“আমি রিকশা চালাই ভাই। চুরি-চামারি তো করি না। কিন্তু যারা চুরি করে, চাঁদাবাজি করে তাদের তো কেউ কিছু করে না। আমাদের ওপরই যত জুলুম হয়। আমরা গরীব মানুষ হওয়াতে আমাদের নিয়ে কাজের আলাপ কেউ করে না।”
এভাবেই সকাল-সন্ধ্যার কাছে আক্ষেপ করছিলেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক সুমন মৃধা। তিনি থাকেন হাজারিবাগ এলাকায়, সেই এলাকায়ই রিকশা চালান। কার্ড ও টোকেন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হবে শুনে রবিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এসেছিলেন মাঝবয়সী এই ব্যক্তি।
সকাল সন্ধ্যাকে সুমন মৃধা আরও বলেন, “ভাই আমাদের কোনও নিয়ম নাই। এলাকায় এলাকায় কার্ড-টোকেন ব্যবসায়ীরা আছেন। তাদের মাসপ্রতি টাকা দিতে হয়। টাকা দিলে আমাদের রিকশা ধরবে না, আর টাকা না দিলে আমাদের রিকশা পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দিবে।”
সুমন মৃধার ভাষ্যমতে, মোহাম্মদপুর-হাজারীবাগ এলাকায় মাসে রিকশাপ্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা দিতে হয়। এই টাকা ভাগ করে নেয় থানা পুলিশ ও সরকারি দলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
‘কার্ড না থাকলেই পুলিশ ধরে’
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে রবিবারের এই বিক্ষোভে আসা আরও কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
তারাও অভিযোগ করে জানান, ঢাকা শহরের প্রত্যেক এলাকাতেই চলছে কার্ডের রমরমা ব্যবসা। খিলগাঁও, নন্দীপাড়া, যাত্রাবাড়ী, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ,পল্লবীসহ ঢাকায় প্রায় প্রত্যেক এলাকাতেই রিকশাচালকদের মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। কার্ডগুলো রিকশার পেছনে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ কাজ তদারিক করেন স্থানীয় নেতারা, টাকা লেনদেন হয় তাদের মাধ্যমে। যে রিকশায় এই কার্ড থাকে সে রিকশা ধরে না পুলিশ; না থাকলেই ধরে।
শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, সারা দেশেই এ ধরনের রিকশা চলছে বলেও জানান এসব রিকশাচালক।
‘নীতিমালা না থাকায় মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি’
পুলিশের হিসাবে ঢাকাসহ সারা দেশে ৬০ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আছে।
রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নাদিমের অভিযোগ নীতিমালা না থাকায় এসব অটোরিকশা থেকে মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এই সেক্টরে কোনও নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। আমরা একটি সঠিক নীতিমালা চাই। কারণ এই নীতিমালা না থাকার কারণে এখানে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে।
“সরকার সঠিক নীতিমালা করে সেটার অধীনে লাইসেন্স ইস্যু করলে তো সরকারই রাজস্ব পাবে। রিকশাচালকরা তার জীবিকার সুরক্ষার জন্য সরকারকে তখন ট্যাক্স দেবে- এতে কোনো সমস্যা হবে না। চাঁদাবাজদের হাতে নির্যাতনের শিকার হতে চায় না রিকাশাচালকরা।”
লালবাগের এক দোকানে রিকশায় ইঞ্জিন সংযোগ ও মেরামতের কাজে জড়িত আব্দুল হাকিম মাইজভান্ডারি। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “লাখ লাখ মানুষ আর তার পরিবার এই রিকশার ওপর নির্ভরশীল। যারা রিকশা চালায় শুধু তারা না, এরসঙ্গে আরও অনেক মানুষ জড়িয়ে আছে। এত মানুষের পেশার একটা নিরাপত্তা চাই আমরা।”
সরকার তার মতো গরীব মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষায় ‘কিছু একটা করবে’ সেই আশায় আছেন ৬০ বছর পেরুনো আব্দুল হাকিম।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদেও ব্যাটারিচালিত এই রিকশা নিয়ে আলোচনা হয়। স্থানীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ব্যাটারিচালিত এসব অটোরিকশাকে ‘বাংলার টেসলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বিদ্যুচ্চালিত যানবাহনকে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব উল্লেখ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে এটিকে উৎসাহিত করার কথাও বলেছেন তিনি।
বিভিন্ন সময় এসব ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগ উঠেছে। সে অভিযোগেরও উত্তর দেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “এতে খরচ কম, এগুলো পরিবেশবান্ধব। বাংলাদেশের পরিবহন সেক্টর ১৮ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। তবে অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়টি উদ্বেগের। আমরা এটা নিয়ে চিন্তিত। কোথাও অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় কিনা- সে বিষয়ে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো নজরে রাখছে। বেশিরভাগই এখন অবৈধভাবে বিদ্যুৎ না নিয়ে মিটারের মাধ্যমে নিচ্ছে।”
আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন দাবি
ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচলের জন্য সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশ আছে ২০২২ সালে। ওই আদেশে বলা হয়, একমাত্র মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত এসব ফ্রি হুইলার চলাচল করতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গ টেনে রিকশা শ্রমিকদের সংগঠনটির নেতা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, “আদালতের এ রায় অনুযায়ীই যদি চলে তাহলে তো অলি-গলিতে চলতে কোনও সমস্যা নেই। শুধু মেইন রোডে উঠলে সমস্যা। কিন্তু আমাদের তো তাও চলতে দেওয়া হচ্ছে না। আদালত রায় দেয়, তাও মানাইতে আমাদের আন্দোলন করতে হয়। তাহলে আদালতের রায় দিয়ে কী লাভ হয়?”
ফিটনেস ঠিক করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বৈধতা দেওয়ার কাজ প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
তিনি বলেছিলেন, “ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আমরা বুয়েটকে তিন কোটি টাকার মতো দিয়েছিলাম। তারা হাইড্রলিক ব্রেক, ব্যাকলাইটসহ একটা স্ট্রাকচার, ডিজাইন দাঁড় করিয়েছে। চলমান অটোরিকশাগুলো কীভাবে সচল রাখা যায়, আবার নতুনগুলো কীভাবে করা যায়- এসব নিয়ে কাজ হয়েছে।”
এ কাজের অগ্রগতি জানতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএর এক পরিচালক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি কোনও নির্দেশনা আসেনি। নির্দেশনা আসলে আমরা সেই মোতাবেক কাজ করব।”
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হকের সঙ্গে কথা হয়েছে সকাল সন্ধ্যার।
বিআরটিএর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “অবশ্যই নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের বিআরটিএ নিজেই সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণ তৈরি করে। তারপর সবার সহায়তা চান, মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির কথা বলেন।”
সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবেই সড়ক বেহাল মন্তব্য করে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক এই পরিচালক বলেন, “নীতিমালা কীভাবে হবে, তা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। প্রথমেই এসব রিকশার ব্যাটারি খুচরা পর্যায়ে বিক্রি বন্ধ করতে হবে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে ব্যাটারি সরবরাহ করতে হবে।
“এসব উদ্যোগ নেওয়ার পর আলোচনা হতে হবে কোন ধরনের ব্যাটারি আমরা ব্যবহার করব, কোন রাস্তায় এটি চলতে পারবে, এর গতিসীমা কত হবে? এভাবে ঠিক ঠাক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই নীতিমালা তৈরি হওয়া উচিত।”
দুর্ঘটনা কমাতে শহর অঞ্চলে ছোট যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
ড. এম শামসুল হক বলেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, শহর এলাকায় আপনি যত ছোট যানবাহন চলতে দিবেন দুর্ঘটনা তত ঘটবেই। রাস্তায় যানবাহনের গড় গতি কমবেই। ফলে, সরকারি পর্যায় থেকে এসব যানবাহন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা পর্যন্তই নামতে দেওয়ার নিয়ম থাকতে হবে।”
গণপরিবহন হিসেবে বাসের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি বলেন সকাল সন্ধ্যাকে।
“গণপরিবহন হিসেবে বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। মানুষের জন্য চলাচল সহজ করতে হবে। এদিকে সরকারের বেশি মনোযোগ দিতে হবে।”
বিশ্ব বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের গণপরিবহন খাতকেও এদিকে নজর দিতে হবে বলে মনে করে বুয়েটের এই অধ্যাপক।
“বৈদ্যুতিক যুগে পৃথিবী ঢুকে গেছে। আমরা এর বাইরে থাকতে পারি না। আমাদের এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কিন্তু তাই বলে ছোট যানবাহনকে বৈদ্যুতিক বানানোর আগে উচিত বড় যানবাহন, যেসবে মানুষ বেশি উঠতে পারে যেসব যানবাহনকে বৈদ্যুতিক করা। না হলে একটি স্মার্ট শহর কোনওদিনই বানানো সম্ভব হবে না”, বলেন তিনি।