শীতের তীব্রতা কমে যখন প্রকৃতিতে লাগে বসন্তের ছোঁয়া, তখন নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে মন হারিয়ে যেতে চায় রঙিন কোনও গন্তব্যে। বাংলা বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে বসন্তের প্রথম দিনটি আবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও। কনকনে শীত বিদায় নিলেও শীতল একটা ভাব থেকেই যায় চারদিকে। এ সময় ঘুরতে যেতে কার না ভালো লাগে? আবার সেটা যদি হয় প্রিয় মানুষের সাথে কোন রোমান্টিক গন্তব্যে, তাহলে তো সোনায়-সোহাগা। বসন্তের কিছু গন্তব্য নিয়ে আজকের আয়োজন।
শিমুল বাগান
সুনামগঞ্জের জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগানকে বলা যায় ভালবাসার দিবসে দেশের শীর্ষ গন্তব্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে ফাল্গুনের প্রথমদিকেই, মানে ১৪ ফেব্রুয়ারির আশেপাশেই এ বাগানের বেশিরভাগ ফুল ফোটে। শত শত শিমুল গাছের রক্ত লাল ফুল যাদুকাটা নদী আর পটভূমিতে পাহাড় মিলে এ বাগানকে যেন ভালবাসার তীর্থস্থান বানিয়ে দেয়। বাগানে পড়ে থাকা ফুলের মালা দিয়ে ভালোবাসার মানুষকেও রাঙিয়ে দিতে পারেন এখানে।
সেন্ট মার্টিনস
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের এ দ্বীপটিতে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে সময়টা এখনই। আর মাত্র এক মাস পরে বন্ধ হয়ে যাবে জাহাজ চলাচল। তাই সম্ভব হলে এ বসন্তেই ঘুরে আসুন দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনস থেকে। নীল জল, সাদা বালির সৈকত, নারিকেল আর কেয়াবনে ঘেরা দ্বীপটি কার না ভালো লাগে। পশ্চিম সৈকতের কোন প্রবাল পাথরের উপরে বসে সূর্যাস্ত দেখে, আর সমুদ্রে স্বচ্ছ পানিতে ডোবাডুবি করে সময়টা ভালোই কাটবে।
শ্রীমঙ্গল
সবুজ চা বাগানে দিয়ে ঢাকা ছোট ছোট পাহাড়ের মাঝখানে পায়ে চলা মাটির রাস্তায় প্রিয় মানুষের হাত ধরে হাঁটার রোমান্টিক যে দৃশ্য কল্পনায় আসে সেটা বাস্তবায়ন করার মতো জায়গা শ্রীমঙ্গল। এ সময়টা গাছের নতুন পাতা প্রকৃতিকে যেনো আরো সুন্দর করে তুলে। শুধু চা বাগান নয়, শ্রীমঙ্গলের পাশে রয়েছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান যার বনের মধ্যে রয়েছে চমৎকার সব ট্রেইল। আর শহরের বাইরে রাঁধানগর এলাকায় রয়েছে সুন্দর সুন্দর সব রিসোর্ট ও ইকো কটেজ।
গদখালি
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি যেন একটি ফুলের রাজ্য। এখানে মাঠের পর মাঠ দেশি-বিদেশি ফুলে ভর্তি থাকে। রঙ-বেরঙের জারবেরা, গ্লাডিওলাস, গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা ফুলে ভরা মাঠগুলো যেন রূপকথার ভালোবাসার রাজ্য। খুব সকালে গদখালিতে বসে দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি ফুলের বাজার। আর পানিসারার গ্রামগুলোতে ফুলের মাঠের পাশে মনের ইচ্ছেমতো ফুলও কিনতে পারবেন। অবশ্য সবচেয়ে বেশি ফুল তুলে বিক্রির জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় ১৪ ফেব্রুয়ারির আগেই, তাই ওখানে বেড়াতে গেলে এর আগে যাওয়াই ভালো।
ঢাংমারী
সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে ঢাংমারী খাল। খুলনার দাকোপ উপজেলার এ খালের পাশে গড়ে উঠেছে চমৎকার সব ইকো রিসোর্ট। এ বসন্তের শুরুতে শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে এখানকার কোন রিসোর্টে প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে উপভোগ করতে পারেন পাখির কলতান, হরিনের ছুটে চলা অথবা খালের পানিতে লুকোচুরি খেরা ইরাবতী ডলফিনের জলকেলি। আর মন চাইলে বৈঠার নৌকা নিয়ে নিঃশব্দে ঢুকে পড়তে পারেন সুন্দরবনের কোন খালে।
সাজেক
বর্তমান সময়ের যুগলদের অন্যতম পছন্দের জায়গা সাজেক। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত সাজেক যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৮০০ফিট উচ্চতার এ গ্রামে রয়েছে অনেক সুন্দর সুন্দর কটেজ। কোন কোন দিন মেঘ এসে আশ্রয় নেয় রিসোর্টের বারান্দায়। আবার কোন দিন পুরো সাজেক মেঘে ঢাকা পড়ে তৈরী করে এক অপার্থিব দৃশ্য। চাইলে হেঁটে ঘুরে আসতে পারেন কাছের কংলাক পাড়ায়।
কক্সবাজার
পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার অনেক আগে থেকেই এদেশের যুগলদের অন্যতম পছন্দের গন্তব্য। যত বারই যাওয়া হোক, এর আবেদন যেন কমেনা। শীতের শেষে এ সময়টা সমুদ্রে পানি অনেকটা নীলাভ বর্ণ ধারণ করে, আর মৃদু শীত সমুদ্রের বাতাসে মিলে তৈরি করে আনন্দময় পরিবেশ। তাই এসময়টা কক্সবাজারে ভিড় লেগেই থাকে। আর একটু নিরিবিলি চাইলে কক্সবাজার শহর ছাড়িয়ে চলে যেতে পারেন ইনানি সৈকতের দিকে কোন নির্জন সৈকতে।
কাপ্তাই
চট্টগ্রাম শহরের অদূরে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই যে কারো জন্যই দারুণ একটি গন্তব্য। কর্ণফুলী নদীর এ অংশটি চট্টগ্রামের অংশের চেয়ে একেবারে আলাদা। নদীর দুপাড়ের পাহাড় ঘেরা এ অংশটি এ সময়টাতে নীলাভ সবুজ বর্ণ ধারণ করে। কায়াকিংয়ের জন্য নদীর স্থির পানি, আর পাহাড়ের পাদদেশে দারুণ সব কটেজ ও ক্যাম্পসাইট মিলে কাপ্তাই দিতে পারে স্মরণীয় ভ্রমণের স্মৃতি। আর কাপ্তাই কিন্তু মাছের জন্যও খুব বিখ্যাত, চেখে দেখতে পারেন সেখানকার দেশিয় প্রজাতির মাছের স্বাদ।
সিলেট
দেশের অন্য সব শহর থেকে সিলেট একটু আলাদাই। বর্ষার জন্য বেশি জনপ্রিয় হলেও এসময়টাই সিলেটের কিছু জায়গায় অসাধারণ সুন্দর হয়ে উঠে, যেটা বছরের অন্য সময় দেখা সম্ভব নয়। শীতের শেষে চলে যেতে পারেন জাফলংয়ে পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলের মিতালি দেখার জন্য। ফেরার সময় ঘুরে আসতে পারেন মেঘালয়ের ঝর্ণা থেকে আসা নীল পানির অপূর্ব ‘লালা খাল’ থেকেও। শহরের কাছের খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানেও একটু ঢুঁ মেরে আসতে পারেন।
বান্দরবান
পাহাড়ি এ শহরের আকর্ষণ সব সময় থেকে যাবে। নানা ধরণের নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে আজকাল বান্দরবানের বেশির ভাগ জায়গাও যাওয়া কঠিন হলেও এখনো দেখার ও থাকার জন্য অনেক জায়গা রয়েছে। বান্দরবান শহর থেকে একটু দূরে সাংগু নদীর অববাহিকায় কোন রিসোর্টে কাটাতে পারেন রোমান্টিক রাত। আর একটু অ্যাডভেঞ্চারাস হলে ঘুরে আসতে পারেন একদিনের ট্রিপে দেবতাখুমে ভেলায় ভাসতে।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাকোত্তর শেষ করে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক এনজিওতে কর্মরত আছেন। ঘোরাঘুরি ও লেখালেখি দুটোই করেন শখে।