Beta
মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ২০২৫

‘নারীর নীরব কান্না’ এন্ডোমেট্রিওসিস

endometriosis
[publishpress_authors_box]

নারী স্বাস্থ্যের একটি বেদনাদায়ক সমস্যার নাম এন্ডোমেট্রিওসিস। এটি একটি জটিল দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা। প্রতিবছর বিশ্বের অসংখ্য নারীর জীবন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এ রোগে প্রভাবিত হয়।

বিশ্বের মোট নারী ও কন্যার ১০ শতাংশ প্রজনন বয়সে এই সমস্যার মুখোমুখি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৩ সালের তথ্য বলছে, তখন এ রোগে আক্রান্ত ছিল ১৯ কোটি নারী। এন্ডোমার্চ ওয়ার্ল্ডওয়াইডের তথ্য বলছে, এখন সংখ্যাটা আরও বেশি। বিশ্বব্যাপী এ রোগে ভুগছে ৪০ থেকে ১০০ কোটি নারী। প্রতি পাঁচজনে একজন নারী ও কন্যা এই যন্ত্রণাদায়ক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।

এ রোগে আক্রান্ত নারীরা রয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেই। তবে বিষয়টি নিয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা বা জানাশোনা খুব কম। সেই সচেতনতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবেই প্রতি বছরের মার্চ মাসে বিশ্বব্যাপী ‘এন্ডোমার্চ’ (EndoMarch) কর্মসূচি উদযাপন করা হয়। নারীদেরকে এন্ডোমেট্রিওসিস সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য।

চলতি বছরের দ্বাদশ এন্ডোমার্চ কর্মসূচির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘নারীর ক্ষমতায়ন: এন্ডোমেট্রিওসিস যত্নে বাধা দূর করুন।’ এবার এন্ডোমার্চ দিবস পালন করা হবে ২৯ মার্চ।

মাসব্যাপী সচেতনতা কর্মসূচিকে সামনে রেখে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হয় বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ ও গাইনোকোলজিস্ট ডা. শারমিন আব্বাসির সঙ্গে। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি জানান এ রোগের আদ্যোপান্ত। কথা বলেন রোগটির লক্ষণ, উপসর্গ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে।

শারমিন আব্বাসি বলেন, এন্ডোমেট্রিওসিস একটি গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ। এটি নারীকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে বেশ প্রভাবিত করে।

এ রোগের ব্যাপকতা এতই বেশি যে, বিশ্ব জুড়ে অনেক নারীর জীবনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এন্ডোমেট্রিওসিস। তাই এ রোগকে ‘নারীর নীরব কান্না’ নামেও অভিহিত করা হয় বলে জানান এই চিকিৎসক।

শারমিন আব্বাসি

এন্ডোমেট্রিওসিস কী

এন্ডোমেট্রিওসিস এমন একটি রোগ, যেখানে জরায়ুর ভেতরের স্তরের কোষগুলো (এন্ডোমেট্রিয়াম) অন্য স্থানে যেমন ডিম্বাশয়, ফ্যালোপিয়ান টিউব, পেটের অভ্যন্তরে অথবা কখনও কখনও মলদ্বারে বৃদ্ধি পায়। সাধারণত, প্রতি মাসে ঋতুস্রাবের সময় জরায়ুর এই স্তরের কোষগুলি ধ্বংস হয়ে যায় এবং বাইরে বের হয়ে আসে। কিন্তু এন্ডোমেট্রিওসিসের ক্ষেত্রে, এই কোষগুলি শরীরের অন্যান্য অংশে বেড়ে যায় এবং সেগুলি সেখানে ধ্বংস হতে পারে না। এর ফলে সেসব স্থানে প্রদাহ, তীব্র ব্যথা এবং অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়।

নারী স্বাস্থ্যে এন্ডোমেট্রিওসিস একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং সময়সাপেক্ষ সমস্যা। এটি নারী ও কন্যাদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। দেখা দিতে পারে সন্তান ধারণে সমস্যা। এন্ডোমেট্রিওসিস পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব নয়, তবে সঠিক চিকিৎসা এবং যত্নের মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

কারা ঝুঁকিতে

এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন ৩০-৪৫ বছর বয়সী নারীরা। এছাড়া যাদের সন্তান হয়নি বা বন্ধ্যাত্ব আছে বা প্রথম সন্তান দেরিতে নিয়েছের তারাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। পারিবারিক ইতিহাসও এ রোগের আশঙ্কা বাড়ায়।

উপসর্গ

কারও কারও ক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিওসিসের প্রধান উপসর্গ হল তীব্র পেটব্যথা, বিশেষ করে ঋতুস্রাবের সময়। পাশাপাশি আরও বেশ কিছু উপসর্গও দেখা যায়। তবে অনেক সময় বছরের পর বছর এই সমস্যার কোনো উপসর্গ না-ও থাকতে পারে।

এন্ডোমেট্রিওসিসের উল্লেখযোগ্য উপসর্গগুলো হলো-

ঋতুস্রাবের সময় ব্যথা : এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত নারীরা সাধারণত ঋতুস্রাবের সময় তীব্র ব্যথায় আক্রান্ত হয়। এমনকি এ সময় অতিরিক্ত রক্তপাত বা দীর্ঘস্থায়ী ঋতুস্রাব হতে পারে।

পেটে অস্বস্তি বা ফুলে যাওয়া : এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত নারীরা মাঝে মাঝে পেটের ভেতরে অস্বস্তি বা ফোলা অনুভব করেন। এটি তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

সন্তান ধারণে সমস্যা : নারীর প্রজনন ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এন্ডোমেট্রিওসিস। এ রোগে আক্রান্ত অনেক নারী গর্ভধারণে সমস্যার মুখেও পড়েন, কারণ এটি ডিম্বাশয় এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবের কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

ক্লান্তি এবং অবসাদ : এন্ডোমেট্রিওসিসের ফলে রোগী দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি এবং শারীরিক অবসাদ অনুভব করতে পারেন, যা তাদের কর্মক্ষমতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণ

এখনও এন্ডোমেট্রিওসিসের সঠিক কারণ পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে চিকিৎসকরা এর কিছু কারণ হতে পারে বলে ধারণা করছেন। সেগুলো হলো-

জেনেটিক কারণ : যদি পরিবারের কোনও সদস্য (মায়ের বা বোন) এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত হন, তবে পরবর্তী প্রজন্মের নারীদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

হরমোনের পরিবর্তন : কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে, উচ্চ মাত্রার ইস্ট্রোজেন হরমোন এন্ডোমেট্রিওসিসের বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। সুতরাং, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এর একটি কারণ হতে পারে।

রোগ প্রতিরোধে দুর্বলতা : কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এন্ডোমেট্রিওসিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। রোগ প্রতিরোধে দুর্বলতা থাকার কারণে শরীর অস্বাভাবিক কোষগুলিকে আক্রমণ করতে পারে না, এর ফলে এন্ডোমেট্রিয়াল কোষগুলো শরীরের অন্যান্য অংশে বৃদ্ধি পায়।

অন্যান্য চিকিৎসা পরিস্থিতি : কিছু গবেষণা থেকে এটি পরিস্কার যে, যাদের অতিরিক্ত ওজন বা অন্যান্য কিছু শারীরিক সমস্যার সঙ্গে লড়াই করছেন, তাদের মধ্যে এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

চিকিৎসা

এন্ডোমেট্রিওসিসের পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব নয়, তবে চিকিৎসার মাধ্যমে এর উপসর্গগুলি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে বেশ কয়েকটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়:

ওষুধ : সাধারণত এ রোগে আক্রান্তদের ব্যথা কমানোর জন্য পেইন কিলার বা অন্যান্য উপশমকারী ওষুধ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। এছাড়া হরমোনাল থেরাপি (যেমন জন্মনিরোধক) ব্যবহৃত হতে পারে, যা হরমোনের ভারসাম্য স্থির রাখে।

অস্ত্রোপচার : কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষত উপসর্গ খুবই তীব্র হলে অস্ত্রোপচার করা হতে পারে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যুগুলি অপসারণ করা হয়। যদিও, এটি একটি সাময়িক সমাধান, কারণ এর পরও এ রোগ আবার ফিরে আসতে পারে।

প্রজনন চিকিৎসা : এর কারণে গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দিলে, ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) বা অন্যান্য প্রজনন চিকিৎসার পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।

জীবনযাপনে পরিবর্তন : এছাড়া স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ কমানো এন্ডোমেট্রিওসিসের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।

এন্ডোমেট্রিওসিস সচেতনতা মাস (এন্ডোমার্চ)

প্রতি বছরের মার্চজুড়ে পালিত হয় এন্ডোমেট্রিওসিস সচেতনতা মাস বা ‘এন্ডোমার্চ’। বিশ্বব্যাপী এন্ডোমেট্রিওসিস নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে এবং এই রোগের জন্য সমর্থন গড়ে তুলতে কাজ করে এই আন্দোলন।

যেন মানুষ রোগটির লক্ষণ, চিকিৎসা এবং এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারেন। রোগীদের অভিজ্ঞতা নিয়েও এখানে কাজ করা হয়।

শারমিন আব্বাসি বলেন, “ভয় নয়, এ রোগ জয় করতে সচেতনতা জরুরি। আর সেই সচেতনতার জন্যই এন্ডোমার্চ ভীষণ জরুরি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত