দুই বছর আগের কথা; ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে। বাংলাদেশে তখন ১০ শতাংশের নিচে। সেই শ্রীলঙ্কায় এখন মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক, আর বাংলাদেশে বাড়তে বাড়তে ১১-১২ শতাংশের ঘরে ঘোরাফেরা করছে।
গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতির হার মাইনাস ১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসে। বোঝাই যাচ্ছে, অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে দ্বীপ রাষ্ট্রটি।
এই দুই বছরে শ্রীলঙ্কার মুদ্রা রুপির দর বৃদ্ধির সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম কমানো হয়েছে, তার হাত ধরে মূল্যস্ফীতির এই অধঃগতি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসেও শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতির হার ঋণাত্মক থাকতে পারে। এরপর গাড়ি আমদানি শুরু হলে বিদেশি মুদ্রার চাহিদা বাড়তে পারে। তখন মূল্যস্ফীতির হার আবার শূন্যের ওপরে যাবে, যদিও তা ৪ শতাংশের ওপরে যাবে না।
শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, গত চার মাস ধরে দেশটিতে কোনও মূল্যস্ফীতি হচ্ছে না; বরং মূল্য সংকোচন হয়েছে। অর্থাৎ নেগেটিভ (-) মূল্যস্ফীতি হচ্ছে।
ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে গত আগস্টে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। সেপ্টেম্বরে তা মাইনাস শূন্য দশমিক ২ (-০.২) শতাংশে নামে। অক্টোবর ও নভেম্বরে এই হার ছিল মাইনাস শূন্য দশমিক ৭ (-০.৭) ও মাইনাস ১ দশমিক ৭ (-১.৭) শতাংশ।
সবশেষ ডিসেম্বরেও মাইনাস ১ দশমিক ৭ (-১.৭) শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে শ্রীলঙ্কায়।
অথচ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কমছে তো না-ই, কমার কোনও লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ ও গভর্নর আহসান এইচ মনসুর কমবে বলে বার বার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনও কাজ হচ্ছে না।
সরকারি হিসাবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ।
আগের মাস নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ; খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে নাজেহাল পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতিও নিম্নমুখী হয়েছে। অথচ ২০২৩ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ৫০ শতাংশে উঠেছিল।
পাকিস্তানে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের পর প্রথমবারের মতো এক অঙ্কে (১০ শতাংশের নিচে) নেমে আসে। ডিসেম্বরে সেই মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমেছে।
শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান নয়, বিশ্বের সব দেশের মূল্যস্ফীতির পারদই কমছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের ১৪ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, পাঁচ থেকে ছয় মাসে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে।
এরপর তিনি একাধিকবার একই কথা বলেছেন। পাঁচ মাস পার হয়ে গেলেও তার কোনও প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
উল্টো শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, শুল্ক ও কর বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে দেশের প্রায় সব অর্থনীতিবিদ মনে করছেন।
অবিবেচনাপ্রসূতভাবে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
শনিবার ‘শ্বেতপত্র ও অতঃপর : অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে প্রত্যক্ষ করে মনোযোগ দেওয়া দরকার হলেও অন্তর্বর্তী সরকার আগের মতোই পরোক্ষ করে নজর দিচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্রবিষয়ক কমিটির প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন দেবপ্রিয়।
এই আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গটি তুলে বলেন, “পণ্যমূল্যে আগুন বহির্বিশ্বে নিভে গেলেও বাংলাদেশে নেভেনি। না নেভার কারণও আছে। ফায়ার ব্রিগেড দেরিতে এসেছে। এসে আবার পানি ঢালার বদলে তেল ঢেলেছে। পরে দেখা গেল পাইপেও সমস্যা আছে।”
বৈশ্বিক আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্ব ব্যাংকও বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ ও শিল্প খাতে ভাটার টানে বাংলাদেশে অর্থনীতির গতি কমবে, বিপরীতে মূল্যস্ফীতি থাকবে চড়া।
শুক্রবার প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ (বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা) শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি চূড়ায় উঠেছিল ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে। এর পর থেকে তা ধাপে ধাপে কমছে।
ভারতে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে (শুধু গত অক্টোবর ছাড়া)। নেপাল ও শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামিয়ে আনতে পেরেছে। পাকিস্তানে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের পর প্রথমবারের মতো এক অঙ্কে নেমে আসে। বিপরীতে বাংলাদেশেই মূল্যস্ফীতি এখনও চড়া।
রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ভারতে খাদ্যের দাম কমায় ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৫ দশমিক ২২ শতাংশে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের জন্য এটা খুবই দুঃখজনক যে আমরা মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমাতে আমরা সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করতে পারছি না।
“প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তার সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। নতুন সরকারকেও খুব ভিন্ন কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না।”
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার পর জোর দেন সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, “গোষ্ঠীস্বার্থ উপেক্ষা করে বর্তমান সরকার তা করতে পারত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সমন্বয় নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমাতে। অন্যদিকে সরকার কর বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। এক মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির অনুমতি দিচ্ছে, আরেক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা তা আটকে দিচ্ছে।”
এই অবস্থায় আগামী দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমবে, সে আশা ছেড়ে দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, “কারণ, বাজারে চালের দাম বাড়ছে। সবজির দাম কমলেও তা স্থায়ী নাও হতে পারে।
“বাংলাদেশ নিম্নমুখী জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো দুটি ক্ষতিকর দিকের মধ্যে পড়ে গেছে। একদিকে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ কম, অন্যদিকে ব্যয় বাড়ছেই।”
এই সময়ে শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, শুল্ক ও কর বাড়ানো উচিৎ হয়নি মন্তব্য করে সেলিম রায়হান বলেন, তা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেওয়ার পথ করে দিয়েছে।
শ্রীলঙ্কার পর্যটনে মহামারির ধাক্কা লাগার পর দেশটির অর্থনীতি পড়েছিল দুর্দশায়; তাতে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল চরমে।
রিজার্ভ সংকট তখন জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় পেট্রোল পাম্পগুলোয় অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। জনঅসন্তোষ চরমে ওঠে রাজনীতিও হয়ে ওঠে সংকটাপন্ন। প্রেসিডেন্টকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিল।
সেই অবস্থা থেকে শ্রীলঙ্কা বেরিরে এসেছে বিস্ময়করভাবে। বামপন্থী প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা নেওয়ার পর শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতির হার শূন্যের নিচে নামিয়ে আনাসহ অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে দেশটি।
২০২২ সালে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। এরপর ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২৯০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশটি।
দুর্দশাগ্রস্ত শ্রীলংকার এ ঘুরে দাঁড়ানো রূপকথার গল্পের মতো শোনালেও অর্থনীতির প্রচলিত নীতির কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমেই তারা সংকট সামাল দিতে পেরেছে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
শ্রীলঙ্কার এই ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ৬৩ বছর বয়সী নন্দলাল বীরাসিংহে।
অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে তিনি কয়েক বছর আগেই শ্রীলঙ্কাকে সতর্ক করেছিলেন। তখন তিনি শ্রীলঙ্কার ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। কিন্তু তখন তার সতর্ক বার্তা দেশটির সরকার আমলে নেননি।
এমন অবস্থায় আগাম অবসর নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন নন্দলাল। তবে গত বছর তাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং বসানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পদে।
বলা যায়, নন্দলাল বীরাসিংহের নেতুত্বেই শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে কাটিয়ে উঠছে; ৭০ শতাংশে উঠে যাওয়া মূল্যস্ফীতি শূন্যের নিচে নেমেছে।