ইউক্রেনের দুর্লভ খনিজ পদার্থের অর্ধেকের মালিকানা চায় যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের অংশীদারত্ব চুক্তির অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কাছে এই প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট গত বুধবার এক বৈঠকে জেলেনস্কির কাছে একটি খসড়া চুক্তি উপস্থাপন করেন। ওয়াশিংটন ডিসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আট কর্মকর্তার বরাতে এনবিসি নিউজ এই তথ্য প্রকাশ করেছে। তবে জেলেনস্কি প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেননি। তিনি বলেছেন, এটি পর্যালোচনা করে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
ওয়াশিংটনে ইউক্রেনের দূতাবাস ও হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র এনবিসির মন্তব্যের অনুরোধে তাৎক্ষণিক সাড়া দেয়নি।
ট্রাম্প প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা কিয়েভের কাছ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ চায়। এছাড়া ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি আমদানি করার প্রতিশ্রুতি দিতেও বলা হয়েছে। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেবে।
দুর্লভ খনিজ পদার্থ পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল। আধুনিক জীবনের অনেক প্রযুক্তিতে এদের ব্যবহার রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ এসব পদার্থের নাম শোনেননি বা কাজ সম্পর্কে জানেন না।
লুটেশিয়াম ও ডিসপ্রোসিয়ামের মতো দুর্লভ খনিজগুলো বিভিন্ন প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়। এগুলো আইফোন, এমআরআই মেশিন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে কার্বন নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে এর চাহিদা আরও বেড়েছে।
বিশ্ব দীর্ঘদিন ধরে দুর্লভ খনিজের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল। তবে পশ্চিমা দেশগুলো সরবরাহ ব্যবস্থা বৈচিত্র্যময় করতে চাইছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদের দিকে নজর দিয়েছেন। তিনি ডেনমার্কের এ অঞ্চল দখলের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন। পাশাপাশি ইউক্রেনের সঙ্গে সরবরাহ চুক্তি করার আগ্রহও প্রকাশ করেছেন।
ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের সামগ্রিক মূল্য সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায় না। তবে নিউইয়র্ক পোস্ট ও ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও দুর্লভ খনিজের মূল্য ৫০ কোটি থেকে ৫০ হাজার কোটি ডলারের মধ্যে হতে পারে।
কিয়েভের সেন্টার ফর ইকোনমিক স্ট্র্যাটেজির জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ভলোদিমির লান্ডা এনপিআরকে জানান, তিনি ২০২৩ সালে ফোর্বস ইউক্রেনের জন্য দেশটির সব খনিজ সম্পদের একটি জরিপ পরিচালনা করেন। এতে তিনি ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের মূল্য ১৪ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার হিসেবে উল্লেখ করেন। ইউক্রেন সরকারও এই হিসাবকে গ্রহণ করেছে। কিছু অনুমানে এই মূল্য আরও বেশি বলা হয়েছে।
সম্প্রতি ফক্স নিউজকে ট্রাম্প বলেন, তিনি ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন যে, আমেরিকার চলমান সহায়তার বিনিময়ে তিনি দেশটির খনিজ অধিকার চান।
তিনি বলেন, “তারা মূলত এতে সম্মত হয়েছে। আমি তাদের বলেছি, আমাদের কিছু পেতে হবে। আমরা শুধু টাকা দিয়ে যেতে পারি না।”
ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র এখনো সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। ট্রাম্প প্রশাসনের বিশেষ দূত আগামী সপ্তাহে ইউক্রেন সফর করবেন।
রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ও খনি রয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনের পোকরভস্ক শহরের কাছাকাছি তীব্র লড়াইয়ের ফলে দেশটির শেষ কার্যকর কোকিং কয়লা খনি বন্ধ হয়ে গেছে।
কোকিং কয়লা হলো এক ধরনের বিশেষ কয়লা, যা উচ্চ তাপমাত্রায় উত্তপ্ত হলে কঠিন, শক্ত এবং ছিদ্রযুক্ত পদার্থে পরিণত হয় যাকে কোক বলে। এটি প্রধানত ইস্পাত উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
সাধারণ কয়লার তুলনায় কোকিং কয়লায় কার্বনের পরিমাণ বেশি এবং এটি কম ধোঁয়া ও কম ছাই তৈরি করে। এজন্য এটি ধাতব শিল্পে, বিশেষ করে লোহা ও ইস্পাত কারখানায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে সাউথ ক্যারোলাইনার রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসি গ্রাহাম এই চুক্তিকে (খনিজ পদার্থ) রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টির উপায় হিসেবে দেখছেন।
মিউনিখ সম্মেলনে তিনি বলেন, “পুতিন বুঝতে পারছেন না, আসলে কী ঘটছে। যদি আমরা এই খনিজ চুক্তিতে স্বাক্ষর করি, তাহলে পুতিন বিপদে পড়বেন, কারণ ট্রাম্প এই চুক্তি রক্ষা করবেন।”
অর্থনীতিবিদ লান্ডা এনপিআরকে বলেছেন, তিনি আশা করেন, আমেরিকান বিনিয়োগকারীরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজে আগ্রহী হবে — টাইটানিয়াম, যা বিমানচালনায় ব্যবহৃত হয়, এবং লিথিয়াম, যা ইলেকট্রনিক্সে ব্যবহৃত হয়। তিনি আশা করেন, উৎপাদন চক্রের একটি বড় অংশ ইউক্রেনেই থাকবে।
রাশিয়ার দখল করা ইউক্রেনের অংশে কিছু লিথিয়াম খনি রয়েছে। এগুলো সম্মুখ সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত। তবে লান্ডা বলেন, অন্যান্য খনিগুলো নিরাপদ এবং অপ্রস্তুত রয়েছে। তিনি জানান, আজারবাইজানভিত্তিক কোম্পানি এনইকিউএসওএল এই শরৎকালে দুটি বড় টাইটানিয়াম খনি কিনেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ সময়কার কূটনীতিক ও প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনে ইউক্রেনে ওয়াশিংটন ডিসির বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন কূর্ত ভলকার। তিনি এনইকিউএসওএল কোম্পানির পরামর্শক বোর্ডে আছেন। এ তথ্য কোম্পানিটির ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া গেছে।
ইউক্রেনের প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ এনভায়রনমেন্টালিস্টসের সভাপতি লিউডমিলা সিগানোক সতর্ক করেছেন যে, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ প্রক্রিয়াজাতকরণের ফলে তৈরি হওয়া রাসায়নিক উপাদান সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না, ফলে এটি মাটি এবং ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণ ঘটাতে পারে।
দুর্লভ খনিজ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের চিহ্নিত খনিজ পদার্থগুলো আসলে অতটা বিরল নয়। তবে এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এগুলো ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে বায়ু বিদ্যুৎ টারবাইন পর্যন্ত প্রযুক্তির ভিত্তি। তবে চীন বিশ্বব্যাপী এই খনিজের সরবরাহ ব্যবস্থার অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করে, যা ওয়াশিংটনের জন্য একটি কৌশলগত দুর্বলতা সৃষ্টি করেছে। এই সমস্যা সমাধানে বহু বছর ধরে তারা চেষ্টা করছে।
বিরল খনিজ পদার্থ নিয়ে কিয়েভ ও ওয়াশিংটন ডিসির মধ্যে চুক্তি হলেও, একে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের চিহ্নিত ৫০টি কৌশলগত খনিজ পদার্থের মধ্যে ২৩টি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের চিহ্নিত ৩৪টি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের মধ্যে ২৬টি ইউক্রেনে আছে। বিশেষভাবে ইউক্রেন পাঁচটি মূল খনিজে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে: টাইটানিয়াম, গ্রাফাইট, লিথিয়াম, বেরিলিয়াম ও দুর্লভ খনিজ আরইইএস।
তবে বর্তমানে দেশটি দুর্লভ খনিজ উৎপাদন করে না। গত কয়েক দশকেও এর উৎপাদন হয়নি।
টাইটানিয়াম হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল। এটি বিমানচালনা, সেনা, রাসায়নিক ও রঙ তৈরির শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
ইউরোপের মধ্যে ইউক্রেনে সবচেয়ে বড় টাইটানিয়াম রিজার্ভ রয়েছে। আর টাইটানিয়াম রুটাইল রিজার্ভের মধ্যে শীর্ষ-৫-এ রয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধাতব টাইটানিয়াম চাহিদা ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূরণ করতে সক্ষম।
বিশ্বব্যাপী টাইটানিয়াম সরবরাহ চেইন চীন ও রাশিয়ার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। কারণ তারা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। রাশিয়া টাইটানিয়ামের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে এটি বোইং, এয়ারবাস এবং বিমানচালনা ও প্রতিরক্ষা খাতের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
আগামী দশকে ব্যাটারির চাহিদা কয়েক গুণ বাড়বে। ব্যাটারি সরবরাহ চেইনের ৯০ শতাংশ বিশেষ করে লিথিয়াম প্রক্রিয়াকরণ নিয়ন্ত্রণ করে চীন।
বিশ্বব্যাপী লিথিয়াম রিজার্ভের মধ্যে ইউক্রেনের অবস্থান তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে ইউরোপীয় দেশগুলোর রিজার্ভের প্রায় তৃতীয়াংশ ইউক্রেনে রয়েছে। ফলে এটিকে ইউরোপীয় ব্যাটারি শিল্পের জন্য সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ কার্বনেট বা হাইড্রোক্সাইড সরবরাহকারী হিসেবে দেখা হয়।
বর্তমানে ইউক্রেনে লিথিয়াম উত্তোলন করা হয় না। দেশটির চারটি লিথিয়াম খনির মধ্যে দুইটিই রাশিয়ার দখলে।
টান্টালাম, নিয়োবিয়াম ও আরইইএস উত্তোলনের সুযোগ মূলত নভোপোলটাভা ফসফেট রিজার্ভ ও আজভ দুর্লভ খনিজ উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই দুটি বর্তমানে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের খনিজ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ গ্রেসলিন বাসকারান বলেন, “ট্রাম্পের রাশিয়ার সঙ্গে হয়তো ভালো সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে আপনি একটি খনি শূন্য থেকে তৈরি করতে এবং সম্পদ উত্তোলন করতে তিন বা চার বছরে পারবে না। বিশ্বব্যাপী গড় হিসেবে, একটি খনি তৈরি করতে ১৫ বছর সময় লাগে। এটি একটি দশকব্যাপী প্রচেষ্টা।”
মাটি থেকে সম্পদ উত্তোলন, নতুন খনিজ সরবরাহ চেইন তৈরি করতে প্রক্রিয়াকরণ, পরিশোধন এবং উৎপাদন ব্যবস্থা সহ একটি পুরো ইকোসিস্টেম প্রয়োজন, যা তৈরি করতে সময় ও বিনিয়োগ লাগে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে কাজ করার জন্য বেসরকারি খাতের তেমন আগ্রহ নেই।
ইউক্রেনের খনিজ সম্পর্কে ভূতাত্ত্বিক তথ্য ও ডেটা খুবই কম। তবে রয়টার্সের মতে এবং কিয়েভভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক উই বিল্ড ইউক্রেন অনুমান করেছে, রাশিয়ার দখলে থাকার কারণে ইউক্রেনের ধাতব খনিজ সম্পদের ৪০ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে না। আর জেলেনস্কি জানিয়েছেন, তার দেশের খনিজ সম্পদের ২০ শতাংশের কম রাশিয়ার দখলে রয়েছে।
তথ্যসূত্র : ফরেন পলিসি, এনপিআর,এনবিসি নিউজ, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ব্লুমবার্গ।