একই ছবি ফেইসবুকে পোস্ট করে অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, “চিকিৎসক হিসেবে রোগীর হাসিমুখ দেখার চেয়ে বড় প্রাপ্তি কিছু নেই, দীর্ঘ তিন মাস ১০ দিন ঢাকা মেডিকেলের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা শেষে ওর এখন বাড়ি যাওয়ার সময়।” আর সাংবাদিক ইশতিয়াক ইমন রিখেছেন, “১০০ দিনের চিকিৎসা শেষে কল্পনা এখন বাড়ির পথে। নতুন একটা সুন্দর জীবন হোক কল্পনার।”
ছবিতে চিকিৎসক ও সাংবাদিককে দুই পাশে নিয়ে দঁড়িয়ে এক কিশোরী। মুখে তার হাসি। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, হাতে ঘড়ি। অথচ ঠিক তিন মাস ১০ দিন আগে এই কিশোরীর ছবি দেখা গিয়েছিলে সামনের সারির উপরের পাটির দাঁত নেই, মুখে অজস্র ক্ষত চিহ্ন।
মেয়েটির নাম কল্পনা, গৃহকর্মী হয়ে এসেছিল ঢাকায় । গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনের শিকার হয়ে ১০০ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন বাড়ি ফিরছে হাসিমুখে।
তার চিকিৎসার পুরো কার্যক্রমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. নাসির এবং সাংবাদিক ইমন। কল্পনাকে মাঝখানে রেখে দুজনই তাই আবেগাপ্লুত।
১৫ বছরের কল্পনা গৃহকর্মীর কাজ করত বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। সেখানে সে ছিল দিনাত জাহান আদরের বাসায়। সেখানে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় কল্পনা। এমনকি আদরের ভাই তাকে ধর্ষণ করতে চাইত বলেও অভিযোগ করে সে। ডাক্তারি পরীক্ষায়ও তার আলামতও পাওয়া গেছে।
কেমন নির্যাতন চলত- তার বর্ণনা দিতে গিয়ে কল্পনা বলেছিল, কাজ না পারা বা ভুল করার অজুহাতে চ্যাঁকা দেওয়া হতো হেয়ার স্ট্রেইনার মেশিন দিয়ে, পেটানো হতো লাঠি দিয়ে।
কল্পনার বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায়, শহিদ মিয়া ও আফিয়া বেগমের মেয়ে। পাঁচ বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সে পঞ্চম।
আফিয়া সকাল সন্ধ্যাকে জানান, গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে মাসে ৫ হাজার টাকা বেতনে ওই বাসায় কাজ করছিল তার মেয়ে। পরে ১০ হাজার বেতন দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব টাকা তারা পেতেন না। এমনকি মেয়ের সঙ্গে কথাও বলতে দেওয়া হতো না।
“ফোন করলেই ম্যাডাম (দিনাত) বলত, মাইয়াডা ভালা আছে, কাজ করতেছে, বাইরে গেছে, দোকানে পাডাইছি।”
কখনোই কি কথা হয়নি প্রশ্নে তিনি বলেন, “খুব কম। তবে যখন কথা হতো, তখন সে (গৃহকর্ত্রী) সামনে থাকতো। যার কারণে নির্যাতনের কথা বলতে পারতো না।”
তবে ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর মেয়েকে মারধরের অভিযোগে আফিয়া বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ভাটারা থানায় দিনাত জাহানের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গত বছরের অক্টোবরে দিনাত এবং তার ভাই দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দুজনই এখন কারাগারে।
গত অক্টোবর মাসে কল্পনার চিকিৎসা শুরুর পর পুরো যাত্রা নিয়ে সকাল সন্ধ্যার কথা হয় ডা. নাসিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, “সেদিনের কল্পনা আর আজকের কল্পনা-এটা ভাবতেও পারছি না। চিকিৎসক হিসেবে অসংখ্য রোগী দেখি, চিকিৎসা করাই, কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন, কেউ না। কিন্তু এই কিশোরী মেয়েটির মতো মানসিক শক্তি খুব কম দেখেছি।”
কল্পনার চিকিৎসার দীর্ঘ যাত্রা মঙ্গলবারই শেষ হলো। এখন তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিলেই বাড়ি ফিরবে সে।
কল্পনার ওপর নির্যাতনের খবর জানার পর বিক্ষোভও হয়েছিল ঢাকায়। তাকে দেখতে গিয়েছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কর্মকর্তারাও।
কল্পনাকে কী অবস্থায় পেয়েছিলেন, জানতে চাইলে এই চিকিৎসক বলেন, “সত্যিকার অর্থে সেটা ছিল ভয়ংকর, ভয়ংকর।
“মেয়েটা ছিল রক্তশূন্য, দাঁত ছিল না। শরীরের এমন কোনও জায়গা ছিল না যেখানে ক্ষত নেই। চোখে-মুখে ছিল ভীতি।”
প্লাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক জানান, কল্পনার শরীরের বিভিন্ন জখমে পুঁজ হয়ে গিয়েছিল।
“প্রথম অপারেশনে কেবল আধা কেজির মতো পুঁজই বের করেছি আমরা। ওর শরীর কোনও ধরনের সার্জারির জন্য ফিট ছিল না। পুঁজ বের করার পর খাওয়া-দাওয়া করানো হয় ঠিক করে।”
তিনি বলেন, “সবচেয়ে বেশি ছিল মানসিক ভীতি, মানসিকভাবে সে ছিল বিধ্বস্ত। সেজন্য কাউন্সেলিং করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। শরীর এবং মন ঠিক হওয়ার পর তার অস্ত্রোপচারের দিকে আগাই আমরা। একেকদিনে ওর শরীরের একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে।
“সে তো দীর্ঘদিন আনঅ্যাটেন্ডেড ছিল, চিকিৎসা হয়নি, ক্ষতস্থানগুলোতে যার কারণে ময়লা জমে ছিল। ময়লা জমে জমে কিছু কিছু অংশ পচেও গিয়েচিল।”
কল্পনার চিকিৎসা কি পুরোপুরি শেষ হলো- ডা. নাসির জানালেন, ঠোঁটের কিছু অংশের অস্ত্রোপচার দরকার হবে।
“যদিও সেটা এখন খুব একটা বোঝা যায় না, কিন্তু আমারা চাচ্ছি ওর চিকিৎসা যেন পুরোটা হয়। ওর মনের ভেতরে যেন কোনও সংশয় বা আক্ষেপ না থাকে। সেজন্য তাকে ছয় মাস পর আবার আসতে বলা হয়েছে।”
কল্পনার সঙ্গে এই হাসপাতালে তার বাবা-মা ছিলেন পুরোটা সময়। হাসপাতাল থেকে তার জন্য ডাবল কেবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যেন তার বাবা মার থাকতে সমস্যা না হয়। পুরো চিকিৎসা সরকারিভাবে হয়েছে।
অধ্যাপক নাসির এজন্য সমাজসেবা মন্ত্রণালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, চিকিৎসক, নার্সসহ সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
সেইসঙ্গে বলেন, “তবে কাজের কাজটি করেছেন সাংবাদিক ইশতিয়াক। তিনি এই তিন মাস কল্পনার জন্য সময় দিয়েছেন, আমাদের সঙ্গে ছিলেন।”
দীর্ঘদিনের রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখা যায়। নির্যাতনের কথা কিছু বলেছে কি না কল্পনা- জানতে চাইলে ডা. নাসির বলেন, তাকে আটকে রাখা হয়, কাঠি, লাঠি, খুন্তি এমন কিছু নেই, যা দিয়ে তাকে পেটানো হয়নি।
“ধর্ষণ চেষ্টাও করা হয়েছে। কিন্তু কল্পনা যখন রেসিস্ট করা শুরু করে, তখন থেকেই নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় বলে সে আমাদের জানিয়েছে,” বলেন তিনি।
সাংবাদিক ইশতিয়াক ইমন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তার এক সোর্সের মাধ্যমে তিনি কল্পনার ঘটনাটি জানতে পারেন। তখন পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে ওই বাসায় যান তিনি।
“এক মিনিটের একটি ভিডিও আসে আমার হাতে। সেখানে মেয়েটি তার নির্যাতনের কথা জানিয়ে বাঁচার কথা বলে।”
এরপরই পুলিশ গিয়ে কল্পনাকে উদ্ধার করে ভাটারা থানায় নিয়ে আসে। সেই সঙ্গে দিনাতকেও গ্রেপ্তার করে আনা হয়।
দিনাত কেন কল্পনাকে নির্যাতন করতেন- জানতে চাইলে সাংবাতিক ইশতিয়াক ইমন বলেন, তিনি এ নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নানা ধরনের অতৃপ্তি, মানসিক ক্ষত, নিজের অপরাগতাসহ নানান বিষয়ের কারণে তিনি একাজ করতেন বলে চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন।