গাজার আল রশিদ সড়ক ধরে উত্তরের দিকে চলছে কয়েক হাজার মানুষের মিছিল। এরা ১৬ মাস পর তাদের প্রিয় বাসভূমির দিকে যাচ্ছেন। ঘটনার প্রেক্ষাপট এক হলেও তাদের প্রত্যেকের গল্প আলাদা।
ভিড়ের মধ্যে এক বৃদ্ধ দৃঢ় পায়ে পরিবারসহ এগিয়ে যাচ্ছেন। তার এক হাতে কম্বল ও সামান্য কিছু জিনিসপত্র। অন্য হাতে ধরে আছেন তার ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে।
ক্লান্তি লুকানোর কোনও চেষ্টা নেই রিফাত জুদার। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের আল মাওয়াসি থেকে খুব সকালে হাঁটা শুরু করেছেন তিনি। গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে গত ১৫ মাস ধরে মাওয়াসিতে ছিলেন তিনি ও তার পরিবার। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতির পর এখন রিফাতের লক্ষ্য একটাই, গাজা সিটিতে পৌঁছনো।
১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর ইসরায়েল দক্ষিণ গাজার ফিলিস্তিনিদের উত্তরের দিকে যাওয়ার অনুমতি দেয়। তার পরই শুরু হয়েছে উত্তরে যাওয়া মানুষের ঢল। দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাওয়ার রাস্তার দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। কিন্তু এই পথটুকু যেতেই প্রতি ঘণ্টায় একবার করে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে রিফাতের পরিবারকে।
গাজা সিটিতে পৌঁছানোর পর রিফাত আল জাজিরাকে বলেন, “যাত্রাটি ছিল বেশ ক্লান্তিকর ও কঠিন। তারপরও আমরা ফিরে আসার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম।”
বাড়ি ফেরার পর এখন কী করবেন, তা জানেন না রিফাত। গাজার উত্তরে তার সেই বাড়ি আর নেই। ইসরায়েলি হামলায় ওই বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
রিফাতের ভাষ্যে, “পরিস্থিতি বেশ খারাপ। পানি নেই, সেবা নেই। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে এতে কী আসে যায়? আমরা এক কঠিন পরিস্থিতি থেকে আরও কঠিন পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি। আমরা আবার বাড়ি বানাব। তবে ফিরে আসতে পেরে আমাদের মনোবল বেড়েছে, জেগেছে আশা।”
বাস্তুচ্যুতি
২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর আগে গাজার অধিকাংশ মানুষ উত্তরাংশে শহরকেন্দ্রিক এলাকায় বাস করত। সেখানেই ইসরায়েল বেশি হামলা চালায়।
যুদ্ধেরর প্রথম দিকে উত্তর গাজার মানুষকে তাই ‘নিরাপদ অঞ্চল’ হিসেবে মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় সরে যেতে হয়। এতে গাজার আনুমানিক ২৩ লাখ মানুষের বেশিরভাগই মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় বাস্তুচ্যুত হয়। সেখানে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘নিতজারিম’ নামে একটি করিডোর তৈরি করে।
আড়াই বছরের যুদ্ধে গাজা সিটির প্রায় ৭৪ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে যেসব এলাকা নিরাপদ হিসাবে ধরা হয়েছিল, সেগুলোও রক্ষা পায়নি। মানুষ যেসব এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল, সেগুলোও বিধ্বস্ত হয়েছে।
মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহর ৫০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। আর দক্ষিণ গাজায়, খান ইউনিসের ৫৫ শতাংশ এবং রাফাহের ৪৮ শতাংশ ভবন এখন ধ্বংসস্তূপ।
ইসরায়েলি আক্রমণে কমপক্ষে ৪৭ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পালাতে বাধ্য হয়েছে। যদিও স্বাধীন পর্যবেক্ষক ও কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা মনে করে, ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।
বাস্তুচ্যুত রিফাত বলেন, “উদ্বাস্তু হওয়ার দিনগুলো ছিল সবচেয়ে কঠিন ও ক্লান্তিকর। কখনও কল্পনা করিনি, জীবনের একটা সময় বাস্তচ্যুত হয়ে বাড়ির বাইরে কাটাতে হবে। মানুষের ফিরে আসার তাড়না দেখলেই বোঝা যায়, জোর করে বাস্তুচ্যুতি পরিকল্পনা কখনও সফল হয় না।”
রিফাত ভাবছেন, উত্তর গাজার ইসরায়েল সংলগ্ন শহর আশদোদে যাবেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময় তার পরিবারকে জোরপূর্বক আশদোদ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন ওই দুর্দশাপূর্ণ সময় ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা‘ নামে অভিহিত করেছিল।
৩৯ বছর বয়সী সামি আল-দাবাঘ উত্তর গাজার শেখ রাদওয়ানে ফিরে যাচ্ছেন। বাস্তুচ্যুত হয়ে তাকে একাধিক জায়গায় থাকতে হয়েছে। শেষে মধ্য গাজায় আশ্রয় নেন। চার সন্তানের জনক এই পিলস্তিনি দীর্ঘ সময় হাঁটার পর আল জাজিরাকে বলেন, তিনি আর কখনও একই ভুল করবেন না। যাই হোক না কেন, তিনি আর বাস্তুচ্যুত হতে চান না।
ঠিক একই অনুভূতি আরেক ফিলিস্তিনি রাদওয়ান আল আজৌলের। আট সন্তানের বাবা রাদওয়ান বাস্তুচ্যুত অবস্থায় দেইর আল বালাহে বাস করতেন। তার মূল নিবাস শেখ রাদওয়ান।
আপনজনদের ছাড়াই ফেরা
অনেক ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হওয়ার আগে পরিবার নিয়ে থাকলেও এখন ফেরার সময় পরিবারের সদস্যদের ছাড়াই ফিরতে হচ্ছে। হয়ত তারা নিহত হয়েছে ইসরায়েলি বোমায়, নয়ত হারিয়ে গেছে। আবার অনেকের সঙ্গে কোনও জিনিসপত্র নেই, যা দিয়ে আবার সংসার শুরু করতে পারেন।
এমনই একজন ৫২ বছর বয়সী খালেদ ইব্রাহিম। উত্তর গাজায় তার বাড়ি আর নেই। তাঁবু খাটিয়ে থাকার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। বাড়ি ছাড়াও তিনি হারিয়েছেন স্ত্রী, নাতনি ও দুই ভাই। গত জুনে খান ইউনিসে তাদের তাঁবুর কাছে বোমা হামলায় তারা নিহত হন।