। চলমান মিডিয়া সভ্যতার চকচকে চাকার দৌরাত্ম্যে অবহেলিত মফস্বল সাংবাদিকতার গতানুগতিক কাঠামো ভেঙে একে জীবননিষ্ঠ, মূর্ত ও আকর্ষণীয় করে তুলতে তাঁর অবদান অতুলনীয়। ছোট ছোট গল্প কথায় প্রান্তিক অসহায় দুঃখী মানুষের বাস্তব জীবনচিত্র, কখনোবা ক্যামেরার ক্লিকে প্রকৃতির একটি অভিনব স্থিরচিত্রে তুলে ধরেছেন অনেক না বলা কথার জীবন্ত আখ্যান। সংবাদকে তিনি শিল্পের সুষমা দিয়েছেন, সংবাদের ক্ষুধা-ক্লিষ্ট মুখের মানুষকে দিয়েছেন গভীর ভালোবাসা। পেশাগত জীবনে সততা ও নৈতিকতায় অপরাজেয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন আপন বৈশিষ্ট্যের আলোকপ্রভায়। তাঁর গুণাবলীর আর একটি বিষয় আলোচনার বিন্দু হতে পারে, তা হলো সংবাদ সংগ্রহে তাঁর নিজস্ব কৌশলগত দক্ষতা। এছাড়া পেশার বাইরে ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন মানবিক, সহনশীল এবং বাস্তববোধ সম্পন্ন একজন আধুনিক মানুষ। মোনাজাতউদ্দিনের বর্ণিত এইসব সংক্ষিপ্ত গুণাবলী কোনও মুখস্থ শব্দাবলী নয়; বরং তা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নির্যাস। তাঁকে যতটুকু কাছ থেকে দেখার ও বোঝার সুযোগ হয়েছিল, সেই আমার খণ্ডিত স্মৃতির অমূল্য সম্পদ।

ব্যক্তিগত পরিচয়ের অমূল্য সেসব স্মৃতি লেখার আগে পাঠক-পাঠিকাদের জানাই, কীর্তিমান সাংবাদিক ও লেখক মোনাজাতউদ্দিন ১৯৪৫ সালে রংপুর শহরেরই  কেরাণীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আলিমউদ্দিন ও মাতা মতিজাননেছা। তিঁনি ‘রংপুর কৈলাশরঞ্জন স্কুল’ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ‘রংপুর কারমাইকেল কলেজ’ থেকে আইএ পাস করেন। পিতার মৃত্যুর পর নিজ চেষ্টায় বিএ পাস করলেও আর্থিক অনটনের জন্য তাঁকে কর্মসংস্থানে মনোযোগ দিতে হয়।

শিক্ষাজীবনেই তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হলেও ১৯৬২ সাল থেকে তিনি রংপুরের স্থানীয় বিভিন্ন কাগজে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন এবং ‘দৈনিক রংপুর’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা করেন। ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ ও ‘দৈনিক আজাদ’-এর উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি ছিলেন ১৯৭২-১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৭৬ সালে তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’-এর উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদ পরিবেশন করে সাংবাদিকতায় খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৯৫ সালের মধ্যপর্বে দৈনিক সংবাদের দীর্ঘদিনের চাকরি ছেড়ে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় যোগদান করেন।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি মননশীল লেখক হিসেবে স্বীকৃত মোনাজাতউদ্দিনের লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী’ (১৯৭৫), ‘পথ থেকে পথে’ (১৯৯১), ‘কানসোনার মুখ ও সংবাদ নেপথ্যে’ (১৯৯২), ‘পায়রাবন্দ শেকড় সংবাদ’ (১৯৯৩) প্রভৃতি প্রশংসিত।  

তরুণ বয়সে মোনাজাতউদ্দিন।

দুই.
মোনাজাত ভাইকে প্রথম কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল রংপুরে, ছাত্রাবস্থায়। সত্তরের দশকে একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় শখের সাংবাদিকতায় পেশাগত প্রশিক্ষণকালে। তিনিই ছিলেন আমাদের মুখ্য প্রশিক্ষক। একদম হাতে কলমে সাংবাদিকতার মূল বৈশিষ্ট্য ও কার্যকলাপের খুঁটিনাটি শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ব্যবহারিক ও ফিল্ড ভিজিটে তিনি একদিন আমাদের নিয়ে গেলেন শহরের প্রান্তে অবস্থিত এক নামিদামী খামারির দুগ্ধ খামারে, উদ্দেশ্য খামার ভিজিট করে পত্রিকার জন্য একটি রিপোর্ট তৈরি করা। সেই রিপোর্টে কি কি তথ্য ও উপাদান থাকা উচিৎ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা। আলোচনা ও সরজমিন ভিজিট শেষে আপ্যায়নের পালা। খামারি ভদ্রলোক পুরো টিমের জন্য মিষ্টি, সিঙ্গারা, কেক, একটি সাগর কলা এবং এক গ্লাস করে গাভীর টাটকা দুধের ব্যবস্থা করেছেন। আমরা হৃষ্ট চিত্তে সবই গলধঃকরণ করলাম। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম মোনাজাত ভাই কিন্তু কিছুই স্পর্শ করলেন না। আমরা তাঁকে অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি কিছুই নিলেন না। পরে বুঝেছিলাম তিনি আমাদের জন্য একটি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে, সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে কারও কাছ থেকে কোনোকিছু গ্রহণ করা সৎ সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য নয়।

তিন.
গত শতকের আশির দশকের শেষ প্রান্তে। আমি জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার পদে কর্মরত। নতুন জেলা হিসেবে অফিসের কার্যক্রম চলত পরিত্যাক্ত জয়পুরহাট সিমেন্ট কারখানার একটি ভবনে। একদিন দুপুর বেলা অফিস কক্ষে বসে ফাইলে মুখ গুঁজে এক মনে কাজ করছি। নিয়মিত কর্তব্য পালনের সাথে সাথে টেবিলের নথি জঞ্জাল পরিস্কার করার তাগিদও ছিল। ঘরের বাইরে বারান্দায় গ্রীষ্মের কড়া রোদ। চারিপাশে বৃক্ষহীন রুক্ষ হাওয়া। ঘরে বাইরের আলো-ছায়ার লুকোচুরির মাঝে হঠাৎ দরজার দোলায়মান হালকা পর্দা সরিয়ে উপরি চৌকাঠ অব্দি লম্বা মাথার কে একজন আমার নাম ধরে ডাক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। আমি মাথা তুলে বিস্ময়ে হতবাক— মোনাজাত ভাই। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অকপট উচ্চারণে বললেন, ‘‘একটু কাজে এদিকে এসেছিলাম, ভাবলাম আপনাকে দেখে যাই। বেশি দেরি করব না, একটু চা সিঙ্গারা খাওয়ান।’’ সাধারণ কুশল বিনিময়ের পর অধিক আপ্যায়নের সুযোগ না দিয়ে সেদিন তিনি বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিলেন।

কয়েকদিন বাদে বাসি ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় চোখ বুলাতে গিয়ে একটি শিরোনাম দেখে আমি বিস্মিত ও কিঞ্চিত শঙ্কিত হলাম। সংবাদটিতে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নেজারত শাখার ‘এলআর-ফান্ড’সহ অফিসের অন্যান্য কিছু অনিয়ম সংক্রান্ত খবর ছাপা হয়েছে, যা আমাদের সম্পূর্ণ অজানা। সেই স্পর্শকাতর গোপন তথ্যগুলো মোনাজাত ভাই এই স্বল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে ও কোন কৌশলে সংগ্রহ করলেন তা আজও আমার মনে বিস্ময় উদ্রেক করে। আর কিছুটা শঙ্কিত ছিলাম এই কারণে যে, তিনি ঐদিন কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমার অফিস কামরায় অতিথি হয়েছিলেন, যদি কেউ তা লক্ষ্য করে আমার অযাচিত উপকারের চেষ্টা করেন। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে, সে যাত্রায় এই প্রকাশিত সংবাদের কোনও প্রতিক্রিয়ার আঁচ আমার অবধি পৌঁছেনি।

