ঋণখেলাপি হওয়ায় ও ক্রয়াদেশ না থাকার কথা উল্লেখ করে গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বন্ধ করা বেক্সিমকোর সব কারখানা পুনরায় চালু করে দায়-দেনা ও বকেয়া বেতন পরিশোধে দ্রুত সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা।
একইসঙ্গে রপ্তানি শুরু ও ক্রয়াদেশ যাতে পাওয়া যায় সেজন্য ব্যাংকিং কার্যক্রম ও ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার অনুমতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি তুলে ধরেন বেক্সিমকো ফ্যাশন লিমিটেডের অ্যাডমিন বিভাগের প্রধান সৈয়দ মো. এনাম উল্লাহ ও বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের অ্যাডমিন বিভাগের প্রধান আব্দুল কাইয়ুম।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এলে ঢাকার নিউ মার্কেট থানার একটি মামলায় ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তার হন বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তারের পর থেকে তার ব্যবসা গুটিয়ে আসতে থাকে।
এরপর গত ১৫ ডিসেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বেক্সিমকোর ১৬টি কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেসব কারখানায় প্রায় ৪২ হাজার শ্রমিক কাজ করে। সেই বৈঠকে জানানো হয়, কারখানাগুলোতে নতুন ক্রয়াদেশ না থাকায় এবং প্রতিষ্ঠানটি ঋণখেলাপি হওয়ায় কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়।
আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান কয়েক মাস ধরে কারাগারে থাকায় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপের কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হতে শুরু করে। গত বছরের আগস্ট থেকেই এই প্রতিষ্ঠানগুলো বেতন দিতে সরকারের দ্বারস্থ হয়। তবে খেলাপি ঋণের দায়ে ব্যাংকিং সুবিধা সীমিত হয়ে আসায় সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশের অন্যতম এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি।
বৃহস্পতিবার ঢাকার পল্টনে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
সেখানে বেক্সিমকো ফ্যাশন লিমিটেডের অ্যাডমিন বিভাগের প্রধান সৈয়দ মো. এনাম উল্লাহ বলেন, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের গার্মেন্টস ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এগুলোতে কর্মরত প্রায় ৪২ হাজার চাকরীজীবিকে লে-অফের আওতায় জনতা ব্যাংকের ঋণ সুবিধায় জানুয়ারি- ২০২৫ পর্যন্ত বেতনাদি প্রদান করা হচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই বিশাল জনবলকে আর কোনও আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ১৬টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে এবং এগুলোতে কর্মরত প্রায় ৪২ হাজার কর্মজীবী মানুষ চাকরি হারাবে। সেইসঙ্গে এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িওয়ালা, দোকানদার, রিকশাচালক, স্কুল-মাদ্রাসা-কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাবে, যার সঙ্গে পরোক্ষ ও প্রত্যেক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা।
বেক্সিমকোর যে পরিমাণ ঋণ রয়েছে, তা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে আদায় করা সম্ভব না; তা আদায়ে প্রতিষ্ঠান চালু রাখার কথা বলেন বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের অ্যাডমিন বিভাগের প্রধান আব্দুল কাইয়ুম।
তিনি বলেন, “এ লক্ষ্যে আমরা বেশকিছু প্রস্তাবও দিয়েছি। এর মধ্যে একটি প্রস্তাব ছিল ২৩ একর জমি বন্ধক রেখে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া। এই ঋণ চাওয়া হয় ৪ মাসের জন্য। এই ঋণ দেওয়া হলে আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করে বকেয়া ঋণও পরিশোধ করতে পারব। সেক্ষেত্রে বছরে ৪০০ কোটি টাকার মতো বকেয়া ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব, এ ধরনের একটি প্লানও আমরা দিয়েছি।”
