যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে সোমবার ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলে শপথ নিতে যাচ্ছেন ৭৯ বছর বয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই ক্যাপিটল হিল থেকেই ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি দাঙ্গা-হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে বিদায় নিতে হয়েছিল তাকে। ওই ঘটনার চার বছরের মাথায় নির্বাচনে জিতে ফের সেই ক্যাপিটল হিলেই আসছেন তিনি।
ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে বিশ্বের শীর্ষ তিন ধনী, বিদেশি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রযুক্তি জায়ান্ট, সাবেক প্রেসিডেন্টরাসহ সেলিব্রেটিরা নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। কথা ছিল অনুষ্ঠানটি হবে ক্যাপিটল হিলের বাইরে। কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডার পূর্বাভাসের কারণে ভেতরেই হবে এবারের অভিষেক অনুষ্ঠান।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ক্যাপিটল রোটুন্ডায় স্থানান্তরিত হওয়ায় আসন ব্যবস্থায় কী প্রভাব পড়বে, তা স্পষ্ট নয়। বাইরে আয়োজনের তুলনায় ক্যাপিটল রাউটুন্ডায় প্রায় ৬০০ জনের আসন রয়েছে।
চার বছর আগে ট্রাম্প তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি। বর্তমানে জীবিত সব সাবেক প্রেসিডেন্ট তার ক্ষমতায় ফেরার সাক্ষী হতে প্রস্তুত। তবে কিছু বিশিষ্ট ডেমোক্র্যাট এতে অংশগ্রহণ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
প্রতিবেদনে সেইসব ব্যক্তির তালিকা দেওয়া হলো, যারা অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন এবং যারা উপস্থিত থাকবেন না।
অংশ নেবেন যারা
কথা ছিল অভিষেক অনুষ্ঠানের বিশেষ সম্মানজনক আসনে বসবেন বিশ্বের তিন ধনী ব্যক্তি, ইলন মাস্ক, মার্ক জাকারবার্গ ও জেফ বেজোস। অন্তত ক্যাপিটল হিলের বাইরের অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় এমনই ছিল। এছাড়া অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক ও বিপদগ্রস্ত সোশাল মিডিয়া অ্যাপ টিকটকের প্রধান নির্বাহী শাও চিউকেও আসনে বসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে দাতাদের জন্য আসনব্যবস্থা শুরু থেকেই বেশ প্রতিযোগিতামূলক ছিল। কিছু দাতা ট্রাম্পের অভিষেক কমিটিতে ১ মিলিয়ন ডলার দান করেও অনুষ্ঠানে প্রবেশাধিকার পাননি।
সোমবারের অনুষ্ঠানের জন্য ট্রাম্পের অভিষেক কমিটি ১৭০ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে। এর অধিকাংশই এসেছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।
বিশ্বনেতারা
সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টর অভিষেক অনুষ্ঠানে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানরা উপস্থিত হন না। বিদেশি কূটনীতিকরা যেমন রাষ্ট্রদূতরা এতে অংশ নেন। তবে ট্রাম্পের সময় এই নিয়ম পাল্টে গেছে।
চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হান ঝেং, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পক্ষে অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। ট্রাম্প অবশ্য শি জিনপিংকে অভিষেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ছাড়াও বিশ্ব নেতাদের কয়েকজন উপস্থিত থাকবেন। এদের মধ্যে অনেকেই ট্রাম্পের আদর্শ ও নীতি পছন্দ করেন।
লাতিন আমেরিকা থেকে আর্জেন্টিনার দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই উপস্থিত থাকার পরিকল্পনা করেছেন বলে জানানো হয়েছে। ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও আরেক দক্ষিণপন্থী নেতা জইর বোলসোনারো উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলেন। তবে ব্রাজিলের ফেডারেল পুলিশ তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করায় তিনি যেতে পারছেন না।
ইউরোপ থেকে ইতালির দক্ষিণপন্থী প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি উপস্থিত থাকবেন। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের প্রেস সচিবের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ট্রাম্পের। তিনি হাঙ্গেরির এক মিডিয়াকে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ পেয়েছেন, তবে তিনি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন না।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের তিন ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশের প্রতিনিধিরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। এদের মধ্যে আছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং এবং জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকেশি ইওয়া।
বিশ্বের অন্যান্য আদর্শগত সঙ্গীরা যারা ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার পরিকল্পনা করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন: বেলজিয়ামের ভ্লামস বেলাং পার্টির চেয়ারম্যান টম ভ্যান গ্রিকেন, ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী রিকনকেট পার্টির এরিক জেমুর, জার্মানির আলটারনেটিভ ফর জার্মানি (এফডি) পার্টির টিনো ক্রুপালা, স্পেনের ভক্স পার্টির প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো আবাসকাল এবং যুক্তরাজ্যের রিফর্ম ইউকে পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজ।
সাবেক প্রেসিডেন্টদের মধ্যে বারাক ওবামা, জর্জ ডব্লিউ বুশ ও বিল ক্লিনটন ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। তবে এনবিসি নিউজ জানিয়েছে, তারা সোমবার প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিতের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী মধ্যাহ্ন ভোজে অংশগ্রহণ নেবেন না।
ট্রাম্পের আগের মেয়াদের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সও অনুষ্ঠানে থাকার কথা রয়েছে। প্রথা মেনে তাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পেন্স সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তি।
সেলিব্রেটিরা
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সেলিব্রেটি ক্যারি আন্ডারউড ‘আমেরিকা দ্য বিউটিফুল’ গানটি গাইবেন। ভিলেজ পিপল দলের শেষ জীবিত প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ভিক্টর উইলিস ও তার দলের সদস্যদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ট্রাম্প প্রায়ই তার রাজনৈতিক সমাবেশে এই গানের দলটির গান বাজান।
এনবিসি নিউজ জানিয়েছে, অভিষেক অনুষ্ঠানে কয়েকজন ক্রীড়াবিদ ও সঙ্গীতশিল্পী উপস্থিত থাকবেন। তাদের মধ্যে আছেন ফুটবল খেলোয়াড় অ্যান্টোনিও ব্রাউন, বক্সার মাইক টাইসন, মার্শাল আর্টস ফাইটার জর্জ মাসভিডাল ও হকি খেলোয়াড় এভান্দার কেইন। সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে থাকবেন অ্যানুয়েল এএ, জাস্টিন কুইলেস, রড ওয়েভ, কডাক ব্ল্যাক ও ফিভিও ফরেইন।
অংশ নেবেন না যারা
মিশেল ওবামা
অনুষ্ঠানে বারাক ওবামা গেলেও, যাবেন না সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা। তার অফিস থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে অনুপস্থিতির কারণ উল্লেখ করা হয়নি। তবে জানানো হয়েছে, তিনি তার স্বামীর সঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাননি। সেখানে অন্যান্য জীবিত সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং ফার্স্ট লেডিরা উপস্থিত ছিলেন।
ন্যান্সি পেলোসি
সাবেক হাউস স্পিকার ও ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তার প্রধান বিরোধী প্রতিনিধি ন্যান্সি পেলোসি অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন না। ৮৪ বছর বয়সী পেলোসি লুক্সেমবার্গে একটি সরকারি সফরের সময় পড়ে গিয়ে হিপ রিপ্লেসমেন্টের পর সুস্থ হচ্ছেন। তবে তিনি হাউসে ভোটে অংশগ্রহণ করছেন। তার মুখপাত্র উপস্থিত না হওয়ার কারণ জানাতে পারেননি। তবে এটা ঠিক যে, ট্রাম্প ও পেলোসির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা চলছে।
ট্রাম্পের প্রথম অভিষেক বয়কট করেছিলেন এমন সাত কংগ্রেসিয়াল ডেমোক্র্যাট এবার দ্বিতীয় অভিষেকে উপস্থিত থাকবেন। তবে কংগ্রেসের অন্য কিছু সদস্য ঘোষণা করেছেন বা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, তারা অভিষেক অনুষ্ঠানটি বয়কট করবেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন: ওয়াশিংটনের প্রতিনিধি অ্যাডাম স্মিথ, ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতিনিধি জুডি চু, ইলিনয়ের প্রতিনিধি ডেলিয়া রামিরেজ, ভার্জিনিয়ার প্রতিনিধি ডোনাল্ড এস. বেয়ার জুনিয়র, টেনেসির প্রতিনিধি স্টিভ কোহেন, টেক্সাসের প্রতিনিধি জ্যাসমিন ক্রকেট, মিনেসোটার প্রতিনিধি ইলহান ওমর ও টেক্সাসের প্রতিনিধি ভেরোনিকা এসকোবার।
অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা
প্রথা অনুসারে, অভিষেকের দিনটি শুরু হবে সেন্ট জনস এপিসকোপাল চার্চে একটি ধর্মীয় আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এরপর হোয়াইট হাউসে চা খাওয়ার পর ক্যাপিটলে হবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ শেষে ট্রাম্প তার অভিষেক ভাষণ দেবেন এবং শেষদিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বিদায় জানাবেন।
এরপর সেনেট চেম্বারের কাছাকাছি প্রেসিডেন্ট রুমে স্বাক্ষর দান আনুষ্ঠানিকতা সারবেন ট্রাম্প। স্বাক্ষর শেষে হবে মধ্যাহ্নভোজ। এরপর পেনসিলভেনিয়া অ্যাভিনিউ দিয়ে প্রেসিডেন্টের পতাকা বহনকারী প্যারেড ওয়াশিংটনের ক্যাপিটাল ওয়ান এলাকার দিকে যাবে। এসময় ট্রাম্প বক্তব্য দেবেন, সঙ্গে থাকবে ব্যান্ডের পারফরম্যান্স।
সোমবারের অনুষ্ঠানে এসবের বাইরেও ওভাল অফিসে একটি অনুষ্ঠান হবে। সেই অনুষ্ঠান শেষে প্রাচীন আমেরিকান ঐতিহ্য মেনে একটি বলরুমে প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্টলেডি উপস্থিত অতিথিদের সঙ্গে নাচ ও গান করবেন।