গৃহযুদ্ধে এখন কি পতনের দ্বারপ্রান্তে মিয়ানমারের সেনা সরকার? সেই প্রশ্ন এখন বেশ জোরাল। কারণ বহু জাতির দেশটিতে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর এমন ঐক্য আগে কখনও দেখা যায়নি।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফের ক্ষমতা দখলকারী মিয়ানমারের প্রতাপশালী সেনাবাহিনী এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আগে কখনও হয়নি।
তখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সু চির দল এনএলডির সরকারের সমর্থকরা অহিংস বিক্ষোভ শুরু করেছিল। তবে সেনাবাহিনী দমনপীড়ন শুরু করলে কয়েক মাসের মধ্যেই সেই বিক্ষোভ সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়, যা গড়ায় গৃহযুদ্ধে।
ক্ষমতাচ্যুত এনএলডি নেতারা ২০২১ সালের এপ্রিলে সামরিক শাসনবিরোধী শক্তিগুলোকে নিয়ে পাল্টা জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) গঠন করে। এক মাস পরেই এই সরকারের সশস্ত্র সংগঠন পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) গঠন করা হয়।
এরপর সেপ্টেম্বরে পিডিএফ মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দেয়। সেই থেকে প্রায় আড়াই বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে দেশটিতে।
সেনাশাসনবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীসহ দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াইরত জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোও পিডিএফের ডাকে নতুন করে যুদ্ধে নামে।
ফলে মিয়ানমারে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই এক অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছায়। এতে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের সেনা শাসকরা গোটা দেশেই সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে।
আর এই প্রথম দেশটির সংখ্যাগুরু নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী বামাররাও গণতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছে। এই লড়াইয়ের মূল চালিকাশক্তিই হলো বামার তরুণরা।
বামাররা এর আগে আর কখনও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেনি। বামারদের অংশগ্রহণে এই যুদ্ধ জনযুদ্ধের রূপ নিয়েছে। প্রায় ৫০ হাজারের বেশি বামার তরুণ পিপলস ডিফেন্স ফোর্সে যোগ দিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দেশজুড়ে পিডিএফের মোট যোদ্ধার সংখ্যা ৬৫ হাজার থেকে ১ লাখ বলে ধারণা করা হয়।
গণতন্ত্রকামী বামাররা বিদ্রোহী অ-বামার জাতিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও রাজনৈতিক জোট গড়ে তুলেছে। এক ডজনের বেশি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই গণতান্ত্রিক জোটে যোগ দিয়েছে। ফলে এখন প্রায় ৭ লাখ বর্গ কিলোমিটারের দেশটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় গৃহযুদ্ধ চলছে।
কীসের আশায় লড়ছে তারা
পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের নেতৃত্বে বিদ্রোহী বাহিনীগুলো মিয়ানমারের সেনাশাসিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে উল্টে দেওয়ার এবং একটি ফেডারেল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে, যেখানে সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। কম জনসংখ্যার জাতিগোষ্ঠীগুলোকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বা স্বায়ত্তশাসনও দেওয়া হবে।
পিপলস ডিফেন্স ফোর্স তাদের ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট করেই বলেছে, এতদিন ধরে মিয়ানমারে রাষ্ট্র পরিচালানায় বামারদের যে একেচেটিয়া আধিপত্য চলে আসছিল, তার ইতি টানবে তারা। কেন্দ্রীয় সরকারে সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি যারা স্বায়ত্তশাসন চায়, তাদের দাবিও মেনে নেওয়া হবে।
তবে স্বতন্ত্র কোনও নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী যদি মিয়ানমার থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে চায়, তাহলে কী হবে, সে বিষয়ে কিছু বলেনি তারা। অবশ্য মিয়ানমারের কোনও জাতিগোষ্ঠীই এখনও পর্যন্ত স্বাধীনতা ঘোষণার পরিকল্পনার কথা জানায়নি।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বিদ্রোহ শুরু করে। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরও সেই বৈষম্য ঘোচেনি।
স্বাধীনতার পর দেশটির সংখ্যাগুরু বামাররাও বৈষম্য বজায় রাখে। মিয়ানমারের জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশই বামার (বার্মিজ)। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই তাদের একেচেটিয়া আধিপত্য দেশটির সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সরকার ও প্রশাসনের সর্বত্র।
মিয়ানমারের স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা অং সান দেশটির সংখ্যালঘু অ-বামার জাতিগোষ্ঠীগুলোর সক্রিয় সমর্থন চেয়েছিলেন। বিনিময়ে তিনি স্বাধীনতার পর তাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
কিন্তু স্বাধীনতার ছয় মাস আগে জেনারেল অং সান তার কয়েকজন কাউন্সিল সদস্যসহ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ফলে স্বাধীনতার পর প্রতিশ্রুত স্বায়ত্তশাসন পায়নি অ-বামার জাতিগোষ্ঠীগুলো।
এর প্রতিক্রিয়ায় একের পর এক নৃতাত্বিক জাতিগোষ্ঠী বিদ্রোহ করে। এতে আধুনিককালে জন্মের পর কোনও দেশে একটানা বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। গত ৭৬ বছরের প্রায় পুরোটা সময়জুড়েই কোনও না কোনও বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠী দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত চালিয়েছে।
বামাররাও ধরেছে অস্ত্র
স্বাধীনতার পর মাত্র ১৪ বছরের মাথায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা দখল করে নিলে জাতিগত বৈষম্য আরও প্রকট আকার ধারন করে। স্বাধীনতার পর বেসামরিক সরকারের ব্যর্থতায় দেশটির সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণের জন্য ডাকা হয়। ১৯৫৮ সালে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে সেনাবাহিনী দেশটির রাজনীতিতে প্রবেশ করে। কিন্তু তার চার বছরের মাথায় ১৯৬২ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয় সেনাবাহিনী। এরপর থেকে প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশটিতে সেনাশাসন চলছে।
১৯৮০-র দশকের শেষদিকে মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা জেনারেল অং সানের কন্যা অং সান সু চি দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই শুরু করেন। ১৯৮৮ সালের ৮ আগস্টে শুরু হওয়া এক গণবিদ্রোহ নেতৃত্ব দেন তিনি। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলে এই গণবিদ্রোহ, যা ১৯৮৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নতুন এক রক্তক্ষয়ী সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দমন করা হয়।
নতুন সামরিক সরকার ১৯৯০ সালে নির্বাচনের আয়োজন করে। সেই নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ৮১ শতাংশ ভোট পায়। কিন্তু জান্তা নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। সু চিকে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কয়েক দফায় মোট ১৫ বছর গৃহবন্দি ছিলেন সু চি।
সু চিকে বন্দি করা হলেও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য সংগ্রাম চলতে থাকে। আন্তর্জাতিক চাপে ২০১০ সালের শেষদিকে সু চিকে মুক্তি দিয়ে ফের নির্বাচনের আয়োজন করে সেনাবাহিনী। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে একটি আধা-সামরিক ধরনের সরকার মিয়ানমারে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পায়।
তবে সরাসরি সামরিক শাসনের অবসান ঘটলেও দেশটির ক্ষমতার কলকাঠি সেনাবাহিনীর হাতেই থেকে যায়। ফলে টানাপোড়েন অব্যাহত থাকে। ২০১৫ ও ২০২০ সালের নির্বাচনেও অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিশাল বিজয় পায়। এতে সামরিক জান্তা ও জান্তাবিরোধীদের মধ্যে সমঝোতার মধ্য দিয়ে দেশটিতে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
কিন্তু ২০১৭ সালে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা এবং জাতিগত নিধনযজ্ঞের মতো বিভিন্ন ঘটনায় সেই প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনী ফের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে। এনএলডির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত এবং অং সান সু চিকেও আটক করা হয়। দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে সু চিকে ফের ৩৩ বছর কারাদণ্ড দেয় জান্তা। ফলে এবার সংখ্যাগুরু বামাররাও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। এমনকি সেনাবাহিনীতে কর্মরত বামার তরুণরাও পক্ষ ত্যাগ করছে।
লড়াইয়ে কারা কারা
মিয়ানমার বিশাল জাতিগত বৈচিত্র্যের একটি দেশ। দেশটিতে প্রায় ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে। তারা ১০০টিরও বেশি ভাষায় কথা বলে। এই ভাষাগুলো মূলত তিব্বতি-বর্মী ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
প্রশাসনিকভাবে মিয়ানমার ৭টি রাজ্য, ৭টি অঞ্চল ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত (নেপিতো)। রাজ্যগুলো হলো- চিন, কাচিন, কায়াহ (কারেন্নি), কারেন (কায়িন), মোন, রাখাইন ও শান। এই রাজ্যগুলো প্রধানত উচ্চভূমি বা পাহাড়ি অঞ্চল। এই ৭ রাজ্যেই মিয়ানমারের প্রধান সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর বাস।
বাকি ৭টি অঞ্চল হলো- ইরাওয়াদ্দি (ইরাবতী), বাগো, ম্যাগওয়ে, মান্দালয়, সাগাইং, তানিনথারি ও ইয়াঙ্গুন। এগুলো প্রধানত সমভুমি অঞ্চল। এসব অঞ্চলে প্রধানত বামার জাতিগোষ্ঠীর বাস।
সংখ্যালঘু নৃতাত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ হলেও তারা দেশটির অর্ধেক এলাকায় বসবাস করে। তাদের মধ্যে ৬টি রাজ্যই চলমান গৃহযুদ্ধে যোগ দিয়েছে।
মোনরা এখনও এই যুদ্ধে যোগ দেয়নি। ২০১৫ সালে সামরিক জান্তার সঙ্গে করা যুদ্ধবিরতি ভাঙেনি তারা।
সব মিলিয়ে মিয়ানমারে বর্তমানে ৩০টিরও বেশি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয় আছে। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) সঙ্গে আরও যারা সেনা শাসন উৎখাতে লড়ছে তারা কারা ও কী চায় জেনে নেওয়া যাক।
১. বামার পিপলস লিবারশেন আর্মি (বিপিএলএ)
২০২১ সালের এপ্রিলে মং সাংখা নামে এক অ্যাকটিভিস্ট ও কবি প্রতিষ্ঠা করেন বিপিএলএ। এটি মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু জাতিগোষ্ঠী বামারদের একমাত্র সশস্ত্র সংগঠন। সংগঠনটির লক্ষ্য মিয়ানমারের রাষ্ট্র ও সমাজে বামারদের একেচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা। অর্থাৎ, নিজেদের জাতিগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরেছে বিপিএলএ। প্রতিষ্ঠার সময় ১ হাজারের বেশি যোদ্ধা নিয়ে যাত্রা করা সংগঠনটির সেনা সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে।
সংগঠনটি নিজেদের লক্ষ্য হিসেবে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রতি সেনাবাহিনীর ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের অবসান ঘটানো এবং একটি ফেডারেল ডেমোক্রেসি বা যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছে। যেই রাষ্ট্র ও সরকারে দেশটির সব জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে।
গত বছরের অক্টোবরের শেষের দিক থেকে তিনটি বড় জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অপারেশন ১০২৭-এও অংশগ্রহণ করে বিপিএলএ। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সংগঠন তিনটি হলো- তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ)।
গত অক্টোবরের ওই যৌথ আক্রমণই মিয়ানমারে সেনা শাসনের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে। এরপর থেকে দেশজুড়ে বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ হামলার মুখে পতনের শঙ্কায় রয়েছে জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সরকার। একের পর এক শহর ও অঞ্চলের দখল নিচ্ছে বিদ্রোহীদের জোট।
২. আরাকান আর্মি (এএ)
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আরাকান আর্মিতে প্রায় ৩০-৪০ হাজার সৈন্য রয়েছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রাজনৈতিক জোট ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের (ইউএলএ) সশস্ত্র শাখা এটি। তাদের লক্ষ্য মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনে বহু-জাতিগত আরাকানিদের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার ও স্বায়ত্ব শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
রাখাইনের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমরাও আরাকান আর্মিতে রয়েছে। রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিও (আরসা) আরাকান আর্মিকে সমর্থন দেয়। এএ মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনী। সম্প্রতি প্রায় পুরো আরাকানজুড়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথে রয়েছে সংগঠনটি।
৩. তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)
টিএনএলএ মিয়ানমারের চীন সীমান্তবর্তী উত্তরা-পূর্বাঞ্চলীয় শান প্রদেশের পালাউং স্টেট লিবারেশন ফ্রন্টের (পিএসএলএফ) সশস্ত্র শাখা। তায়াং সংখ্যালঘু নৃতাত্বিক জাতিগোষ্ঠীর স্বায়ত্ব শাসনের পাশাপাশি মিয়ানমারে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে টিএনএলএ। সংগঠনটির মতে, তারা মিয়ানমারে একটি প্রকৃত ফেডারেলিজম বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার জন্য লড়াই করছে। তাদের ১০-১৫ হাজার যোদ্ধা রয়েছে।
৪. মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ)
শান রাজ্যের হান ভাষা-ভাষী কোকাং জাতিগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়ছে এমএনডিএএ। তারা প্রায় ২০ বছর ধরে শান প্রদেশের বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকার ২০০৯ সালে তাদের একটি সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে কাজ করার এবং কোকাং অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তারা তা মেনে নেয়নি। এতে গ্রুপটির সঙ্গে জান্তার সেনাবাহিনীর সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। ২০১৯ সালে আরাকান আর্মি ও টিএনএলএ-র সঙ্গে মিলে তারা থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গঠন করে। সংগঠনটির যোদ্ধার সংখ্যা ১০ হাজারের ওপরে। সংগঠনটি মূলত ১৯৮৯ সালে বিলুপ্ত বার্মা কমিউনিস্ট পার্টির (বিসিপি) বা কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মার (সিপিবি) সদস্যদের একটি অংশকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল। ১৯৮৫ সালে চীন মিয়ানমারের কমিউনিস্টদের সহায়তা দেওয়ার নীতি ত্যাগ করলে মাত্র চার বছরের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বার্মা কমিউনিস্ট পার্টিও খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়।
শান প্রদেশে লড়াইরত আরও কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন হলো, পা-ও ন্যাশনাল আর্মি (পিএনএ), লাহু ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (এলডিইউ), পা-ও ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (পিএনএলএ), শান স্টেট আর্মি-নর্থ ও শান স্টেট আর্মি-সাউথ।
শান প্রদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সশস্ত্র সংগঠন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মিও (এনডিএএ) ১৯৮৯ সালে বিলুপ্ত বার্মা কমিউনিস্ট পার্টির একটি অংশকে নিয়ে গড়ে উঠেছে। তবে সংগঠনটি যুদ্ধবিরতিতে রয়েছে।
৫. চিন ন্যাশনাল আর্মি (সিএনএ)
বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের চিন প্রদেশে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করা একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন সিএনএ। এটি ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত চিনাদের রাজনৈতিক সংগঠন চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (সিএনএফ) সামরিক শাখা। সংগঠনটি ২০১২ সালে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে। কিন্তু ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর পুনরায় তারা অস্ত্র ধরেছে। নিজেরা যুদ্ধ করার পাশাপাশি সিএনএ প্রদেশটিতে নবগঠিত প্রতিরোধ বাহিনীগুলোকেও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর চিন প্রদেশে আরও দুটি সশস্ত্র সংগঠন তৈরি হয়— চিন ন্যাশানাল ডিফেন্স ফোর্স (সিএনডিএফ) ও চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ)। গত বছরের অক্টোবরের শেষের দিক থেকে তাদের জোট ভারত সীমান্তের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সামরিক পোস্ট দখল করে এবং একাধিক শহর ও গ্রাম থেকে সামরিক বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
৬. কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএনএলএ)
এটি কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের (কেএনইউ) সশস্ত্র শাখা। কারেন জাতিগোষ্ঠীর স্বায়ত্বশাসনের জন্য লড়ছে সংগঠনটি। ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর তারা যুদ্ধবিরতি বাতিল করে ফের অস্ত্র ধরে। বর্তমানে সংগঠনটির প্রায় ২৭ থেকে ৩০ হাজারের বেশি যোদ্ধা রয়েছে। কেএনইউর আরেকটি সশস্ত্র উইং হলো কারেন ন্যাশনাল ডিফেন্স অর্গানাইজেশন (কেএনডিও)। ১৯৪৭ সাল থেকেই কারেনরা স্বায়ত্ব শাসনের দাবিতে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে।
৭. কারেন্নি ন্যাশনালিটিজ ডিফেন্স ফোর্সেস (কেএনডিএফ)
মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্ব কারেন্নি প্রদেশের (যা কায়াহ রাজ্য নামেও পরিচিত) সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর একটি জোট কারেন্নি ন্যাশনালিটিজ ডিফেন্স ফোর্সেস (কেএনডিএফ)। ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর প্রতিষ্ঠিত হয় এই জোট। কারেন্নিরা ১৯৪৯ সাল থেকেই স্বায়ত্বশাসনের জন্য লড়ছে। কারেন্নি ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টির (কেএনপিপি) সামরিক শাখা কারেন্নি আর্মি (কেএ) এই লড়াই শুরু করে। ১৯৭৮ সালে তাদের পাশাপাশি যুদ্ধে যোগ দেয় কমিউনিস্ট সংগঠন কারেন্নি ন্যাশনাল পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (কেএনপিএলএফ)।
প্রায় এক দশক ধরে শান্তিতে থাকা প্রদেশটি ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর ফের বিদ্রোহ করে। যুদ্ধের ময়দানে বেশ সাফল্য দেখাচ্ছে কেএনডিএফ। জান্তার বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তারা। গত নভেম্বরে নতুন অভিযান শুরু করার পর তারা প্রদেশটির রাজধানীতেও হামলা শুরু করেছে এবং পুরো প্রদেশকে সামরিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার কাছাকাছি চলে এসেছে।
৮. পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)
১৯৮৯ সালে বিলুপ্ত বার্মা কমিউনিস্ট পার্টি (বিসিপি) বা কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মার (সিপিবি) সদস্যরা ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের পর পুনরায় সংগঠিত হয়ে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) গঠন করে যুদ্ধ শুরু করেছে। মিয়ানমারের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি অফ বার্মা (সিপিবি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালে।
৯. কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ)
আরাকান আর্মি (এএ) ও কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির (কেএনএলএ) পর মিয়ানমারের তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগত বিদ্রোহী সংগঠন কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ)। এটি কাচিন ইনডিপেনডেন্স অর্গানাইজেশনের (কেআইও) সামরিক শাখা। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ কাচিন ভিত্তিক এই সংগঠন ১৯৬১ সাল থেকে কাচিন নৃতাত্বিক জাতিগোষ্ঠীর স্বায়ত্বশাসনের জন্য লড়ছে।
কাচিনরা মূলত ছয়টি উপজাতির একটি জোট যাদের জন্মভূমি চীনের ইউনান, উত্তর-পূর্ব ভারত ও মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যজুড়ে বিস্তৃত। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর কাচিনরাও তাদের যুদ্ধ তৎপরতা বাড়ায় এবং ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ১০টির বেশি ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স, এশিয়া টাইমস, দ্য ইরাবতী, ইস্ট এশিয়া ফোরাম, মায়ানমার নাউ, সিএফআর