সাগরে চা ফেলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী লড়াই শুরু করেছিলেন আমেরিকান বিপ্লবীরা। আড়াইশ বছর পর সেই চা নিয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে কূটনৈতিক ঝড় বইছে।
ব্রিটিশদের প্রিয় পানীয় চা, যা তাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায় ৬ কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যার দেশ যুক্তরাজ্যে প্রতিদিন প্রায় ১০ কোটি কাপ চা পান করা হয়।
সেই ব্রিটিশদের চা ঠিকঠাক উপায়ে তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী মিশেল ফ্রাঙ্কল। তাতে চটেছেন ব্রিটিশরা, তাদের মতে ফ্রাঙ্কলের পরামর্শ আপত্তিকর।
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ব্রিন মাওয়ার কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মিশেল ফ্রাঙ্কল। তিনি বলেন, “এক কাপ ভালো চায়ের জন্য এক চিমটি লবণ যোগ করা দরকার।”
‘স্টিপড : দ্য কেমিস্ট্রি অব টি’ নামে ফ্রাঙ্কলের একটি বইয়ে এই পরামর্শ দেওয়া হয়, যা নিয়েই এত তোলপাড়।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে ফ্রাঙ্কলের পরামর্শ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। ব্রিটিশ টেলিভিশন উপস্থাপক জর্জ উইলসন ফ্রাঙ্কলর পরামর্শকে ‘অদ্ভুত’ বলে অভিহিত করেছেন।
এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ক্ষোভের ঝড় বইছে। অনেকে এমনকি ঠাট্টা করে ফের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার কথাও বলেছেন। ব্রিটিশদের ক্ষোভ প্রশমনে এমনকি যুক্তরাজ্যে মার্কিন দূতাবাসকেও বিবৃতি দিতে হয়েছে।
সোশাল মিডিয়া এক্সে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, “আমাদের বিশেষ সম্পর্কের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিতে পারে এমন কোনও আপত্তিকর প্রস্তাব দেখে আমরা চুপ থাকতে পারি না। আমরা যুক্তরাজ্যের ভালো মানুষদের নিশ্চিত করতে চাই, ব্রিটেনের জাতীয় পানীয় চায়ে লবণ দেওয়ার কল্পনাতীত এই ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নীতি নয় এবং কখনও হবেও না।”
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস আরও জানায়, তারা সঠিক পদ্ধতিতেই চা বানানো অব্যাহত রাখবে। মাইক্রোওয়েভ ওভেন দিয়েই চা বানাবে তারা।
তবে অধ্যাপক ফ্রাঙ্কল বিবিসিকে বলেছেন, “কোনও কূটনৈতিক ঘটনা ঘটানো আমার উদ্দেশ্য ছিল না। ইমেইলেও আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আজ (বুধবার) সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আমি অসংখ্য মেইল পেয়েছি, যার সবই চায়ে লবণ দেওয়ার পরামর্শ নিয়ে।”
চা নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পাড়ের বিতর্ক এবারই প্রথম নয়। ১৭৭৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ ম্যাসাচুসেটসের বোস্টনে বিপ্লবীরা সরকারের বাড়তি করারোপের প্রতিবাদে চা ভর্তি ৩০০ ড্রয়ার সাগরে ছুঁড়ে ফেলে। আর এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমেরিকাজুড়ে বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল।
বইটি প্রকাশের পর যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমেও মিশেলকে তুলোধুনা করা হচ্ছে। দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “যে দেশে টেপের পানি দিয়ে চা বানানো হয় সে দেশের একজন বিজ্ঞানী দাবি করেছেন তিনি নাকি নিখুঁত চা বানানোর রেসিপি খুঁজে পেয়েছেন!”
ডেইলি মেইলের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “যে দেশের মানুষ বরফ দিয়ে চা খায় সেদেশের এক অধ্যাপক নাকি বলেছেন চা নিয়ে তার গবেষণা খাঁটি!”
কী বলেছেন বিজ্ঞানী মিশেল ফ্রাঙ্কল
অধ্যাপক মিশেল আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, চায়ে লবণ দেওয়ার ধারণা অনেক পুরোনো। এমনকি অষ্টম শতকে লেখা চীনের কিছু বইয়েও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। নতুন যা, তা হলো, রসায়নবিদ হিসেবে বিষয়টি আমরা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝতে পারছি।
তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, চায়ে সামান্য পরিমাণে লবণ দিলে তা এর তেতো স্বাদটা কমায়। চা সেদ্ধ হওয়ার সময় এর যে কোষগুলো তেতো স্বাদ ছড়ায় লবণ সেগুলোকে প্রতিরোধ করে। এর জন্য খুব সামান্য পরিমাণ লবণ দিতে হবে, যাতে লবণের কটা স্বাদও বোঝা না যায়।
মিশেল বলেন, “এটা চিনি দেওয়ার মতো ব্যাপার নয়। মানুষ হয়তো ভেবেছে চায়ে লবণ দিলে তো তা কটা হয়ে যাবে। আর এজন্যই তাদের এই ক্ষোভ। কিন্তু আমি বলেছি, এতো সামান্য পরিমাণে লবণ দিতে হবে যাতে লবণের কটা স্বাদটাও টের না পাওয়া যায়।”
অধ্যাপক মিশেল ফ্রাঙ্কল চা-প্রেমী ব্রিটিশদের তার গবেষণাটি খোলামনে পড়ে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করার আহ্বানও জানান। চা নিয়ে তার গবেষণাধর্মী বইটি প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি।
তার মা তাকে দশ বছর বয়সে প্রথম চা পান করানোর পর থেকেই তিনি চা পছন্দ করেন বলে জানান ফ্রাঙ্কল। চায়ে লবণ দেওয়া ছাড়াও আরও কিছু পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। যেমন, টি ব্যাগের পরিবর্তে আলগা পাতা দিয়ে চা বানানো। দুধ দেওয়ার পর ভালোভাবে চামচ দিয়ে নাড়িয়ে মেশানো। একটু হালকা লেবুর রস দেওয়া।
তবে সবচেয়ে বড় যে পরামর্শটি তিনি দিয়েছেন তা হলো, মাইক্রোয়েভ ওভেনে চা না বানানো। তিনি বলেন, মাইক্রোওয়েভে বানানো চা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এর স্বাদও ভালো না। এতে চায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বা রোগ প্রতিরোধী উপাদানগুলোও নষ্ট হয়ে যায়।
যুক্তরাজ্যের মানুষেরা মাইক্রোওয়েভে চা খুব কম বানালেও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষদের এই অভ্যাস রয়েছে। অধ্যাপক ফ্রাঙ্কলও বলেন, চা বানানোয় আমেরিকানদের ভয়ঙ্কর কিছু অভ্যাস রয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তার এই পরামর্শে কান না দিয়ে, মাইক্রোয়েভ ওভেনেই চা বানানোর কথা বলেছে। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের দূতাবাস বলছে, চা শুধু কেটলিতেই বানানো উচিৎ।