যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার শেয়ারমূল্য গত সোমবার এক ধাক্কায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার কমেছে। দেশটির ইতিহাসে একদিনে কোনও কোম্পনির সবচেয়ে বড় দরপতনের ঘটনা এটি।
সোমবার এনভিডিয়ার শেয়ার প্রতি দাম ১৭ শতাংশ কমে ১১৮ দশমিক ৫৮ ডলারে আটকে যায়। প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে সোমবার ছিল সবচেয়ে খারাপ দিন। ২০২০ সালের ১৬ মার্চ কোভিড মহামারির শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারমূল্য বড় ধাক্কা খেয়েছিল। কিন্তু এতো বড় না।
অথচ গত সপ্তাহেই অ্যাপলকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে দামি পাবলিক কোম্পানি হয়েছিল এনভিডিয়া। সোমবার শেয়ারের দাম কমায় প্রযুক্তিভিত্তিক নাসদাক সূচক ৩ দশমিক ১ শতাংশ নিচে নামে।
অবশ্য গতকাল মঙ্গলবার প্রযুক্তি খাতের শেয়ার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। এনভিডিয়ার শেয়ার ৮ দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আগের দিনের রেকর্ড পতনের পর কিছু বিনিয়োগকারী কম দামে শেয়ার কেনার সুযোগ নেন। মঙ্গলবার এনভিডিয়ার শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ১২৮ দশমিক ৯৯ ডলারে। ওরাকলের শেয়ারের দাম বাড়ে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, মার্ভেল টেকনোলজির দাম বাড়ে সাড়ে তিন শতাংশ।
চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কোম্পানি ডিপসিকের উত্থানে এনভিডিয়ার শেয়ার বিক্রি বেড়ে যায়। শুধু এনভিডিয়া নয়, এই ঘটনা বৈশ্বিক এআই প্রতিযোগিতায় বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে।
ডিসেম্বরের শেষ দিকে ডিপসিক একটি ফ্রি ওপেনসোর্স ‘বিশদ ভাষার মডেল’ উন্মোচন করেছিল। তখন প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছিল, এটি তৈরি করতে মাত্র দুই মাস ও ৬ মিলিয়ন ডলারের কম খরচ হয়েছে। আর এটি তৈরি হয়েছে এনভিডিয়ার এইচ৮০০এস চিপ ব্যবহার করে।
এনভিডিয়ার গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ) প্রযুক্তি বাজারে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। বিশেষ করে এআই ডেটা সেন্টার চিপের ক্ষেত্রে। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন অ্যালফাবেট, মেটা ও অ্যামাজন তাদের এআই মডেল প্রশিক্ষণ ও পরিচালনার জন্য এই প্রসেসরগুলোতে বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে।
বিনিয়োগ সংস্থা ক্যানটরের বিশ্লেষকরা গত সোমবার এক রিপোর্টে জানান, ডিপসিকের সর্বশেষ প্রযুক্তির উন্মোচন কম্পিউটিং শক্তির চাহিদার ওপর প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে জিপিইউতে ব্যয় নিয়ে উদ্বেগও দেখা দিয়েছে।
তবে আরেকদল বিশ্লেষক বলেছেন, এআই প্রযুক্তির উন্নতি কম নয়, বরং বেশি কম্পিউটিং শক্তির চাহিদা সৃষ্টি করবে। তারা এখন এনভিডিয়ার শেয়ার কেনার পরামর্শ দিয়েছেন।
এনভিডিয়ার শেয়ার গত দুই বছরে ব্যাপক বেড়েছে। ২০২৩ সালে এর শেয়ারদর ২৩৯ শতাংশ ও ২০২৪ সালে ১৭১ শতাংশ বেড়েছে।
শেয়ারবাজারে এখন চিপকেন্দ্রিক বিনিয়োগ নিয়ে এক ধরনের সতর্কতা কাজ করছে। এআই থেকে উচ্চ মূল্যায়ন পাওয়া আরেক মার্কিন চিপ নির্মাতা বোর্ডকমের শেয়ারও সোমবার ১৭ শতাংশ কমেছে। এর ফলে কোম্পানির বাজার মূল্য ২০০ বিলিয়ন ডলার কমে যায়।
এনভিডিয়ার জিপিইউর ওপর নির্ভরশীল ডেটা সেন্টার কোম্পানিগুলোও বড় ধরনের শেয়ার বিক্রির মুখে পড়েছে। ডেল, হেউলেট, প্যাকার্ড এন্টারপ্রাইজ ও সুপার মাইক্রো কম্পিউটারের শেয়ার কমপক্ষে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক এআই উদ্যোগের অংশ ওরাকলের শেয়ার ১৪ শতাংশ কমেছে।
এনভিডিয়ার জন্য এই ক্ষতি গত সেপ্টেম্বরের ২৭৯ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। তখন একদিনে এর বাজার মূল্যের সবচেয়ে বড় পতন ছিল, যা মেটার ২০২২ সালের ২৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির রেকর্ড ভেঙেছিল। এর আগে ২০২০ সালে অ্যাপলের ১৮২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি ছিল সবচেয়ে বড় পতন।
এনভিডিয়ার বাজার মূল্য হ্রাস কোকাকোলা ও শেভরনের সম্মিলিত বাজার মূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি। এটি ওরাকল ও নেটফ্লিক্সের মোট বাজার মূল্যকেও ছাড়িয়ে গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির সিইও জেনসেন হুয়াংয়ের সম্পদের পরিমাণেও বড় ধাক্কা লেগেছে। ফোর্বসের রিয়েল-টাইম বিলিয়নিয়ার তালিকা অনুযায়ী, হুয়াংয়ের মোট সম্পদ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলার কমেছে। আর এতে তিনি ধনীদের তালিকায় ১৭তম স্থানে নেমে গেছেন।
সপ্তাহের শেষে ডিপসিক নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ বাড়ায় এটি অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া ফ্রি অ্যাপে পরিণত হয়। ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটিকে পেছনে ফেলে দেয়।
ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ডেভিড স্যাকসকে হোয়াইট হাউসের এআই ও ক্রিপ্টোনীতি প্রধান হিসেবে মনোনীত করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তিনি সোশাল মিডিয়া এক্সে লিখেছেন, ডিপসিকের মডেল প্রমাণ করে এআই প্রতিযোগিতা খুব কঠিন হবে। এআই নিরাপত্তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নির্বাহী আদেশ বাতিল করতে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
স্যাকস বলেন, “আমি যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতায় আত্মবিশ্বাসী, তবে আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না।”
এখন এনভিডিয়া বাজার মূল্যের দিক থেকে তৃতীয় বৃহত্তম পাবলিক কোম্পানি, অ্যাপল ও মাইক্রোসফটের পরেই।
তথ্যসূত্র : রয়টার্স, সিএনবিসি