Beta
রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

১০ বছর এফবিআই চালাবেন, কে এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত কাশ প্যাটেল

কাশ প্যাটেল
কাশ প্যাটেল
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্রের সেনেট কাশ প্যাটেলকে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) পরবর্তী পরিচালক হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। আগামী ১০ বছরের জন্য তিনি এফবিআইয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোনীত আরেকজন প্রার্থী সফলভাবে প্রবেশ করলেন।

গত বছরই এক অনুষ্ঠানে কাশ প্যাটেলকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, “তৈরি হও কাশ, তুমি তৈরি হও।” বলা হয়, প্রথমবার ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ই কাশ প্যাটেলকে সিআইএর উপপ্রধান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন হোয়াইট হাইজের কর্মকর্তাদের বিরোধিতায় করতে পারেননি।

বৃহস্পতিবার সেনেটে ভোটাভুটিতে ৫১ জন সেনেটর সাবেক ফেডারেল প্রসিকিউটর কাশ প্যাটেলের পক্ষে ভোট দেন। ভোটারদের সবাই রিপাবলিকান।

রিপাবলিকান পার্টির দুই সেনেটর কাশ প্যাটেলের নিয়োগের বিরোধিতা করেছেন। তারা হলেন আলাস্কার লিসা মারকোভস্কি ও মেইনের সুসান কলিন্স। তারা ৪৭ জন ডেমোক্র্যাট সেনেটরের সঙ্গে মিলে এফবিআই পরিচালকের পদে এই মনোনয়নের বিপক্ষে ভোট দেন। সমালোচকরা এই মনোনয়নকে বিপজ্জনক বলে মন্তব্য করেছেন। 

ডেমোক্র্যাট সেনেটর ডির্ক ডারবিন বলেন, “কাশ প্যাটেলের অতীত রেকর্ড প্রমাণ করে যে তিনি বিপজ্জনক, অভিজ্ঞতাহীন ও অপ্রত্যাশিত। তিনি এফবিআই পরিচালক হিসেবে কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।”

কাশ প্যাটেল সোশাল মিডিয়ায় এক পোস্টে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, এই পদে মনোনীত হয়ে তিনি সম্মানিত বোধ করছেন। 

প্যাটেল লেখেন, “আমাদের বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে জনবিশ্বাস হারিয়েছে। কিন্তু আজ থেকে তা শেষ। আমার দায়িত্ব স্পষ্ট : ভালো পুলিশদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং এফবিআইয়ের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা।”

ভোটের আগে ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতারা, যার মধ্যে সিনেটর ডির্ক ডারবিনও ছিলেন, সেনেট ফ্লোরে প্যাটেলের মনোনয়নের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দেন। তারা বলেন, প্যাটেল এফবিআইকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন। 

তারা প্যাটেলের নিরপেক্ষ নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অতীতে দেওয়া তার কিছু বক্তব্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যেখানে প্যাটেল ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, তিনি এফবিআইয়ের সম্পদ ব্যবহার করে ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। 

ডারবিন বলেন, “এত বড় জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি থাকা সত্ত্বেও আমার রিপাবলিকান সহকর্মীরা তাকে সমর্থন দিচ্ছেন—এটি সত্যিই বিস্ময়কর। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমি বিশ্বাস করি তারা শিগগিরই এই সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত হবেন। বিশ্বের শীর্ষ অপরাধ তদন্ত সংস্থার পরিচালক হিসেবে এই ব্যক্তিকে ১০ বছরের দায়িত্ব দেওয়া। এর চেয়ে খারাপ সিদ্ধান্ত কল্পনাও করা যায় না।”

এই উদ্বেগই প্যাটেলের অনুমোদন প্রক্রিয়ায় কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ইতিহাসে এফবিআই পরিচালকদের সাধারণত বড় পার্থক্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাদের মনোনয়ন দুই দলের সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু প্যাটেলের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন।

সাবেক এফবিআই পরিচালক ক্রিস্টোফার রে ২০১৭ সালে ৯২ ভোট পেয়ে অনুমোদন পেয়েছিলেন। এর আগে, ২০১৩ সালে জেমস কমি ৯৩ ভোটে সমর্থন পেয়েছিলেন। আর ২০০১ সালে রবার্ট মুলার সর্বসম্মতভাবে ৯৮-০ ভোটে অনুমোদিত হয়েছিলেন। 

তবে সেনেটে ৫৩ সদস্যের রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কোনও মনোনীত প্রার্থী অনুমোদনে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা কম। 

কেন্টাকির সেনেটর মিচ ম্যাককনেল, যিনি আগে তুলসি গ্যাবার্ড ও রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়রের মনোনয়নে নিজের দলের বিরোধিতা করেছিলেন তিনিও বৃহস্পতিবার প্যাটেলকে সমর্থন দেন।

তবে আলাদা বিবৃতিতে সেনেটর কলিন্স ও মারকোভস্কি জানান, তারা প্যাটেলের পক্ষে ভোট দিতে পারেননি। তাদের আশঙ্কা, তিনি এফবিআইকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেন। 

মারকোভস্কি লিখেছেন, “প্যাটেলের প্রতি আমার সংশয় তার পূর্বের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে এসেছে। এগুলো তার নেতৃত্বকে প্রভাবিত করতে পারে। এফবিআইয়ের উচিত অপরাধ ও দুর্নীতি দমন করা, রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেওয়া নয়।”

সেনেটর কলিন্সও একই মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্যাটেলের ‘আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড’ তার নিরপেক্ষভাবে এফবিআই পরিচালনার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে। 

কলিন্স এক বিবৃতিতে আরও বলেছেন, “সম্প্রতি প্যাটেলের রাজনৈতিক ভূমিকা তাকে এফবিআই পরিচালকের নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।” 

প্যাটেলকে নিয়ে এবারই প্রথম রিপাবলিকানদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়নি। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে প্যাটেল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ ও জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালকের কার্যালয়ে কাজ করেছেন। 

তবে তখন সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, সিআইএ পরিচালক গিনা হাসপেল হুমকি দেন, যদি ট্রাম্প তাকে সিআইএর উপ-পরিচালক করেন, তবে তিনি পদত্যাগ করবেন। 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত কাশ প্যাটেল।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত কাশ প্যাটেল।

এছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের অ্যাটর্নি জেনারেল বিল বার তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন, প্যাটেলকে এফবিআইয়ের উপ-পরিচালক করার একটি প্রস্তাব তিনি কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেন, “আমার জীবদ্দশায় এটা হতে দেব না।”

জানুয়ারিতে অনুমোদন শুনানির সময় কাশ প্যাটেল বলেন, এফবিআইকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কোনও ইচ্ছা বা পরিকল্পনা তার নেই। তিনি এও জানান, এফবিআই পরিচালক হলে তিনি কোনও অবৈধ কাজ করবেন না। 

ডেমোক্র্যাট সেনেটরদের কঠোর প্রশ্নের মুখে তিনি বলেন, “আমার কোনও স্বার্থ নেই, কোনও ইচ্ছা নেই। আমি পেছনে ফিরে যেতে চাই না। এফবিআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে না।” 

প্যাটেল এফবিআইয়ের আইন প্রয়োগের ক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনাও তুলে ধরেন। তিনি জানান, দেশের ৫০টি অঙ্গরাজ্যে এফবিআইয়ের সম্পদ আরও সমানভাবে বিতরণ করবেন। 

কাশ প্যাটেল বলেন, “এফবিআইয়ের এক-তৃতীয়াংশ কর্মী ওয়াশিংটন ডিসিতে কাজ করেন। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে পাঠানো হবে, যেখানে আমি নিজেও থাকি। তারা শেরিফ বিভাগ ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করবেন।” 

কাশ প্যাটেল একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তার পরিবার উগান্ডা থেকে কানাডা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল। তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোকে ‘মিথ্যা ও বিকৃত উপস্থাপন’ বলে অভিহিত করেন। 

গত সেপ্টেম্বরে ‘দ্য শন রায়ান শোতে’ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাশ প্যাটেল ওয়াশিংটন ডিসিতে এফবিআই সদরদপ্তর ‘বন্ধ করে’ সেটিকে ‘ডিপ স্টেটের জাদুঘরে’ পরিণত করার হুমকি দেন। 

২০২৩ সালে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিভ ব্যাননের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্যাটেল প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। তিনি তাদের ‘অপরাধী’ ও ‘ষড়যন্ত্রকারী’ বলে অভিহিত করেন।

প্যাটেল বলেন, ২০২০ সালে জো বাইডেনের কাছে ট্রাম্পের নির্বাচনী পরাজয় জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছে, যা আসলে একটি মিথ্যা দাবি। 

তিনি বলেন, “আমরা ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করব, শুধু সরকারে নয়, গণমাধ্যমেও। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব, যারা মিথ্যা বলে আমেরিকান নাগরিকদের বদনাম করেছে এবং জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপি করতে সাহায্য করেছে।” 

প্যাটেল শিশুদের জন্য ‘দ্য প্লট অ্যাগেইনস্ট দ্য কিং’ নামে একটি বই লিখেছেন। এতে ট্রাম্পকে এক রাজা হিসেবে দেখানো হয়েছে, যিনি হিলারি ক্লিনটন ও কমলা হ্যারিসের মতো চরিত্রদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। হিলারি ক্লিনটন ২০১৬ সালের এবং কমলা হ্যারিস ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।

ডেমোক্র্যাটরা তাকে ২০২১ সালের ক্যাপিটল হামলায় অভিযুক্ত কিছু ব্যক্তির গঠিত ‘জে৬ কেয়ার’ নামের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার জন্যও কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন।

সিনেটে কাশ প্যাটেলের অনুমোদন ভোটের আগে ডেমোক্র্যাট সেনেটর অ্যালেক্স পাডিলা অভিযোগ করে বলেন, প্যাটেল ট্রাম্পকে তার ‘অর্থ উপার্জনের মাধ্যম’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি ট্রাম্পের নাম ভাঙিয়ে মিডিয়া উপস্থিতি ও প্রকাশনা চুক্তি করছেন। 

পাডিলা প্রশ্ন তোলেন, প্যাটেলের আইন প্রয়োগ বা গোয়েন্দা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা আদৌ এফবিআই পরিচালকের দায়িত্বের জন্য যথেষ্ট কি না? 

তিনি বলেন, “কাশ প্যাটেল ভয়ানক সিদ্ধান্তহীনতা, প্রস্তুতির অভাব ও নিরপেক্ষতার অভাব দেখিয়েছেন। যদি তিনি এফবিআই পরিচালক হন, তবে তিনি আমেরিকান জনগণকে রক্ষা করতে ও সংবিধান সমুন্নত রাখতে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারবেন না বা চান না।” 

ডেমোক্র্যাট সেনেটর অ্যাডাম শিফও এই মত প্রকাশ করেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, ট্রাম্প প্রশাসনের ফেডারেল কর্মীসংখ্যা কমানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্যাটেলের নেতৃত্বে এফবিআই দুর্বল হয়ে পড়বে। 

তথ্যসূত্র : আল জাজিরা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত