Beta
শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে সৌদি আরবের দ্বিগুণ রেমিটেন্স

ডলার
ডলার
[publishpress_authors_box]

বাংলাদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স আসা শুরু হয় ১৯৭৪-৭৫ অর্থ বছর থেকে। ওই বছরে মাত্র ১ কোটি ১৮ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত অর্থ বছরে সেই রেমিটেন্স দুই হাজার গুণের বেশি বেড়ে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।

এই ৫০ বছরে প্রতিবারই সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছে। ‘রেমিটেন্স মানেই সৌদি থেকে আসে’ সবার মুখে মুখে ছিল এতদিন।

কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ঘটে ব্যতিক্রম। ওই অর্থ বছরে সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সেটাও উল্টে গেছে।

এই অর্থ বছরের প্রথম সাত মাসেই (জুলাই-জানুয়ারি) বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৩০০ কোটি (৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। এই অঙ্ক সৌদি আরবের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। আর আরব আমিরাতের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।

গত অর্থ বছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সৌদি আরব থেকে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল; আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার।

চলতি অর্থ বছরের এই সাত মাসে গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি, ১২০ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার রেমিটেন্স প্রবাহের দেশভিত্তিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গেছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ২৯০ কোটি ২৭ লাখ (২.৯০ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছে। গত অর্থ বছরের একই সময়ে এসেছিল ১ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার।

ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স প্রবাহের চিত্র পাল্টে যায়। প্রতি মাসেই বেশি প্রবাসী আয় আসছে দেশটি থেকে।

রেমিটেন্স সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা মোট ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) দেশে পাঠিয়েছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৭ কোটি ৩৪ লাখ ডলার এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। সৌদি আরব থেকে এসেছে ২৭ কোটি ডলার। আরব আমিরাত থেকে এসেছে ২৪ কোটি ৯৫ লাখ ডলার।

আগের মাস ডিসেম্বরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স আসে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে ৫৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আরব আমিরাত থেকে আসে ৩৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। সৌদি আরব থেকে আসে ২৯ কোটি ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে আসে ২৪ কোটি ৮১ লাখ ডলার।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের এক পর্যায়ে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। ক্ষমতার এই পালাবদলে আগস্ট থেকে প্রবাসী আয়ও বাড়তে শুরু করে।

হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় এভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও প্রবাসী আয় আহরণের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে সকাল সন্ধ্যার।

তারা বলছেন, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে এক ধরনের বড় পরিবর্তন হয়েছে। এখন প্রবাসী আয় প্রেরণকারী বৈশ্বিক বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশ থেকে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রবাসী আয় কিনে নেয়। পরে সেসব আয় একত্র করে নির্দিষ্ট একটি দেশ থেকে তা গন্তব্য দেশে পাঠায়।

ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রামসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রিগেটেড (সমন্বিত) পদ্ধতিতে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করে প্রেরণ করছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রামসহ প্রবাসী আয় প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী আয় সংগ্রহের পর তা এক জায়গা থেকে গন্তব্য দেশে পাঠাচ্ছে। ফলে পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, যে প্রতিষ্ঠান যে দেশ থেকে এসব আয় পাঠাচ্ছে, সেসব দেশ থেকে প্রবাসী আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় বেড়ে যাওয়া মানে দেশটি থেকে প্রকৃত প্রবাসী আয় বেড়েছে- হয়তো তেমন নয়। অন্যান্য দেশের আয়ও প্রবাসী আয় প্রেরণকারী বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর হাত ঘুরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে। এ কারণে পরিসংখ্যানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয়ের বড় প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে কাগজে-কলমে।”

অন্য কারণও বলেছেন অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “প্রথমত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় অন্যান্য দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও এক ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছিল; মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দেশটির মানুষের পাশাপাশি সেখানে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদেরও খরচ বেড়েছিল।

“সে কারণে সেখানকার প্রবাসীরা দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে কম টাকা পাঠিয়েছিলেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি কমে স্বাভাবিক হয়েছে; ২ শতাংশে নেমেছে। অর্থনীতিও চাঙা হচ্ছে। তাই এখন আমাদের প্রবাসীরা বেশি টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন।”

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এছাড়া আরও কিছু কারণ আছে। সেগুলো হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমাতে গত ১৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র নীতি সুদহার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়েছে। এর আগেও কয়েক দফা বাড়িয়েছিল। এর বিপরীতে বাংলাদেশে সুদহার বাড়ছে।

“আবার বৈদেশিক মুদ্রায় সঞ্চয়ের বিভিন্ন নীতিমালা সহজ হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সাহায্য, সরকার পরিবর্তনের পর হুন্ডি কমাসহ বিভিন্ন কারণে রেমিটেন্স বাড়তে পারে।”

তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা পেশাগতভাবে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে আছেন। ফলে তাদের উপার্জনও হয় বেশি। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যারা দেশে টাকা পাঠান, তারা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি অর্থ দেশে পাঠাতে পারেন। তাদের অনেকেই আবার বন্ডে বিনিয়োগ করেন।”

গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সৌদি আরবের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ রেমিটেন্স আসে আমিরাত থেকে। ওই অর্থ বছরে সৌদি থেকে ২৭৪ কোটি ১৫ লাখ ডলার আসে। আমিরাত থেকে আসে ৪৬০ কোটি ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৯৬ কোটি ১৬ লাখ ডলার এসেছিল।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থ বছরের পুরো সময়ে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন) যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে রেমিটেন্স এসেছিল, চলতি অর্থবছরের সাত মাসেই অর্থাৎ জুলাই-জানুয়ারি সময়ে তার প্রায় সমান এসেছে।

এর আগের অর্থ বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ সময়ে সৌদি আরব থেকে ৩৭৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২৪ দশমিক ১০ শতাংশ কম, ৩০৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল যথাক্রমে ৩৫২ কোটি ২০ লাখ ও ২০৮ কোটি ৪ লাখ ডলার।

২০২১-২২ অর্থ বছরে সবচেয়ে বেশি ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ (৪.৫৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল সৌদি আরব থেকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল ১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।

স্বাধীনতার পর থেকে শীর্ষে ছিল সৌদি আরব

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে বরাবরই সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসছিল। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২০-২১ অর্থ বছরে প্রবাসীরা মোট ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। তার মধ্যে সৌদি আরব থেকে এসেছিল ৫৭২ কোটি ১৪ লাখ (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলার।

দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, এসেছিল ৩ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। আর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল ২ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার।

কিন্তু ২০২১-২২ অর্থ বছরে রেমিটেন্স প্রবাহ ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমে যায়; আসে ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার। ওই অর্থ বছরে সব দেশ থেকেই কম আসে রেমিটেন্স।

ওই অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার আসে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে আসে ২ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য যত শ্রমিক বিদেশে গেছেন, তার প্রায় ২০ শতাংশ গেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বর্তমানে দেশটিতে ১৫ লাখের মতো প্রবাসী কাজ করছেন।

বিএমইটির হিসাবে, বাংলাদেশের শীর্ষ শ্রমবাজার সৌদি আরব। ১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশই গেছে দেশটিতে। সংখ্যার দিক থেকে যা ৫৫ লাখের বেশি।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাদের বড় অংশই রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে; কাজ করছেন বিভিন্ন শ্রমঘন পেশায়। যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত