একদল সংসদে শপথ নিতে, আরেক দল বিক্ষোভে চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে, সেখানে পরিস্থিতি সামাল দিতে আবার পুলিশের পাহারা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের শপথ অনুষ্ঠানের দিন বুধবার এমন বেসামাল পরিস্থতি দেখা গেল এইচ এম এরশাদের গড়া দলটিতে।
দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ ভোটে বিজয়ী ১১ জন এদিন দুপুরে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়ে এক গুঞ্জনের অবসান ঘটান।
তখন ঢাকার বনানীতে দলটির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে বিক্ষোভ করছিলেন যারা, তাদের মধ্যে ভোটে দাঁড়িয়ে হেরে যাওয়া নেতারাও ছিলেন।
চেয়ারম্যান কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে সরব ছিলেন তারা। কাউন্সিল ডেকে তাদের বাদ দেওয়ার হুমকিও তারা দেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাচন এলেও নানা নাটকীয় ঘটনার জন্ম দেওয়া জাতীয় পার্টিতে ব্যতিক্রম এবারও ছিল না। চেয়ারম্যান কাদেরের সঙ্গে বিরোধের কারণে তার ভাবি দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ভোটেই অংশ নেননি।
জিএম কাদের ভোটের পথে এগোলেও সরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল। পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ২৬টি আসন বাগিয়ে নেন।
তবে ৭ জানুয়ারি ভোটের পর দেখা যায়, সমঝোতার বেশিরভাগ আসনেই হেরেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। এর মধ্যে কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও রয়েছেন।
বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধা দেয়নি। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই হয়েছে লাঙ্গলের পথের কাঁটা। আর আওয়ামী লীগের ছাড় না পাওয়া আসনগুলোতে লাঙল টিকতেই পারেনি।
এই অবস্থায় ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে মঙ্গলবার সকালে জাতীয় পার্টির মহাসচিব চুন্নু ‘কাল শপথ নিচ্ছি না’ বললেও বিকালে নিশ্চিত করা হয়, তারা বুধবার শপথ নেবেন।
সংসদ ভবনে গিয়ে আওয়ামী লীগ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছ থেকে শপথ নেন জাতীয় পার্টির ১১ জন।
দলে বিভেদ নিয়ে তাদের কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি। দলীয় কার্যালয়েও যাননি তারা। জি এম কাদের শুধু সাংবাদিকদের বলেন, তারা সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকতে চান।
এদিকে সকাল ১০টা থেকেই দলটির নেতা-কর্মীরা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে শুরু করেন। দুপুর সাড়ে ১১টায় কার্যালয়ে ঢুকতে গেলে কার্যালয়ের মূল ফটক লাগিয়ে রাখাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা তৈরি হয়।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, “আমরা সুষ্ঠুভাবে আমাদের কথা বলতে চাই। এখানে বাধা দেওয়া, গেট বন্ধ করে রাখা হবে কেন?”
নেতা-কর্মীদের ঢুকতে না দেওয়ার বিষয়ে বনানী থানার ওসি কাজী সাহান হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন,
“তারা তাদের পার্টি অফিসে ঢুকবে, এতে আমাদের বাধা দেওয়ার কিছু নেই। তবে শৃঙ্খলা রেখে তারা ঢুকবে, এটাই প্রত্যাশা।
“আমাদের কাছে বিশৃঙ্খলা ঘটার বিষয়ে কিছু তথ্য থাকলে অবশ্যই আমরা তাদের প্রবেশাধিকার শিথিল করে দেখতে পারি।”
কাদের-চুন্নুকে আল্টিমেটাম
ভেতরে ঢুকতে না পেরে কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলটির ক্ষুব্ধ নেতারা। লিখিত বক্তব্যে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাইদুর রহমান টেপা বলেন, জাতীয় পার্টিকে গঠনতান্ত্রিকভাবে পার্টিতে একজন ভারপ্রাপ্ত অথবা নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিয়োগ করে জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে।
ভোটে বিপর্যয় নিয়ে সাইদুর বলেন, “আমরা আশা করেছিলাম, জাতীয় পার্টিকে এতটা বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেওয়া এবং নির্বাচনে ভরাডুবির দায়িত্ব নিয়ে পার্টির চেয়ারম্যান এবং মহাসচিব পদত্যাগ করে তাদের সম্মান রক্ষা করবেন। কিন্তু সে বোধদয়ও তাদের হয়নি।”
জিএম কাদেরকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “জাতীয় পার্টির যিনি চেয়ারম্যান ছিলেন, তার সাথে প্রার্থী মনোনয়ন প্রশ্নে মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ায় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ নির্বাচন থেকে বিরত ছিলেন। কিন্তু তিনি পার্টির মধ্যে বিভক্তি করতে দেননি।
“অথচ পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের গত চার বছরে তার সাংগঠনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং অদক্ষতার কারণে জাতীয় পার্টিকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছেন। তারই প্রতিফলন ঘটেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।”
‘চরম বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা’র শিকার হয়ে জাতীয় পার্টির দুই শতাধিক প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে ২৬টি আসনে সমঝোতা করে সেখানেও ভরাডুবি হয়েছে মন্তব্য করে সাইদুর বলেন, “আমরা পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মনোভাব জানতে পেরেছি। তারা পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে তাদের পদ থেকে অপসারণ দেখতে চান।”
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, “আমরা আমাদের সকল কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, সহযোগী অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বর্ধিত সভা করব। আমাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমরা আমাদের কাউন্সিল করব।”
ঢাকার একটি আসনে ভোট করে হেরে যাওয়া এই নেতা বলেন, “আমরা শুনেছি চেয়ারম্যান ও মহাসচিব টাকা-পয়সা নিয়েছেন। এর সত্যতা বের করার জন্য আমরা তদন্ত কমিটি করব। তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।”
বিভিন্ন আসনের প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন, তাদের নেতাদের কাছে টাকা এসেছে। কিন্তু তারা তা পাননি।
এবিষয়ে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম জহির সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চেয়ারম্যান ও মহাসচিব নির্বাচনের সময় কারও সাথে যোগা্যোগ করেননি৷ প্রার্থীরা যখন আমাকে ফোন দিয়েছে আর্থিক সাহায্যের জন্য, তখন মহাসচিব শুধু আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেননি।
“আমি যখন চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলি সে আমাকে বলেছে, ‘কোনও টাকা দেওয়া হবে না, ওদের নির্বাচন করতে কে বলেছে?’ এ পরিস্থিতিতে তাদের ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে আজকে জাতীয় পার্টিকে মাসুল দিতে হচ্ছে। সবার কাছে আমরা দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছি।”