ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) বেশ বিপাকেই পড়েছেন। কারণ গাজার হামাস একটি সুন্নি ইসলামি সংগঠন হলেও তারা ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে যারা সৌদ রাজ পরিবারের ধ্বংস চায়।
অন্যদিকে, সৌদি আরবের সাধারণ নাগরিকরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মী হওয়ায় এমবিএস ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতেও বাধ্য। কারণ সমগ্র আরব ও মুসলিম বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলি আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের শিকার হিসেবেই দেখা হয়।
সৌদি রাজ পরিবার নিজেদের শাসন টিকিয়ে রাখতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও তার আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে একটি নিরাপত্তা জোটও গড়তে চায়। কিন্তু ইসরায়েল যতক্ষণ গাজায় বেসামরিক মানুষদের ওপর বোমা হামলা চালাবে এবং ফিলিস্তিনিদের নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকারকে স্বীকৃতি না দেবে ততক্ষণ সৌদি আরবের পক্ষে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়।
অবশ্য, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করাই সৌদি রাজতন্ত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায়ও নয়। দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালি করা এবং মতাদর্শ বদলানোর মাধ্যমেও সৌদি রাজপরিবার নিজেদের নিরাপত্তা বাড়াতে পারে। আর সে জন্যই সৌদি আরব তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে।
সৌদিরা এখন পর্যটন, খনি, রসদ সরবরাহ, শিল্প উৎপাদন, প্রযুক্তি, অর্থায়ন ও পরিবহন খাতের মতো নানা খাতে সক্রিয়ভাবে বিকাশ করছে। সৌদি রাজপরিবার তাদের মতাদর্শও বদলাচ্ছে। সৌদিরা এতোদিন ইসলামের মৌল ব্যাখ্যাকেই তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে আসছিল, যা সাধারণত ওয়াহাবিবাদ নামে পরিচিত। এ ছাড়া তারা নিজেদেরকে ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলোর রক্ষক হিসেবেও উপস্থাপন করত।
কিন্তু তার পরিবর্তে সৌদি রাজতন্ত্র এখন নিজেকে সৌদি জনগণের রক্ষক হিসেবেই বেশি উপস্থাপন করে। এ ছাড়া এমন জাতীয়তাবাদের প্রচার করে যেখানে ধর্মের চেয়ে সৌদিদের জাতীয় স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে। এজন্য সৌদিরা শরিয়া আইন ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ও নারীদের ভূমিকাসহ সৌদি সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সংস্কার করছে। সৌদি রাজতন্ত্রের টিকে থাকা এখন নির্ভর করছে ‘প্রকৃত ইসলাম’ প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করার বদলে মধ্যপ্রাচ্যে অঞ্চলিক ঐক্য, শান্তি ও সমৃদ্ধি আনায় তাদের সক্ষমতার উপর।।
কিন্তু গাজা যুদ্ধ সৌদিদের সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে। সৌদি আরব এখনও ইসরায়েলের সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্য বাদ দেয়নি। তবে তারা এখন ইসরায়েলের কাছে আরও বেশি মূল্য দাবি করছে।
গাজা যুদ্ধে জটিলতা
সৌদিরা এখন জোর দিয়ে বলছে, একটি স্বাধীন ও কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইসরায়েলকে অবশ্যই সহায়তা করতে হবে। ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে সৌদিরা যুক্তরাষ্ট্রকেও রাজি করানোর চেষ্টা করছে। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকেও তারা একই আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে সৌদিদের এই প্রচেষ্টা শুধু ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা লাঘব করার জন্যই না। এর মাধ্যমে তারা সৌদি রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের মধ্যে ইরান ও তার মিত্রদের ক্ষোভ উস্কে দেওয়ার সুযোগও দূর করতে চায়। ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার জন্য ইরান সবসময় সৌদি আরবকেই দায়ী করে আসছে। ফিলিস্তিন ইস্যুকে কাজে লাগিয়েই ইরান কথিত প্রতিরোধের অক্ষ তৈরি করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে চলমান বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতারও একটি বড় কারণ এই প্রতিরোধের অক্ষ।
সৌদিদের বিশ্বাস, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান হলে ইরান দুর্বল হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। আর সৌদি আরবও তখন তার জাতীয় রূপান্তর সম্পন্ন করতে পারবে এবং নিজেকে কেন্দ্রে রেখে একটি আন্তঃসংযুক্ত ও সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য তৈরির স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।
কম ধর্ম, বেশি জাতীয়তাবাদ
এমবিএস-এর লক্ষ্য হলো- সৌদি আরবকে, তার ভাষায়, ‘স্বাভাবিক’ করা। এর মাধ্যমে তিনি সামাজিকভাবে উন্মুক্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল একটি সমাজকে বোঝান, যদিও সেটি তার কর্তৃত্ববাদী শাসনেই থাকবে। মানুষকে ধর্ম-কর্ম করার স্বাধীনতা দেওয়া হবে, কিন্তু তারা নিজেদের বিশ্বাস অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। সরকার নাগরকিদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনে হস্তক্ষেপ করবে না। পুরুষ ও নারীরা প্রকাশ্যেই তাদের পছন্দ মতো পোশাক পরতে এবং হয়রানি ছাড়াই মেলামেশা করতে পারবে।
সৌদি যুবরাজের বিশ্বাস, ধর্মীয় ও সামাজিক উদারতা দেশটিকে অন্যান্য জাতির সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে, বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রতিভাবানদের আকৃষ্ট করতে এবং তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতেও সক্ষম করবে।
স্বতন্ত্র জাতীয়তার দৃঢ় অনুভূতি চালিত এবং আরও সহনশীল ও আধুনিক একটি দেশ গড়ে তোলার এই স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে এমবিএস অসংখ্য নতুন উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, তার সরকার সৌদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিবসের মতো অ-ধর্মীয় ছুটি তৈরি করেছে,যেগুলো এখন রাজপরিবারে ব্যাপকভাবে উদযাপন করে এবং অন্যদেরও উদযাপনে উৎসাহিত করা হয়।
ভিশন ২০৩০ কর্মসূচির আওতায় সৌদিরা দেশটির প্রাক-ইসলামি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পালন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ এবং সমসাময়িক সৌদি শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চাও উৎসাহিত করছে। উদাহরণস্বরূপ, আল-উলা নামের একটি অনন্য সুন্দর মরূদ্যান ও দর্শনীয় প্রাচীন সমাধিসহ একটি মরুভূমি অঞ্চল ভ্রমণের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সৌদিদের ইতিহাস এমনভাবে নতুন করে লেখা হচ্ছে যেখানে ক্ষমতা ও মতাদর্শিক বৈধতার ভিন্ন ভিন্ন উৎসগুলিকে কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দেশটির স্কুল পাঠ্যক্রম ও সাধারণ ইতিহাসও আরবি সংস্কৃতির উপর আরও জোর দেওয়ার জন্য নতুন করে লেখা হচ্ছে।
নতুন করে লেখা এই ইতিহাসে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে আরব উপদ্বীপে ঐক্য ও শান্তি স্থাপনে সৌদি রাজপরিবার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা আরও স্পষ্ট করে দেখানো হবে। ইতিহাসের নতুন এই বয়ানে দেশ হিসেবে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠায় এবং দেশটির ইতিহাসে ধর্ম ও ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের ভূমিকাকে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হবে।
বিশ্ব ইসলামবাদ বর্জন
সৌদি আরব এখন ইচ্ছাকৃতবাবে আন্তঃদেশীয় মতাদর্শিক দাবি ও প্রতিশ্রুতি প্রত্যাখ্যান করছে। দেশটি ইরানের মতো আন্তর্জাতিক মুসলিম স্বার্থ রক্ষার লড়াইয়েও আর আগ্রহী নয়। বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলীয় দেশগুলোতে (তৃতীয় বিশ্বে) পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে অন্যায়-অবিচার চালানোর যে অভিযোগ তাতেও বিশ্বাস নেই সৌদি আরবের। ‘মহা শয়তান’ বা ‘অহংকারের শক্তি’র বিরুদ্ধে লড়াই এবং ‘পৃথিবীর নিপীড়িত’দের মুক্তি বা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ‘প্রতিরোধের’ প্রয়োজনীয়তার কথাও বলে না সৌদিরা, যেমনটা ইরান ও তার সহযোগীরা বলে।
সৌদি আরব এখন তার নিজের সার্বভৌমত্বের পাশাপাশি অন্যদের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার ওপরও গুরুত্ব দেয়। আর এ কারণেই সৌদিরা চীনের উইঘুরদের (মুসলিম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী) ওপর দেশটির কমিউনিস্টদের দমনপীড়ন বা ভারতে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির অধীনে দেশটির মুসলমানদের দুর্দশার নিন্দা করে না। এমনকি রিয়াদ যখন ফিলিস্তিন নিয়েও কোনও আহ্বান জানায়, তখনও সৌদি জাতীয়তাবাদী হিসেবেই কথা বলে, বিশ্ব ইসলামবাদী হিসেবে নয়।
সৌদি নেতৃত্ব আন্তর্জাতিকভাবে হস্তক্ষেপে উৎসাহিত করে এমন মতাদর্শ ও আন্দোলনকে বিপজ্জনক হিসেবেই দেখে। আর এ কারণেই দেশটি মুসলিম ব্রাদারহুডসহ বিশ্ব ইসলামবাদী সব সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে।
নব্য উদারবাদী
সৌদিরা একটি উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক এবং নব্য উদারবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা চায়। যদিও দেশটির সরকার নতুন অর্থনৈতিক খাতগুলোর বিকাশ এবং বিদ্যমান খাতগুলোকে নতুন রুপ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবেই উদ্যোগ নেয়, যাকে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদও বলে।
সৌদি আরব তার তেল বিক্রি নির্ভর অর্থনীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠা কল্যাণ রাষ্ট্রের কাঠামো থেকেও বেরিয়ে আসতে চায়। ২০১৭ সালের হিসাবে দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ কর্মীই এর উপর নির্ভর ছিল।
এই পরিবর্তনের অর্থ হলো- কোনও ইসলামপন্থী শাসকগোষ্ঠী যেমন ব্যবস্থা প্রয়োগ করে সৌদি আরব এখন তার বিপরীতটাই করতে চাইছে। উদাহরণস্বরূপ, সাউন্ডস্টর্ম ২০২৩ এর কথা বলা যায়। এটি গত বছরের ডিসেম্বরে রিয়াদে অনুষ্ঠিত একটি সংগীত উৎসব। ক্যালভিন হ্যারিস, ট্র্যাভিস স্কট, মেটালিকাসহ বিভিন্ন গানের দলের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীদের গান শোনার জন্য দেশটির সমাজের সব শ্রেণি-পেশার কয়েক হাজার তরুণ-তরুণী সেখানে জড়ো হয়েছিল।
তাদের কারও পরনেই সৌদি আরবের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ছিল না। তরুণ-তরুণীরা অদ্ভুত সব সাজ-পোশাকে ওই সঙ্গীত উৎসবে হাজির হয়। ওই উৎসবের একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হলে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামপন্থী দলগুলো এর কঠোর সমালোচনা করে। যেমন, ইয়েমেনের হুতিরা ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলা চলাকালে এমন উৎসবকে নীতিজ্ঞানহীন বা লাম্পট্যমূলক বলে আখ্যায়িত করে এবং এমন উৎসবের অনুমতি দেওয়ায় সৌদি কর্তৃপক্ষের নিন্দা করে।
কিন্তু সব সমালোচনা উপেক্ষা করে সৌদি সরকার বলছে, দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্যই এ ধরনের অনুষ্ঠান জরুরি। সৌদিরা চায় তাদের নাগরিকরা দেশেই বিনোদনের জন্য ব্যয় করুক, আগে যে সুযোগ ছিল না। এর আগে সৌদি নাগরিকরা এমন বিনোদনের জন্য বিদেশে যেত এবং ভিনদেশে শতকোটি ডলার খরচ করে আসত। সৌদি সরকার এমন বিনোদনের আয়োজনকে স্থানীয় অর্থনীতির বিকাশে সবচেয়ে বড় সহায়ক হিসেবে দেখছে।
শান্তি ছাড়া সমৃদ্ধি আসে না
এমবিএস-এর উদ্যোগগুলো সৌদি আরবের সমৃদ্ধি এবং তার শাসনের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সহায়ক হবে। তবে সেগুলো সফল হওয়ার জন্য যে অবশ্যই শান্তি বিরাজ করতে হবে তা বুঝতে এমবিএস একটু দেরি করে ফেলেছেন। ইয়েমেন যুদ্ধে ব্যয়বহুল হস্তক্ষেপ, কাতারকে বয়কট এবং ইরানের প্রতি বৈরী ভঙ্গি— ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হিটলারের সঙ্গে তুলনাসহ আক্রমণাত্মক বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করে ব্যর্থ হবার পরই এমবিএস-এর এই উপলব্ধি এসেছে। তার এই আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি সৌদিদের জন্য অস্থিরতা তৈরি এবং এমবিএস-এর লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নকেও বাধাগ্রস্ত করছিল।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইরান সৌদি আরবের আবকাইক ও খুরাইসের তেল স্থাপনাগুলোতে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সৌদিদের অর্ধেক তেল উৎপাদন বন্ধ ছিল। ২০২২ সালের মার্চ মাসে হুথিরা জেদ্দা বিমানবন্দরের একটি তেলের ডিপোতে হামলা চালায়। এতে সৌদি আরবের ফর্মুলা ওয়ান গাড়ির রেস আয়োজন প্রায় ভেস্তে গিয়েছিল। সৌদিরা রেসটি তাদের দেশে আনার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিল।
মুসলিম বিশ্বের ইসলামপন্থী নেতারা সব সময়ই রিয়াদকে যুক্তরাষ্ট্রের দালাল ও ধর্মত্যাগী শাসক গোষ্ঠী হিসেবে নিন্দা করে আসছে। এই অভিযোগ থেকেও মুক্তির জন্যও সৌদিরা তাদের ভঙ্গি বদলাচ্ছে। সৌদিরা এখন আর এসব কটূক্তির কোনও জবাব দেয় না বরং যারা এই অভিযোগ করত তাদের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় যাচ্ছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এমবিএস কাতারের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেন। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে হুথিদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি এবং বন্দি বিনিময় নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। ২০২৩ সালের মার্চে ইরানের সঙ্গেও একটি সমঝোতা চুক্তি করেন এবং কূটনৈতিক সম্পর্কও স্বাভাবিক করেন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সৌদিরা ইয়েমেনে যুদ্ধ শেষ করার জন্য একটি রোড-ম্যাপ শান্তি চুক্তি অনুমোদন করেছে এবং হুথিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করছে। এর মাধ্যমে রিয়াদ কার্যকরভাবে হুথিদের ইয়েমেনের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। এমনকি এই চুক্তিতে সৌদিরা হুথিদেরকে আর্থিক সহায়তা ও বেতন দেওয়ারও প্রস্তাব করে।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া
তবে সৌদিরা শুধু আঞ্চলিক চাপের কারণেই এই শান্তির উদ্যোগ নেয়নি। ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হুমকি এমন এক সময়ে এসেছে যখন যুক্তরাষ্ট্রও সৌদি আরবকে বহিরাগত আগ্রাসন থেকে রক্ষার ব্যাপারে দৃঢ় কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরামকোর স্থাপনায় ২০১৯ সালে ইরানের হামলার জবাবে কোনও পদক্ষেপ নিতে অস্বীকৃতি জানান। আর সৌদিদের কাছ থেকে ট্রাম্পের শুধু একতরফা সুবিধা নেওয়ার কৌশলও এমবিএসকে ক্ষুব্ধ করে। তিনি চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সৌদিদেরকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করুক, শুধু এটিএম বুথসহ একটি গ্যাস স্টেশন হিসেবে নয়।
এরপর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসা বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে তিনি সৌদি আরবকে শাস্তি দেবেন। ক্ষমতা গ্রহণের এক মাসের মধ্যে বাইডেন প্রশাসন সিআইএর একটি গোপন নথি প্রকাশ করে যেখানে দাবি করা হয়, এমবিএসই তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ভিন্নমতাবলম্বী সৌদি সাংবাদিক এবং ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক জামাল খাসোগজিকে ধরা বা হত্যার আদেশ দিয়েছেন।
একই সময়ে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সন্ত্রাসী তালিকা থেকে হুথিদের নামও বাদ দেন। এরপর ২০২২ সালে মার্কিন কংগ্রেস সৌদিদের একটি অস্ত্রের চালানও আটকে দেয়, যার মূল্য সৌদিরা আগেই পরিশোধ করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণে এমবিএস মধ্যপ্রাচ্যে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের পাশাপাশি চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। একইসঙ্গে এমবিএস সবকিছুর উপরে সৌদিদের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেন, যার লক্ষ্য হবে সৌদি রাজবংশের শাসনকে সুরক্ষিত করার জন্য সব ধরণের বিকল্প বিবেচনায় রাখা।
আর এ কারণেই সম্প্রতি সৌদি আরব লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হুথিদের হামলা বন্ধের লক্ষ্যে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামুদ্রিক জোটে যোগ দেয়নি। সৌদিদের প্রত্যাশা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের গোঁড়া ধর্মীয় মতাদর্শের চেয়ে অর্থনৈতিক স্বার্থকে আরও বেশি প্রাধান্য দেবে। এজন্য তারা ইরান ও হুথিদের সঙ্গেও আর্থিক ও বিনিয়োগ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। সৌদিদের প্রত্যাশা, আর্থিক সুবিধা পেলে ইরান ও তার কথিত প্রতিরোধের অক্ষ সৌদি আরবের বিরুদ্ধে আগ্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করবে।
হুঁশিয়ার এমবিএস, হামাসের বাগড়া
তবে এমবিএস তার দেশের ক্ষতি করার জন্য তার শত্রুদের ইচ্ছা বা তাদের ক্ষমতার বিষয়েও সতর্ক আছেন। তিনি জানেন, ইরান ও তার মিত্ররা কখনওই সৌদি আরবের বন্ধু হবে না এবং ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সামরিকভাবে এতোটাই শক্তিশালি যে তারা কখনোই পুরোপুরি পরাজিত হবে না। সর্বোপরি, সৌদি আরব এর আগেও কথিত প্রতিরোধের অক্ষের নাটকীয়তা ও করুণ পরিণতি দেখেছে।
ইরানের আয়াতুল্লাহদের আগে মিশরের গামাল আবদেল নাসেরও আরব আন্তর্জাতিকতাবাদী বিপ্লবী মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ইরাকের সাদ্দাম হোসেনও তার বাথ মতাদর্শ যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে ছড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের পরিণতি হয়েছিল বিপর্যয়কর। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যও কোনও সামরিক সমাধান নেই। যুক্তরাষ্ট্রকেও মধ্যপ্রাচ্য থেকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়ার কোনও উপায় নেই।
সৌদিরাও প্রকৃতপক্ষে চায় যে, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হোক। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইচ্ছার পেছনেও এমবিএসের উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করার সুযোগ পাওয়া। ইসরায়েলে সৌদি দূতাবাস খোলার বিনিময়ে এমবিএস ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা চুক্তি চেয়েছিলেন। সৌদি আরবের আশা ছিল, ওই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে ইরানের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে এবং পারমাণবিক শক্তি অর্জনে সহায়তা করবে।
এমবিএস মূলত জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদাপূর্ণ কৌশলগত মিত্র হতে চেয়েছেন। যা রিয়াদের একটি বড় অর্জন এবং এতে এমবিএসের মুকুটেও নতুন একটি পালক যুক্ত হত। ১৯৪৫ সালে সৌদি রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সৌদ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চেয়ে আরও বড় কীর্তি হত এই চুক্তি।
কিন্তু ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদিদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া আকস্মিকভাবে থমকে যায়। ২০১১ সালের আরব বসন্তের বিদ্রোহের পর ফিলিস্তিন ইস্যু সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তবে গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের ভয়াবহ হামলায় ফের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির ভরকেন্দ্রে চলে আসে ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সৌদি রাজপরিবারের খুব বেশি সহানুভুতি নেই। তথাপি আরব বিশ্বের বাকিদের দেখাদেখি তারাও ইসরায়েলের নিন্দা করতে বাধ্য হয়।
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য যুবরাজরা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ বলে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। তারা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বানও জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার যে অভিযোগ এনেছে জানুয়ারির শেষদিকে সৌদি সরকার তাতেও সমর্থন দিয়েছে।
তবে সৌদিদের ইসরায়েলবিরোধী বিবৃতিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের চেয়ে হালকা ছিল। সৌদিরা শিগগিরই ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াও পুনরায় শুরু করার আশা প্রকাশ করেছেন। অবশ্য তারা এবার ইসরায়েলের কাছ থেকে আরও বড় ছাড় চাইবেন— যাতে একটি কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। এর চেয়ে কম কিছু হলে এমবিএস এর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনা হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরব নেতা এবং ইসলামের পবিত্র স্থানগুলোর অভিভাবক হিসেবে এমবিএস নিজের মর্যাদা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। তাই তিনি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ সম্পর্কেও বিশেষভাবে হুঁশিয়ার।
তার মানে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলিরা সৌদিদের যে প্রস্তাব দিয়েছিল তা আর যথেষ্ট হবে না। এই চুক্তিতে ফিলিস্তিনের জন্য ইসরায়েল কিছু ছাড় দিয়েছে ঠিক। কিন্তু তাতে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তব কোনও পদক্ষেপ নেই। ফলে সৌদিরা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গাজার ধ্বংসস্তুপ তারা পরিষ্কার করবেন না।
ইসরায়েলে এখন ক্ষমতায় আছেন কট্টর ইহুদিবাদী ও ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তিনি আজীবন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এসেছেন। ফলে ইসরায়েল সৌদিদের চাওয়া অনুযায়ী ছাড় দিতে রাজি হবে কি না তাও অনিশ্চিত।
তবে ইসরায়েলে হামাসের হামলা ফিলিস্তিন ইস্যুকে সৌদিদের জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান করে তুলেছে। সৌদিরা এখন নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাইতে বাধ্য হচ্ছে। হামাসের হামলা সৌদি আরবকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কট্টর সমর্থকে পরিণত করেছে। এর মধ্য দিয়ে হামাস ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি বিজয় নিশ্চিত করেছে— যদিও তারা ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি।
লেখক: বার্নার্ড হাইকেল, ফরেইন অ্যাফেয়ার্স। বার্নার্ড হাইকেল যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ার ইস্টার্ন স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক।
অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক