তিন বছর আগে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর তা গোটা বিশ্বকেই ভোগাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলে আসছিলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকলে এই যুদ্ধ বাঁধতেই দিতেন না। প্রেসিডেন্ট হলে এক দিনেই যুদ্ধ থামিয়ে দেবেন, এমন কথাও ছিল তার মুখে।
গত ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের পদে ফেরার পর তা সহযোগীরা এক দিনের বদলে কয়েক মাস লাগার কথাই বলছিলেন। তবে বুধবার ট্রাম্পের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘণ্টাব্যাপী ফোনালাপের পর ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের পালে হাওয়া লেগেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপকে ‘বেশ গঠনমূলক’ বলেছেন ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, এই অযৌক্তিক যুদ্ধ বন্ধ হওয়া দরকার।
অন্যদিকে রুশ প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনায় পুতিনেরও সায় রয়েছে।
এদিকে পুতিনের সঙ্গে কথার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির সঙ্গেও ট্রাম্পের ফোনালাপের খবর দিয়েছে বিবিসি। তারপর ভলোদমির জেলেনস্কি বলেছেন, দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে তার।
ইউক্রেনের ন্যাটোতে যুক্ত হতে চাওয়ার জের ধরে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে সামরিক অভিযান শুরু করে প্রতিবেশী দেশ রাশিয়া। তারপর থেকে চলছে যুদ্ধ।
কৃষ্ণ সাগর কূলের এই যুদ্ধ ছায়া ফেলে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে। ইউরোপের উন্নত দেশগুলো থেকে শুরু করে সব মহাদেশের অনুন্নত দেশগুলোকেও টানতে হচ্ছে এই যুদ্ধের জের।
গত তিন বছরের যুদ্ধে এরই মধ্যে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, ঘর হারিয়েছে ৪০ লাখের বেশি মানুষ। ৬৮ লাখ মানুষ বাঁচার জন্য ইউক্রেন ছেড়েছে।
যুদ্ধ বন্ধে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ পরিস্থিতি আরও জটিলই করেছে কেবল।
এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে তিন বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতায় বসেই সেই ব্যয় কমিয়ে আনার পরিকল্পনা থেকে যুদ্ধের রাশ টানতে চাইছেন ট্রাম্প।
পুতিনে সঙ্গে বুধবারের ফোনালাপের ট্রাম্প টুথ সোশাল লিখেছেন, যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার সঙ্গে একমত হয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের সমঝোতার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরুর বিষয়েও একমত হয়েছেন তারা।
ট্রাম্প সোশাল মিডিয়া পোস্টে আরও লিখেছেন, “অযৌক্তিক এই যুদ্ধ এখনই বন্ধ হওয়া জরুরি। এই যে মৃত্যু, ধ্বংস, এটা পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয়। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মানুষের ওপর স্রষ্টার করুণা বর্ষিত হোক।”
পুতিনের সঙ্গে কবে নাগাদ সরাসরি আলোচনা হবে, তা নিশ্চিত করেননি ট্রাম্প। কিন্তু তিনি হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, সৌদি আরবে তাদের এসঙ্গে বসা হতে পারে।
রুশ প্রেসিডেন্টের দপ্তরের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ মস্কোয় সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনায় সায় দিয়েছেন তার প্রেসিডেন্ট এবং বলেছে, এনিয়ে দুই পক্ষ একসঙ্গে কাজ শুরু করতে পারে।
ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে ফোনালাপটি প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী ছিল বলে জানান পেসকভ। তিনি বলেন, ট্রাম্পকে মস্কোয় আমন্ত্রণও জানিয়েছেন পুতিন।
এর পরপরই জেলেনস্কি জানান, ট্রাম্পের সঙ্গে তার টেলিফোনে কথা হয়েছে এবং এই অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাদের আলোচনা হয়েছে।
যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে আগ্রহী হলেও জেলেনস্কিকে হতাশ হতে হচ্ছে ট্রাম্পের একটি কথায়। ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে নেওয়ার সম্ভাবনা এখন নেই বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
আগামী শুক্রবার জার্মানির মিউনিখে ইউক্রেন নিয়ে একটি নিরাপত্তা সম্মেলন হবে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে জেলেনস্কির আলাপ হওয়ার কথা রয়েছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের কথায়ও নিরাশ হতে হচ্ছে জেলনস্কিকে। তিনিও ইউক্রেনের এথন ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির বিপক্ষেই অবস্থান নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। আর তাতে সমর্থনও দিয়েছেন ট্রাম্প।
কিয়েভে থাকা বিবিসির সাংবাদিক জেমস ওয়াটারহাউস বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের এমন অবস্থান ইউক্রেন সরকারের কাছে অনেকটাই চটেটাঘাতের মতো হয়েছে। যদিও এটা মনেই করা হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের আগের জো বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনের প্রতি যতটা সহানুভূতিশীল থাকবে, ট্রাম্প প্রশাসন ততটা থাকবে না।
ন্যাটোতে ইউক্রেনকে নিতে না চাওয়ার অর্থ কিয়েভেকে ছাড় দিতে হচ্ছে।
জেলেনস্কি এর আগে বলে আসতেন, ইউক্রেন বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হলে ইউক্রেনকে সঙ্গে রেখেই নিতে হবে।
কিন্তু ট্রাম্প যখন পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপ করছেন, তখন জেলেনস্কিকে বাদ রেখেই করেছেন; যা জেলনস্কির হতাশ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তবে জেলেনস্কি বলেছেন, ট্রাম্পের সঙ্গে তার আলোচনা বেশ ভালোই হয়েছে এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনাই করেছেন তারা।
তিনি বলেছেন, “শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক, সেটা ইউক্রেনের চেয়ে বেশি আর কেউ চায় না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে আমরা সেই পথে এগিয়ে যেতে চাই।”