ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্ট উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই স্বরাষ্ট্র ও তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা। বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য মামুন আহমেদের পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবি জানিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব) এবং তথ্য উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী।
সাত কলেজের পক্ষে তিনজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন; এরা হলেন ঢাকা কলেজেরে মঈনুল ইসলাম ও রহমতুল্লাহ এবং ইডেন মহিলা কলেজের মৌ।
দুই উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ‘আশ্বস্ত’ শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা।
মইনুল ইসলাম বলেন, “পরশু রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ এবং সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এ নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে আমরা ছয় দফা দাবি উত্থাপন করি। আমাদের প্রথম দাবি গতকাল মেনে নেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছি। বাকি পাঁচ দাবি মেনে নেওয়ার জন্য আমরা ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম।
“এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে ডাকা হয়েছে। এখানে আমরা পাঁচ দফা দাবি উপস্থাপন করেছি। আমাদের দাবিগুলো ইতিবাচকভাবে নেওয়া হয়েছে। সেটা বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মেনে নেওয়া হবে বলে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।”
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সোমবার ঢাকার সাতটি কলেজকে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে না রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ভর্তি করা হবে না।
সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের সভায় কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ‘সম্মানজনক পৃথকীকরণের’বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া সাত কলেজ হলো – ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ।
মঙ্গলবার দুই উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবিগুলোও তুলে ধরেন মঈনুল ইসলাম।
শিক্ষার্থীদের প্রথম দাবি ছিল- ঢাকা কলেজসহ সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংঘাতের দায় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি মামুন আহমেদের পদত্যাগ। তিনি যেন ঢাকা কলেজসহ সাত কলেজের সংশ্লিষ্ট কোনও কমিটিতে না থাকেন, সে বিষয়েও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় দাবি ছিল- ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রাকিবকে হত্যার উদ্দেশে হামলাসহ ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে তদন্ত সাপেক্ষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া। তৃতীয় দাবি ছিল, যেসব ঢাবি শিক্ষার্থী ইডেন কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজসহ সাত কলেজের নারী শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য এবং অশালীন অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সাত কলেজের একাডেমিক এবং প্রশাসনিক সম্পর্কের চূড়ান্ত অবসান ঘটিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাতিল করে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা প্রণয়ন, উদ্ভুত পরিস্থিতি সমাধানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষার্থী উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, ইউজিসি সদস্য এবং ঢাবি ভিসির সমন্বয়ে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি টিমের সঙ্গে তাৎক্ষণিক উচ্চ পর্যায়ের মিটিংয়ের মাধ্যমে এই ঘটনার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট এলাকায় সিটি করপোরেশনের রাস্তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া।
দাবি অনুযায়ী নাহিদ ইসলাম আজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসেছিলেন জানিয়ে মঈনুল বলেন, “আজ আমাদের জানানো হয়েছে যে এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।”
ঘটনার সূত্রপাত
পাঁচ দফা দাবি আদায়ে গত রবিবার সন্ধ্যার পর শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব ও টেকিনিক্যাল মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এরপর দাবি জানাতে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু উপ-উপাচার্য তাদের অপমান করেন অভিযোগ তুলে তারা নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে। তাদের দাবি, অধ্যাপক মামুনকে ক্ষমা চাইতে হবে।
এরপর রাত সোয়া ১১টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের বাধা দেয়। তখন সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ-বিজিবি সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ও রবার বুলেট ছোড়ে। শিক্ষার্থীদের থামাতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
রাতের ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে হামলায় জড়িত সবার বিচারের দাবিতে সোমবার সকাল ৯টা থেকে নিজ নিজ কলেজের সামনের সড়ক অবরোধ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সোমবার ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের সব চূড়ান্ত পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়।
এরপরই অধ্যক্ষদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের বৈঠকে আলাদা হয়ে যায় সাত কলেজ।