সংবাদ সম্মেললে বলা হয়, শুধু বেক্সিমকো গার্মেন্টস ডিভিশনই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিমাসে প্রায় ৩০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, এর মাধ্যমে দেশের রপ্তানি আয়ে অবদান রাখতো। সেই গার্মেন্টস ও সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোকে বন্ধ রাখায়, ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখায় সরকার ও জনগণ সেই বিশাল বিদেশি মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে এনাম উল্লাহ বলেন, “আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে তিল তিল করে গড়ে ওঠা বেক্সিমকোর গার্মেন্টস শিল্প মরিচা ধরার অপেক্ষায় আছে। আমাদের মাসিক প্রায় ৪০-৫০ লাখ পোশাক তৈরির সক্ষমতা, এশিয়ার বৃহত্তম ওয়াশিং প্লান্ট এবং অত্যাধুনিক মেশিনে সজ্জিত প্রিন্টিং, এমব্রয়ডারি ও এক্সেসসরিজ তৈরির কারখানা, টেক্সটাইল মিল ও দক্ষ জনবল বিদেশি ক্রেতাদের প্রধান আকর্ষণ।”
তিনি বলেন, “কম্পোজিট গ্রুপ হওয়ায় শুধু তুলা ও কেমিকেল কেনা ছাড়া গার্মেন্টস তৈরির অন্য কিছুই বাহির থেকে আমদানি করতে হয় না। এসব সুবিধা বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে বর্তমান থাকায় বায়াররা আমাদের কার্যাদেশ দিতে সব সময় তৎপর থাকে।”
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং ও এলসি সুবিধা ছাড়া দেশি-বিদেশি কোনও ব্যবসা বাণিজ্যই করা যায় না। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ৬ মাস ধরে বেক্সিমকোর গার্মেন্টস ডিভিশনের সব ব্যাংকিং ও এলসি সুবিধা বন্ধ রাখা হয়েছে। একদিকে কারখানা বন্ধ, উৎপাদন নেই অন্যদিকে দায়-দেনার পরিমাণ প্রচার করে, তা পরিশোধের জন্য সব চাপ অব্যাহত আছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের সব দায়-দেনা নিয়মিতভাবে পরিশোধের জন্য এর বন্ধ রাখা প্রতিটি কারখানা খুলে দিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরুর করার কোনও বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এনাম উল্লাহ বলেন, “প্রয়োজন আপনাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বন্ধ থাকা ব্যাক টু ব্যাক এলসি ওপেন করে দেওয়া। কিন্তু সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে দায় পরিশোধের চাপ সৃষ্টি শুধু অমানবিকই নয়, অন্যায্যও বটে। এই দায় বহন করার সক্ষমতা কোনও সরকারের বা ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কারখানা বন্ধ রাখার প্রক্রিয়া যতই প্রলম্বিত হবে বেক্সিমকোর দায়ও তাতে বাড়তে থাকবে। তাই অবিলম্বে বায়ারদের কার্যাদেশ পাওয়ার সুবিধার্থে বেক্সিমকোর ব্যাংকিং সুবিধার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা নিয়ে উৎপাদন শুরু করার মাধ্যমে সকল দায়-দেনা পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করছি।”
বকেয়া বেতন ও অন্যান্য পাওনাদি পরিশোধ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের কাছে শ্রমিকদের অর্জিত ছুটির ২ বছরের টাকা জমে গেছে এবং অফিসারদের ৪ মাসের বেতনের টাকা বকেয়া রয়ে গেছে। বর্তমান আর্থিক দুরাবস্থার ভেতর এই বকেযাগুলো পাওয়া গেলেও সন্তানদের স্কুল-কলেজে ভর্তির খরচটা মিটিয়ে ফেলা যেত। টাকার অভাবে সন্তানদের নতুন বছরে, নতুন ক্লাসে ভর্তি করানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে এনাম উল্লহ বলেন, “আমরা মালিক বলতে এখন আমাদের এমডি ওসমান কায়সার চৌধুরীকে বুঝি। এমডি আছেন, রিসিভার আছেন। তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। এমডি মহদয় বেক্সিমকোর চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সকল ধরনের প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে।”