চার.
একই কর্মস্থলে পরের বছর। জেলা প্রশাসক কার্যালয় নতুন কমপ্লেক্স ভবনে স্থানান্তরিত হলেও আবাসিকভাবে আমরা তখনও সিমেন্ট ফ্যাক্টরির পরিত্যক্ত বাসাগুলো ত্যাগ করিনি। সেদিন ছিল সরকারি ছুটির দিন। বাসায় অবস্থান করছিলাম। থাকি দোতলায়। হঠাৎ নিচ থেকে নারী কণ্ঠে আমার নামের পদবি উচ্চারণে ডাক শুনতে পেলাম— ‘বর্মণদা’। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি ‘এডিএম-ভাবী’ (অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ের স্ত্রী)। মনে হলো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন। দ্রুতগতিতে যে সংবাদ দিলেন তা হলো— ডিসি সাহেব ফোন করেছিলেন সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন আমার বাসায় আসছেন, আমি যেন বাসায় থাকি। সংবাদটি এতই জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ যে ডিসি সাহেব স্বয়ং ফোন করে বলেছেন এডিএম সাহেবের বাসায় এবং কোনও পিয়ন বা ড্রাইভার নয় ‘মিসেস এডিএম’ নিজেই ছুটে এসেছেন সরাসরি সংবাদটি পৌঁছে দিতে— যাতে কোনও বিলম্ব বা গাফিলতি না থাকে।

সেই সময় অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা এরকম পরিস্থিতি কল্পনাও করতে পারিনা। প্রশাসনের চেইন অব কমান্ডে একজন নবীন কর্মকর্তা হিসেবে অন্তত নিকট অতীতে ব্যক্তিগতভাবে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এমন পরিস্থিতির বাস্তব আর একটি কারণ ছিল যে, তখনও আমি আবাসিক টেলিফোন প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জন করিনি এবং মুঠোফোন প্রচলন তো ছিলই না। কিছুক্ষণের মধ্যে মোনাজাত ভাই রিক্সায় আরোহী হয়ে এসে পৌঁছলেন। পরিস্থিতির অকস্মিকতা অনুমান করে আমার সম্ভাব্য কৌতুহল নিরসনের জন্য তিনি জানালেন, সংবাদ সংগ্রহের জন্য তিনি সকালে এসেছেন। জেলা প্রশাসকের বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য গিয়েছিলেন। কথা হয়েছে। তিনি অবস্থানের জন্য সার্কিট হাউসের কথা বলেছিলেন, কিন্তু মোনাজাত ভাই আমার বাসায় থাকবেন বলে জানান এবং এখানে আসার জন্য গাড়ি দিতে চাইলেও তিনি তা সবিনয় প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আমি তখন সদ্য বিবাহিত। প্রথম সংসার পেতেছি। নববধূকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেই তিনি নিজেই পরিচিত হলেন এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে দুপুরের খাওয়ার মেনু বলে দিলেন— ডাল, আলুভর্তা আর ছোট মাছ। এমন খোলামেলা আচরণে সব সংকোচ কেটে গেল। আমার নাই নাই নতুন সংসারে তিনিই প্রথম অতিথি। তাই কিছুটা অস্বস্তিবোধ থাকাই স্বাভাবিক, বিশেষত আমার স্ত্রীর পক্ষ থেকে। কিন্তু তিনি সে সুযোগই দিলেন না। মনে হলো তিনি এই পরিবারই একজন সদস্য। দুপুরের পর বিদায় নিয়ে তিনি চলে গেলেন।

পরদিন অফিসে যাওয়ার পর পরই ডিসি সাহেবের খাস পিয়ন এসে খবর দিলেন ডিসি স্যার সালাম দিয়েছেন অর্থাৎ ডেকেছেন। তবে যাওয়ার আগে এডিসি জেনারেল (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, সার্বিক) সাহেবের সাথে দেখা করে যেতে বলেছেন। ডিসি সাহেব তো বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রায়ই সালাম পাঠান, তবে এডিসি সাহেবের সাথে দেখা করে যাওয়ার কথা বলায় বিষয়টা একটু জটিল বলেই মনে হলো। তবু কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। আমি আগে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মহোদয়ের চেম্বারে গেলাম। তিনি বিষয়টি খোলসা করতে গিয়ে গতকাল আমার বাসায় দৈনিক সংবাদের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি মোনাজাতউদ্দিন গিয়েছিলেন কিনা তা জিজ্ঞাসার পর নিশ্চিত হয়ে জানালেন যে, আজ সকালে ফুড সেক্রেটারি এবং ফুড মিনিষ্টার সাহেব ডিসি সাহেবকে ফোন করেছিলেন এবং কৈফিয়ত চেয়েছেন যে, জয়পুরহাট জেলায় আসন্ন আমন ফসলে পোকার আক্রমণ, সেচ সংকট ও অন্যান্য কারণে ধান উৎপাদন মরাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সামনে এই এলাকায় দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, সেদিনের দৈনিক সংবাদে এই খবর বেরিয়েছে। সেই সংবাদ পাঠ করেই তাঁরা ফোন করেছেন। এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়নি কেন এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সংবাদপত্রের প্রকাশনা ও বিলি বণ্টন ব্যবস্থাপনা এত উন্নত না হওয়ায় উত্তরাঞ্চলে যে কোনও সংবাদপত্র পৌঁছত বিকেলে কখনোবা সন্ধ্যায়।

আচমকা এমন পরিস্থিতিতে আমি কিছুটা বিব্রত হলেও এডিসি সাহেবকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে, তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালনের সাথে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি কখন কিভাবে কোথায় কী সংবাদ সংগ্রহ করেছেন এবং কখন পাঠিয়েছেন—এসব কিছু আমার জানার কথা নয়। তিনি আমার পূর্বপরিচিত, আমাকে স্নেহ করেন, কর্ম সম্পাদন অবকাশে তিনি কয়েক ঘণ্টার জন্য আমার বাসায় এসেছিলেন আমাকে দেখার জন্য। তাঁর সংবাদ প্রকাশের সাথে আমার কী সম্পর্ক, আমার কী দোষ?

এরপর আমাকে নিয়ে তিনি ডিসি সাহেবের চেম্বারে গেলেন। দেখলাম ডিসি সাহেব চেম্বারে বসে গম্ভীর মুখে ডাক ফাইল দেখছেন। এডিসি সাহেব তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে জানালেন যে তিনি আমাকে নিয়ে এসেছেন। ডিসি সাহেব কিছুক্ষণ নীরবে ডাক দেখা শেষ করে গভীরভাবে আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘‘তোমার মোনাজাতউদ্দিন কোত্থেকে কী তথ্য পেয়ে এমন একটি সংবাদ পাঠালেন, আমাকে খুব বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’’ আমি আমার দিক থেকে একই ব্যাখ্যা বা কৈফিয়ত যা এডিসি সাহেবের সামনে বিবৃত করেছিলাম, এখানেও তাই বললাম। তিনি ধৈর্য্য ধরে শুনলেন এবং বললেন, ‘‘ঠিক আছে। তুমি এখন আসতে পার।’’ শেষতক বিষয়টি তিনি নানানভাবে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং এরপরও অনেকদিন একই কর্মস্থলে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

মওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে মোনাজাতউদ্দিন রচনাসমগ্র (দুই খণ্ড)।

পাঁচ.
সাংবাদিক ও লেখক মোনাজাতউদ্দিনের অকাল প্রয়াণে দেশের সাংবাদিকতা জগত এক অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর পেশাগত দায়িত্বপালনকালে যমুনা নদী পার হওয়ার সময় এক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।

মোনাজাতউদ্দিনের অকাল প্রয়াণের তিন দশক পেরোলেও যে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতাউত্তর কাল থেকে দেশ পরিচালকদের ব্যর্থতায় আর্থ-সামাজিক সংকটকে কেন্দ্র করে দেশের সাধারণ মানুষ যে চরম দুর্ভিক্ষ-অনাহারে নিপতিত হয়, তার সবকিছুই তিনি তথ্যনিষ্ঠভাবে সংবাদপত্রের পাতায় তুলে ধরেছিলেন। একইসঙ্গে সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পাশাপাশি সংবাদপত্রের মফস্বল প্রতিনিধি হিসেবে গ্রামীণ জীবনের খবরাখবর নগরবাসী-পাঠকের কাছে ভিন্ন মাত্রায় পরিবেশন করে তিনি দেশের জনগণের কাছে সাংবাদিকতাকে যে গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল কাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন আজও দেশে তার বড় অভাব।

বাংলাদেশে মফস্বল-সাংবাদিকতা বা আঞ্চলিক-সাংবাদিকতাকে বিশেষ উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করে মোনাজাতউদ্দিন ‘চারণ সাংবাদিক’ হিসেবে অভিহত হন। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য মোনাজাতউদ্দিন ‘জহুর হোসেন স্বর্ণপদক’ (১৯৮৪), ‘ফিলিপস পুরস্কার’ (১৯৯৩) এবং ‘একুশে পদক’-এ (১৯৯৭, মরণোত্তর) ভূষিত হন।

আজ সাংবাদিক ও লেখক মোনাজাতউদ্দিনের ৮০তম জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: কবি ও গবেষক। সাবেক অতিরিক্ত সচিব।
ইমেইল: krbarman3535@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত