যেতে হবে ‘সেকেন্ড রিপাবলিকে’, আর সেখানে পৌঁছতে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে নতুন সংবিধান- এই ঘোষণা দিয়েই নতুন যাত্রা শুরু করলেন নতুন দলের কাণ্ডারি নাহিদ ইসলাম।
রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু সংসদ ভবনের সামনের সুপ্রশস্ত সড়কে মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই ঘোষণা দেন নাহিদ তার সহযোদ্ধাদের পাশে রেখে, যাদের নেতৃত্বে সাত মাস আগে অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানে অবসান ঘটে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনের।
সেই অভ্যূত্থান মানুষের মনে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছিল, তা বাস্তবে রূপ দিতে নতুন ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’র কথা শুরু থেকেই বলে আসছিল আন্দোলনকারী তরুণরা।
তার ধারাবাহিকতায় এখন নতুন দল গড়লেন তারা, নাম দিলেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং তার মধ্য থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক কমিটির কয়েক মাসের প্রচেষ্টার ফল এই দল।
এই দলের দায়িত্ব নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে আসা নাহিদ দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতির বিকল্প হিসাবে জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ। ভারতপন্থী বা পাকিস্তানপন্থী- বাংলাদেশে এমন বিভাজনের কবর রচনাই তাদের লক্ষ্য।
জুলাই অভ্যুত্থানকে বিপ্লব বলে আসছে অভ্যুত্থানের নেতারা। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনের মতো এখন রাষ্ট্রক্ষমতার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা তাদের লক্ষ্য।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেওয়া নাহিদ বলেন, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা করেছে।
“একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদেরকে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।”
অভ্যুত্থানের ফসল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এরই মধ্যে সংবিধান সংস্কারে হাতে দিয়েছে। সংবিধানে মৌলিক সংস্কারের সুপারিশ রেখে প্রস্তাবও এসেছে।
সংবিধান সংস্কারের পর ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে। তবে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল শাসনতন্ত্রে মৌলিক সংস্কার নিয়ে আপত্তি তুলেছে। ফলে তরুণদের নতুন এই দলের ঘোষণার সঙ্গে পুরনো দলগুলোর দ্বন্দ্ব অনেকটা অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
তবে অভ্যুত্থানের মুখ নাহিদের কথায় স্পষ্ট, তারা বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ পাল্টে দেওয়ার চ্যালেঞ্জই নিয়েছেন। এটা ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব হিসাবে দেখছেন তারা।
“আজকের এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমরা কেবল সামনের কথা বলতে চাই। আমরা পেছনের ইতিহাসকে অতিক্রম করে একটি সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলতে চাই। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই আজ উপস্থিত হয়েছি।”
“জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্লোগান উঠেছিল তুমি কে, আমি কে; বিকল্প, বিকল্প। আজ সেই বিকল্পের জায়গা থেকে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে,” বলেন নাহিদ।
জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেরণায় বলীয়ান ২৬ বছরের এই যুবক বলেন, “দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে এক ধরনের বিভাজনের রাজনীতি তৈরি করে জনগণ ও রাষ্ট্রকে দুর্বল করে রাখার যে ষড়যন্ত্র ছিল, তা জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা ভেঙে দিয়েছি।
“আজ এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে শপথ করতে চাই, বাংলাদেশকে আর কখনও বিভাজিত করা যাবে না। বাংলাদেশে আর কখনও ভারতপন্থী বা পাকিস্তানপন্থী কোনও রাজনীতির ঠাঁই হবে না। আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে, বাংলাদেশের মানুষকে সামনে রেখে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনীতি ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ করব।”
সেই জুলাইয়ের আন্দোলন থেকে সরকারের অংশ হওয়া পর্যন্ত সবসময় নাহিদকে যে পোশাকে দেখা গেছে, আজও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তার পরনে ছিল ফুল প্যান্ট ও ফুলহাতা শার্ট। মাথায় বাঁধা ছিল জাতীয় পতাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা সদ্য শেষ করা নাহিদ ছিলেন বৈষম্যবিরোদী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। রক্তাক্ত অধ্যায়ে পেরিয়ে শেখ হাসিনা পতনের এক দফার ঘোষণা তার মুখ থেকেই এসেছিল।
বক্তব্যের শুরুতেই জুলাই গণঅভ্যূত্থানে নিহদের পরিবারের সদস্যদের স্মরণ করেন নাহিদ, সালাম জানান উপস্থিত ছাত্র-জনতা ও আমন্ত্রিত রাজনৈতিক দলের নেতাদের। তারপর তিনি তুলে ধরেন তার নতুন দলের ঘোষণাপত্র।
এরপর জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ উপলক্ষ্যে লিখিত সূচনা বক্তব্য পাঠ করতে শুরু করেন তিনি।
লিখিত বক্তব্যের শুরুতে ছিল দেশভাগ, পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বঞ্চণার প্রসঙ্গ। এরপর মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের কিছু প্রসঙ্গও তুলে ধরেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই স্বাধীনতা একটি সরকারের পতন ঘটিয়ে আরেকটি সরকার বসানোর জন্য আসেনি। জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিলে, যেন জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়।
“সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিচ্ছি।”
জাতীয় নাগরিক পার্টি কেমন দল হবে, লিখিত বক্তব্যে সে উত্তরও দেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, “এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।”
নাহিদ বলেন, “আমরা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চাই যেখানে সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার এবং পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের রাজনীতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনও স্থান হবে না।”
সেকেন্ড রিপাবলিকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে তুলে আনা হবে জানিয়ে নাহিদ বলেন, এতে সাধারণ মানুষ হবে সব ক্ষমতার উৎস। সব নাগরিককে সব ধরনের বৈষম্য থেকে সুরক্ষা পাবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে।
এই নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে শপথ নেওয়ার আহ্বান জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, “আমরা ঐক্যবদ্ধ হই এবং আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাই। আমাদের দেশ, আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ—আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক অধরা কোন স্বপ্ন নয়, এটি আমাদের প্রতিজ্ঞা!”