সারা দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা শক্তভাবে প্রতিহত করা হবে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাসস জানিয়েছে, শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার আরেক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুরের পেছনে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্য থেকে জনমনে সৃষ্ট ক্রোধকে দায়ী করে সরকার।
বুলডোজারে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বুধবার রাতে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ধানমন্ডি ৫ নম্বরে শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদন। একই রাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ সরকার আমলের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বৃহস্পতিবারও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের হামলা হয়। ভেঙে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের ম্যুরাল।
শুক্রবারের সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “অন্তর্বর্তী সরকার গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সারা দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করছে। সরকার এ ধরনের কর্মকাণ্ড শক্তভাবে প্রতিহত করবে।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, “অন্তর্বর্তী সরকার নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রস্তুত। কোনও ধরনের উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হলে দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেবে এবং দোষীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে।”
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন দেওয়া হয়েছিল ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর ভবনে; তারপর ধ্বংসের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কালের সাক্ষী বাড়িটি। ঠিক ছয় মাস পর ঘোষণা দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সেই বাড়ি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা বুধবার ভার্চুয়াল এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন বলে আওয়ামী লীগ জানানোর পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা এই ‘বুলডোজার মিছিল’ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা শুরু হয় রাত ৯টার দিকে। প্রথমে হাতুড়ির মতো সাধারণ যন্ত্র দিয়ে ভাঙচুর শুরু করেন অভ্যুত্থানের সমর্থকরা। এরপর রাত বাড়তেই চলে আসে বুলডোজার।
এই ঘটনার প্রায় ২০ ঘণ্টা পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া হয় বিবৃতি, যেখানে বলা হয় ৩২ নম্বরে ভাঙচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত।
বৃহস্পতিবার সরকারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, “পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। গত ছয় মাসে ৩২ নম্বর বাড়িটিতে কোনো ধরনের আক্রমণ, ধংসযজ্ঞ হয়নি। গতকাল রাতে এটি ঘটেছে পলাতক শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে যার দুটো অংশ আছে।
“একটা অংশ হলো, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা আত্মদান করেছেন শেখ হাসিনা তাদেরকে অপমান করেছেন, অবমাননা করেছেন। শহীদের মৃত্যু সম্পর্কিত অবান্তর, আজগুবি ও বিদ্বেষমূলক কথা বলে পলাতক শেখ হাসিনা জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে অবজ্ঞা করেছেন ও অশ্রদ্ধা জানিয়েছেন।”
দ্বিতীয় অংশ সম্পর্কে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “শেখ হাসিনা দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অমানবিক প্রক্রিয়ায় নিপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতায় থাকাকালীন যে সুরে কথা বলতেন গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়ার পরেও তিনি একই হুমকি-ধামকির সুরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া প্রতিটি মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলে চলেছেন, হুমকি ধামকি দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির হুমকি দিয়েছেন।
“মানুষের মনে জুলাই গণহত্যা নিয়ে যে ক্ষত রয়েছে সে ক্ষততে শেখ হাসিনা একের পর এক আঘাত করে চলছেন। তার এই সহিংস আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।”
গত বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জুন মাস থেকে দেশে দানা বাঁধতে শুরু করে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন। জুলাই মাসে সেই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়, চলে গুলি। নিহতের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র হয় আন্দোলন।
ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সেই থেকে তিনি ভারতে রয়েছেন। ভারত সরকার কোন মর্যাদায় তাকে সেখানে আশ্রয় দিয়েছে সে সম্পর্কে গত ছয় মাসেও দেশটির কর্তাব্যক্তিরা মুখ খোলেননি।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকে পলাতক আওয়ামী লীগ সরকারের সব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপি ও দলটির শীর্ষ নেতারা। তাদের কাউকেই ৫ আগস্টের পর প্রকাশ্যে দেখা না গেলেও মাঝে মাঝেই বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের গ্রেপ্তারের খবর আসতে থাকে। আবার অনেকে পালিয়ে ভারত, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে গেছেন বলেও খবর আসে।
কেবল শীর্ষ নেতারাই নন, বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছেন বা পালিয়ে আছেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ (৫ আগস্টের পর আদালতের আদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত), যুবলীগসহ দলটির নানা অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারাও। গত ছয় মাসে কয়েকবার দলের ফেইসবুক পেইজ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও তা বড় কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি।
এর মধ্যেই বুধবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সোশাল মিডিয়ায় ঘোষণা দেয় শেখ হাসিনার ভাষণের। যার প্রতিক্রিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উদ্দেশে ‘বুলডোজার মিছিল’র কর্মসূচি ঘোষণা করে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ ও জনগণের জানমালের রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্ক আছে জানিয়ে প্রেস উইং বলছে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বাত্মকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের যথাযথ চেষ্টা করছে।
শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে একজন পরোয়ানাভুক্ত আসামি উল্লেখ করে প্রেস উইং বলেছে, “তিনি বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব।
“সরকার আশা করে, ভারত যেন তার ভূখণ্ডকে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এমন কাজে ব্যবহৃত হতে না দেয় এবং শেখ হাসিনাকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ না দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না।”