রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যে ইউক্রেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তথ্য-প্রযুক্তিগুলোর এআই তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক যুদ্ধের পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে। মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, গুগল, স্টার লিঙ্ক, প্যালান্টির টেকনোলজিস ও ক্লিয়ার ভিউর মতো টেক জায়ান্টরা যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তার পাশাপাশি ভবিষ্যত যুদ্ধপ্রযুক্তিগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়ে নিচ্ছে।
ইউক্রেনও বিষয়টিকে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। এর মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালি করার স্বপ্ন দেখছে দেশটি। ইউক্রেনের ডিজিটাল রুপান্তর মন্ত্রী মাইখাইলো ফেদোরভ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালি সাময়ীকি টাইমের জাতীয় নিরাপত্তা, রাজনীতি ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিনিধি ভেরা বার্গেনগ্রুয়েনকে বলেছেন, “প্রযুক্তি খাত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির প্রধান ইঞ্জিন।”
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র তিন মাস পরই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০২২ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের ডেটা- বিশ্লেষণ ফার্ম প্যালান্টির টোকনোলজিসের সিইও অ্যালেক্স কার্প দেখা করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদোমির জেলেনস্কির সঙ্গে। রাশিয়ার হামলা শুরুর পর পশ্চিমা কোনও শীর্ষ তথ্য-প্রযুক্তি কোম্পানির সিইও হিসেবে তিনিই প্রথম ইউক্রেনে যান। ওই বৈঠকেই কার্প কিয়েভে অফিস খোলার এবং ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় সহযোগিতার জন্য প্যালান্টিরের ডেটা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার মোতায়েনের প্রস্তাব দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহীদের তুলনায় তিনি একটু ভিন্ন ধরনের মানুষ। ৫৬ বছর বয়সী ধূসর কোকড়া চুলের কার্পকে দেখতে একজন পাগলাটে বিজ্ঞানীর মতো মনে হয়। জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি করা কার্প বিখ্যাত সমাজ তাত্ত্বিক জার্গেন হ্যাবারমাসের ছাত্র ছিলেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আইনের ডিগ্রি নেন। সেখানেই বিতর্কিত ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট (উদ্যোগ পুঁজিবাদী) এবং প্যালান্টিরের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েলের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়।
প্যালান্টিরে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর বিনিয়োগও রয়েছে। ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই), এফবিআই, প্রতিরক্ষা বিভাগসহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে ডেটা-বিশ্লেষণ সফটওয়্যার সরবরাহ করে নিজেদের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে প্যালান্টির। যুক্তরাষ্ট্রের একজন জাতীয়-নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং কার্পের উপদেষ্টা জ্যাকব হেলবার্গ বলেন, “প্যালান্টির হলো ২১ শতকের এআই অস্ত্র ব্যবসায়ী।”
যাইহোক, প্যালান্টিরের প্রস্তাবটি লুফে নেয় ইউক্রেন। দেশটি এই প্রস্তাবকে নিজেদের প্রযুক্তি খাতের উন্নতি সাধনের একটি সুযোগ হিসেবে নেয়। শুধু তাই না, ইউক্রেনের ডিজিটাল রুপান্তর মন্ত্রী মাইখাইলো ফেদোরভ ও তার সহকারীরা ইউরোপ থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি পর্যন্ত ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রকে সর্বাধুনিক সামরিক প্রযুক্তির পরীক্ষাগার হিসেবে বাজারজাত করা শুরু করেন। ফেদোরভ বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় মিশন হলো ইউক্রেনকে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিগুলোর গবেষণা ও উন্নয়ন ল্যাবে পরিণত করা।”
হামলার টার্গেট নির্ধারণ করে দেয় প্যালান্টির
বর্তমানে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা, অর্থ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ অর্ধ ডজনেরও বেশি সংস্থা প্যালান্টিরের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। প্যালান্টিরের এআই সফটওয়্যার স্যাটেলাইট ইমেজ, ওপেন-সোর্স ডেটা, ড্রোন ফুটেজ ও যুদ্ধের ময়দান থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে দিক নির্দেশনা দেয়।
কার্প বলেন, “ইউক্রেনের সেনাদের বেশিরভাগ হামলার টার্গেট নির্ধারণ করে দেয় প্যালান্টির।” ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা জানান, যুদ্ধক্ষেত্রে গোয়েন্দাগিরি ছাড়াও যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ, ল্যান্ড মাইন পরিষ্কার করা, বাস্তুচ্যুত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ও দুর্নীতির মূলোৎপাটনের মতো বিভিন্ন প্রকল্পেও কোম্পানিটির ডেটা বিশ্লেষণ সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্যালান্টির ছাড়াও মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, গুগল ও স্টার-লিঙ্ক এর মতো টেক জায়ান্টরাও ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাইবার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ক্লাউডে স্থানান্তরিত করতে এবং দেশটিকে সংযুক্ত রাখতে কাজ করেছে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় কয়েক শত মিলিয়ন ডলারও বিনিয়োগ করেছে কোম্পানিটি।
যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত ফেসিয়াল-রিকগনিশন কোম্পানি ক্লিয়ারভিউ এআই দেড় হাজারেরও বেশি ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাকে তাদের চেহারা সনাক্তকরন সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। সেগুলো ব্যবহার করে তারা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রাশিয়ান সেনা এবং তাদের ইউক্রেনীয় সহযোগীদের সনাক্ত করছে। এছাড়া ছোট কিছু আমেরিকান এবং ইউরোপীয় কোম্পানিও ইউক্রেনকে স্বচালিত ড্রোন সরবরাহ করছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে এক নতুন ধরনের পরীক্ষা
ধনুক থেকে শুরু করে ইন্টারনেট পর্যন্ত মানবেতিহাসে যুদ্ধের মধ্যে সবসময়ই নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়েছে। আধুনিক কালের বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পারমাণবিক বোমার মতো অস্ত্র তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে টেক জায়ান্টগুলো ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর প্রতিটি ব্যাটালিয়নের সঙ্গে একজন করে সফটওয়্যার প্রকৌশলী নিয়োগ করে যুদ্ধক্ষেত্রে এআইয়ের ব্যবহার নিয়ে এক নতুন ধরণের পরীক্ষা চালাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মার্ক মিলি গত বছর ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “যুদ্ধের চরিত্রে ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক পরিবর্তন ঘটছে ইউক্রেনে।”
তবে অনেকে এই দাবির বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এআই প্রযুক্তি দিয়েও রাশিয়াকে ঠেকাতে পারছে না ইউক্রেন। এর জবাবে ইউক্রেন ও টেক জায়ান্টরা বলছে, তারা একটি দীর্ঘমেয়াদি খেলা খেলছে। ইউক্রেনকে তারা ভবিষ্যতের একটি যুদ্ধ ল্যাব হিসেবে তৈরি করছে।
ফেদোরভ বলেন, “নতুন প্রযুক্তির জন্য ইউক্রেন সর্বোত্তম পরীক্ষার ক্ষেত্র। কারণ এখানে বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতিতে তাদের পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে যেভাবে কোনও অস্ত্রের পরীক্ষা চালানো সম্ভব তা অন্য কোথাও সম্ভব না।”
এআই যুদ্ধাস্ত্র ঘিরে আশঙ্কা
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এর ফলে টেক জায়ান্টদের সব কিছুর উর্ধ্বে শক্তিশালি হয়ে উঠার এবং এসব নতুন প্রযুক্তি শত্রুদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন।
জর্জটাউনের সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড এমার্জিং টেকনোলজির রিটা কোনেভ বলেছেন, “এভাবে এআই প্রযুক্তির প্রসারণ ঝুঁকিপূর্ণ। ইউক্রেনে সক্রিয় থাকা টেক জায়ান্টরা হয়তো এখন বলছে যে, তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয়-নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু ভবিষ্যতে তারা যদি তা থেকে সরে যায় তখন কী হবে? এরপর কী হবে?”
প্যালান্টিরের সফটওয়্যার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খুব সহজেই বিশাল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করতে পারে, যার জন্য হয়তো হাজার হাজার মানুষ লাগত। ড্রোন, স্যাটেলাইট ও মাটিতে থাকা ইউক্রেনীয় সেনাদের কাছ থেকে এবং মেঘ ভেদ করে দেখতে সক্ষম রাডার ও শত্রুপক্ষের সেনাদের গতিবিধিসহ গোলাবারুদ সনাক্ত করতে সক্ষম থার্মাল ছবি থেকে সংগ্রহ করা তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে প্যালান্টিরের সফটওয়্যার।
এরপর এআই-চালিত মডেলগুলো ইউক্রেনের সেনাদের শত্রুদের ওপর হামলা চালানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর লক্ষ্যবস্তু ও অবস্থানগুলো দেখিয়ে দেয়। প্যালান্টির জানায়, এআই মডেলগুলো প্রতিটি হামলার সঙ্গে সঙ্গে শেখার মাধ্যমে নিজেদেরও উন্নত করে নেয়। প্যালান্টিরের সফটওয়্যার ব্যবহার করে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী যেভাবে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করছে তাকে একটি ডিজিটাল ‘কিল চেইন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন অ্যালেক্স কার্প।
সুদুরপ্রসারী লক্ষ্য প্যালান্টিরের
প্যালান্টির ইউক্রেনের কাছ থেকে কোনও পয়সা নেয়নি। তাদের লক্ষ্য আরও সুদুরপ্রসারী। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে কয়েক বছর ধরে প্যালান্টির একটি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকারী সংস্থা হিসেবেও কাজ করেছে।
বার্নি ম্যাডফের আর্থিক জালিয়াতি উন্মোচন, তিব্বতের নেতা দালাই লামার কম্পিউটারে ইনস্টল করা চীনা স্পাইওয়্যার সরানো এবং ওসামা বিন লাদেনের অবস্থান খুঁজে বের করার মতো কাজেও প্যালান্টিরের সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে বলে কথিত আছে। তবে কোম্পানিটি এই বিষয়ে মুখ খোলেনি।
এরপর জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের সঙ্গে কাজ করাসহ কোভিড-১৯ টিকা উৎপাদন ও বিতরণের খবরাখবর রাখতেও তাদের সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে। সরকারের গোয়েন্দা নজরদারিতেও প্যালান্টিরের সফটওয়্যার ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
অ্যালেক্স কার্পও বিষয়টি অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করার জন্য তিনি নৈতিকভাবে দায় বোধ করেন। আর ইউক্রেন যুদ্ধ তাকে সেই মিশন বাস্তবায়নের সুযোগ এনে দিয়েছে।
প্রযুক্তি খাতকে অর্থনীতির চালিকা শক্তি করতে চায় ইউক্রেন
ইউক্রেনের ডিজিটাল রুপান্তর মন্ত্রী মিখাইলো ফেদোরোভ গত ১৮ মাস ধরে টেক জায়ান্টদেরসহ বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য সম্মেলনে একটি বার্তাই দিয়ে চলেছেন— ব্যবসার জন্য ইউক্রেনের দরজা পুরোপুরি খোলা রয়েছে।
যুদ্ধের প্রথমদিকে ইউক্রেন যে কোনও ধরনের সাহায্যই গ্রহণ করেছে। দেশটি মাইক্রোসফট, অ্যামাজন ও গুগল থেকে সাইবার ও ক্লাউড পরিষেবা নেয়; ইলন মাস্ক দেয় স্টারলিঙ্ক টার্মিনাল; ক্লিয়ারভিউ এআই থেকে পায় ফেসিয়াল-রিকগনিশন সফটওয়্যার; এছাড়া বড় বড় প্রতিরক্ষা কোম্পানি ও স্টার্টআপের কাছ থেকে পরীক্ষামূলক ড্রোন, ক্যামেরা ও জ্যামিং কিটও পায়।
গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো রক্ষা এবং রাশিয়ার সাইবার আক্রমণ মোকাবেলায় ফেদোরভ ৪ লাখ স্বেচ্ছাসেবক হ্যাকারের একটি ‘আইটি আর্মি’ গড়ে তুলেছেন।
ইউক্রেন চায় এমন একটি প্রযুক্তি খাত তৈরি করতে যা কেবল যুদ্ধে জয়ই এনে দেবে না বরং যুদ্ধের পর দেশটির অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবেও কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে তারা প্রযুক্তির হটবেড ইসরায়েলকে মডেল হিসেবে নিয়েছে।
বিভিন্ন আমেরিকান কম্পানিতে কর্মরত ইউক্রেনের ৩ লাখ প্রযুক্তি কর্মীও নিজ দেশে সামরিক স্টার্টআপের সংখ্যা বাড়াতে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগকারীরা ইউক্রেনীয় স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগের জন্য ব্লু ও ইয়েলো হেরিটেজ ফান্ড চালু করেছে।
ইউরোপের সিলিকন ভ্যালি
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে অদূরে সিলিকন ভ্যালির আদলে ইউনিট সিটি নামে একটি হাই-টেক ‘ইনোভেশন পার্ক’ তৈরি করা হয়েছে। একটি পুরানো সোভিয়েত কারখানার জায়গায় অত্যাধুনিক সব অফিসভবন তৈরি করা হয়েছে সেখানে। ইউক্রেনের প্রযুক্তি শিল্পকে ইউরোপের প্রধান উদ্ভাবন কেন্দ্রে পরিণত করার প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু এই ইউনিট সিটি।
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকর্তারা ইউনিট সিটি পরিদর্শন করেছেন। ইথেরিয়াম ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্লকচেইনের স্রষ্টা ভিটালিক বুটেরিন-এর মতো প্রযুক্তি নির্বাহীরা ইউনিট সিটিতে গিয়েছেন। জার্মানির ড্রোন উৎপাদক কোয়ান্টাম সিস্টেম, জাপানের টেক জায়ান্ট রাকুতেন ও তুরস্কের ড্রোন নির্মাতা বায়কার এর মতো শীর্ষ কয়েকটি প্রযুক্তি কোম্পানি ইতিমধ্যেই সেখানে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
সম্প্রতি এক ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা সম্মেলনে ইউক্রেনের স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগের জন্য তৈরি নতুন তহবিল গ্রিন ফ্ল্যাগ ভেঞ্চার-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা দেবোরাহ ফেয়ারল্যাম্ব বলেছেন, “সামনের দিনে ইউক্রেনের যুদ্ধে পরীক্ষা করা হয়নি এমন এআই যুদ্ধপ্রযুক্তি পণ্যের দিকে কেউ ফিরেও তাকাবে না।”
বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করার পাশাপাশি ইউক্রেন সরকার তার নিজস্ব উদীয়মান প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্যও যুদ্ধক্ষেত্রের মূল্যবান তথ্য সংরক্ষণ করতে চাইছে। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, যুদ্ধ ছাড়াও বিপর্যয়কর ব্ল্যাকআউট থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পর্যন্ত বিভিন্ন বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলার জন্যও ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো রপ্তানিও করতে চান তারা।
ইউক্রেনের এআই যুদ্ধ ল্যাব যে দেশটিকে বিশ্বের প্রযুক্তি বাজারেও একটি প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চলেছে তার লক্ষণও স্পষ্ট। গত নভেম্বরে লিসবনে অনুষ্ঠিত বিশ্বের বৃহত্তম প্রযুক্তি সম্মেলন ওয়েব সামিটে ইউক্রেন এবার বড়সড় প্যাভিলিয়নে প্রদর্শনী করেছে। দুই বছর আগে ওই সামিটে ইউক্রেন শুধু মেলার এক কোনে ছোট একটি বুথ দিয়েছিল। এবার ২৫ টি ইউক্রেনীয় স্টার্টআপ ওয়েব সামিটে নিজেদের পণ্যের বিশাল প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে।
তাইওয়ানও ইউক্রেনের দেখানো পথে
ইউক্রেনের এই সাফল্য বৈশ্বিক পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়ছে। ইউক্রেনের অর্জন দেখে উৎসাহিতি হয়ে তাইওয়ানও একই পথে হাঁটছে। চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে তাইওয়ানও তাদের ড্রোন কর্মসূচি জোরদার করতে সেনাবাহিনীতে বিদেশি বাণিজ্যিক ড্রোন নির্মাতা ও আকাশ প্রতিরক্ষা ফার্মকে নিয়োগ করেছে।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অফিস হোয়াইট হাউসে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য প্যালান্টিরসহ কয়েকটি কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। গত জানুয়ারিতে ইসরায়েলও প্যালান্টিরের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। বিষয়টি ইসরায়েল গোপনও করেনি, যেন প্যালান্টিরকে পেয়ে তারা ধন্য।
তবে পরবর্তী প্রজন্মের এআই যুদ্ধ প্রযুক্তিগুলো এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। ফলে তা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধে খুব বেশি সাফল্য এনে দিতে পারছে না। যুদ্ধ ইতিমধ্যেই তৃতীয় বছরে গড়িয়েছে কিন্তু ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ স্থবির হয়ে রয়েছে। এআই প্রযুক্তিগুলো এখনও যুদ্ধে জয় এনে দেওয়ার মতো ভুমিকা পালনের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।
এআই যুদ্ধ-প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারের ঝুঁকি
এআই প্রযুক্তিগুলোর নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারে জনগণের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ, গণ নজরদারি ও অন্যান্য অপব্যবহারের ঝুঁকি রয়েছে বলেও সতর্ক করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
তবে প্রতিরক্ষা এআই বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা সংস্থা রিসার্চ ইন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ফর ন্যাশনাল ডিফেন্স (রেইন) এর বৈশ্বিক নীতি পরিচালক জরিট কামিঙ্গা অবশ্য ইতিবাচক আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “ইউক্রেন যুদ্ধ এমন একটি জীবন্ত পরীক্ষাগার যেখানে এই এআই-চালিত সিস্টেমগুলো বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ক্রমাগত ত্রুটি সারানোর মধ্য দিয়ে পরিপক্কতায় পৌঁছাতে পারবে।”
তবুও আশঙ্কার বিষয় হলো, নতুন এই প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ বেশিরভাগই প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর হাতে থাকবে, যারা সরকারের মতো জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ডিয়ান নট সেন্টার ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনোভেশনের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ ব্ল্যাঙ্কও একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, “এই প্রথমবার কোনও যুদ্ধে বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি সরকারি অর্থায়নকৃত গবেষণা ল্যাব থেকে নয় বরং বাণিজ্যিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো থেকে আসছে। আর সেগুলোর জন্য একটি বাজারও আছে। দৈত্যটি আগে থেকেই বোতলের বাইরে রয়েছে এবং সেটিকে ফের বোতলবন্দী করা কঠিন হবে।”
টাইম ম্যাগাজিন অবলম্বনে