সিলেটের বন্দরবাজারের হাসান মার্কেটের হাসান কে? এই প্রশ্নের উত্তর নগরবাসীর অনেকেরই অজানা। এটাও জানা নেই যে এই স্থানে এক সময় একটি পার্ক ছিল, নাম ছিল ‘গোবিন্দচরণ পার্ক’।
পাকিস্তান আমলে এই পার্কটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সিলেটে আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। আর পাকিস্তান আমলেই পার্কটি ভেঙে বিপণি বিতান করা হয় এক পাকিস্তানির নামে।
স্বাধীনতার পর অর্ধ শতক গড়িয়ে গেলেও সেই বিপণি বিতানটির সেই নাম এখনও রয়ে গেছে। আর হাসান মার্কেট নামে এই বিপণি বিতানটির পরিচালনা কর্তৃপক্ষ সিলেট সিটি করপোরেশনও নাম পরিবর্তনের কোনও উদ্যোগ নেয়নি।
গোবিন্দচরণ পার্ক যেভাবে হয়েছিল
গোবিন্দচরণ পার্ক প্রতিষ্ঠার ইতিহাস কিছুটা জানা যায় অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজের আত্মজীবনী ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ থেকে।
এই বইয়ে আবদুল আজিজ লিখেছেন, গোবিন্দচরণ পার্কটি স্থাপন করেন রায়বাহাদুর গিরীশচন্দ্র।
উন্মুক্ত হওয়ার কারণে পার্কটিতে শহরের মানুষরা অবসর কাটাতে আসতেন। ধীরে ধীরে স্থানটি সভা-সমাবেশের আয়োজনস্থল হিসেবেও পরিচিতি পায়।
১৯৪৭ সালে সিলেটে অনুষ্ঠিত গণভোট এবং ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের আগে এই পার্কে সভা-সমাবেশ হয়েছিল।
একাধিক বইয়ে লেখা আছে, পার্কে বড় বড় গাছপালা ছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর এখানে কয়েকজন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। তাই পার্কের একদিকে সিপাহি বিদ্রোহের শহীদদের স্মৃতি স্মারকস্তম্ভও ছিল।
প্রাচীন বাংলা সংবাদপত্র যুগভেরীর সম্পাদক আমীনুর রশীদ চৌধুরী তার ‘সত্য ও তথ্য’ বইয়ে লিখেছেন, অখণ্ড ভারতের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি গোবিন্দচরণ পার্কে সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন।
তাদের মধ্যে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উল্লেখযোগ্য।
যেভাবে ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রে
পাকিস্তান হওয়ার পরপরই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে দেখা দেয় মতভেদ। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির দাবি উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। তখন থেকে নানাভাবে বিরোধিতা করে বাঙালি, আর সেই ঢেউ সিলেটেও এসে লাগে।
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। প্রায় একই সময়ে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট ১৯৪৭ সালের ৯ নভেম্বর বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে একটি আলোচনা সভা করে। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর ওই সংগঠনের প্রস্তাবে বড় পরিসরে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার হল রুমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভাষাসৈনিক মতিন উদদীন আহমদের সভাপতিত্বে ওই সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী।
এরপর আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের নিরিবিলি আঙিনা থেকে ‘গোবিন্দচরণ পার্কে’ যায় সংগ্রামের কর্মসূচি।
১৯৪৭ সালের শেষ এবং ১৯৪৮ এর শুরুর দিকে প্রায় প্রতিদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মিছিলসহ বিক্ষুব্ধ জনতা গোবিন্দ চরণ পার্কে জড়ো হতেন।
ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ মাসউদ খান তার এক স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “আন্দোলন চলাকালে আমরা প্রতিদিন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় ধর্মঘট পালন করে মিছিল, শোভাযাত্রা নিয়ে গোবিন্দচরণ পার্কে গিয়ে সমাবেশ করতাম। প্রতিদিন বিকেলে পার্কে জনসভায় অংশ নিতাম।”
লেখক ও গবেষক আবদুল হামিদ মানিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “১৯৪৮ সালের ৮ মার্চ গোবিন্দচরণ পার্কে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে তমদ্দুন মজলিস এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন যৌথভাবে একটি জনসভা আয়োজন করে। ওই সভার সভাপতি ছিলেন রাজনীতিবিদ মাহমুদ আলী। সভা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলাবিরোধী পক্ষ লাঠি নিয়ে হামলা চালিয়ে সভাপতির চেয়ার দখল করে নেয়।”
তিনি জানান, ওই হামলায় মাহমুদ আলী, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং সিলেট তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক দেওয়ান অহিদুর রেজা ও সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আব্দুস সামাদ আজাদ আহত হন। এর মধ্যে মারাত্মক আহত হন তরুণ কর্মী মকসুদ আহমদ।
তার প্রতিবাদে গোবিন্দচরণ পার্কে ১০ মার্চ আরও একটি সভা ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শহরে দুই মাসের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন বলে জানান আবদুল হামিদ।
ভাষা আন্দোলনের কর্মী মো. আবদুল আজিজ তার ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সিলেট’ বইয়ে ১৯৫২ সালে ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের পরদিন সিলেটে তার প্রতিবাদের কথা লিখেছেন।
“বেলা ১১টার আগেই কর্মসূচির ঘোষণা-সংবলিত পোস্টারে শহরের দেয়াল ছেয়ে যায়। বেলা ৩টায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা দলে দলে গোবিন্দচরণ পার্কে সমবেত হতে শুরু করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন সিলেট জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি, খেলাফত আন্দোলনখ্যাত উকিল আবদুল্লাহ বিএল। সভায় পরদিন পূর্ণ হরতাল পালনের আহ্বান জানানো হয়।”
আবদুল আজিজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সিলেটের গোবিন্দচরণ পার্কের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। সিলেটের সকল আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই পার্ক।”
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী ও ভাষাসংগ্রামী আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘স্মৃতি অম্লান ১৯৭১’ গ্রন্থে সিলেটে ভাষা আন্দোলনের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক ও পরিণত পর্যায়ে সিলেটে সব সভা-সমাবেশ হতো গোবিন্দচরণ পার্কে।
পার্ক থেকে মার্কেট
হাসান মার্কেটের এখনকার নামফলকেও লেখা আছে, প্রতিষ্ঠানকাল ১৯৫৯ সাল।
লেখক কপিল কল্যাণ চৌধুরী তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮-১৯৬০ সালে সিলেটের জেলা প্রশাসক ছিলেন পশ্চিম-পাকিস্তানি টি এম আলী হাসান নামের পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের এক কর্মকর্তা। তিনিই পার্ক ভেঙে মার্কেট গড়ার উদ্যোগ নেন।
“তখন সিলেটে বেশ কিছু উর্দুভাষী ব্যবসায়ী ছিল। ওই ব্যবসায়ীদের লোভের সুযোগে এবং নিজের নামকে অমর করে রাখতে বদ্ধপরিকর টি এম আলী হাসান সোনালী ঐতিহ্যের বুক খোদাই করে তারই নামে গড়ে তোলেন হাসান মার্কেট।”
১৯৫৯ সালে নির্মাণ শুরু হয় হাসান মার্কেটের, ১৯৬৫ সালে প্রায় সোয়া ২শ ব্যবসায়ীকে তাদের দোকান বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তার মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো উর্দুভাষী ব্যবসায়ী।
স্বাধীনতার পরও হাসান মার্কেট বাহির লাইন অর্থাৎ দুর্গাকুমার পাঠশালার বিপরীত দিকের দোকানগুলো ছিলো উর্দুভাষী বিহারিদের।
বিস্মৃত স্মৃতি ফিরিয়ে আনার তাগিদ
গবেষক আবদুল হামিদ মানিক বলেন, “নতুন প্রজন্ম এই পার্ক সম্পর্কে কিছুই জানে না। পৃথিবীর যত ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয় নিজ দেশের নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে উৎসাহিত করার জন্য।
“কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সিলেটে সেটি করা হয়নি। ভাষা আন্দোলনের স্থানগুলো সংরক্ষণ বা স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়নি। যার কারণে অনেক তরুণ ভাষা আন্দোলনে সিলেটের যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে, সেটি জানেও না।”
বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস প্রণয়ন পরিষদের অন্যতম সম্পাদক, লেখক-গবেষক আবুল ফতেহ ফাত্তাহ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্ত ঘেঁটে দেখা গেছে, সিলেটের প্রায় সকল সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই পার্কের নাম। ঐতিহ্যবাহী পার্কটি গুঁড়িয়ে যে জেলা প্রশাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় বিপণি বিতান হয়েছিল, তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দা।
“স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করেও যাদের কাছ থেকে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম, সেই পশ্চিম পাকিস্তানের একজন নাগরিকের নাম আমাদের ঐতিহ্যের একটি জায়গাজুড়ে আছে। হারিয়ে গেছে এ মাটির সন্তান গোবিন্দচরণের নাম, অথচ টিকে আছে পাকিস্তানি নাগরিকের নামে হাসান মার্কেট!”
“স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুসলিম সাহিত্য সংসদের জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তন করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে সোলেমান হল হয়েছে, অথচ পাকিস্তানি ডিসি হাসানের নাম সগৌরবে ঠিকে আছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক,” হতাশা নিয়ে বলেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, কেন এখনও একজন পাকিস্তানির নাম এই মার্কেটে রয়ে গেছে, তা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না।
এই বিপণি বিতানটি নতুনভাবে করার একটি পরিকল্পনা নিয়েছেন জানিয়ে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ঐতিহ্যবাহী এই স্থানে বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স নামে উন্মুক্ত উদ্যানসহ আধুনিক বিপণি বিতান তৈরির একটি প্রকল্প আমরা গ্রহণ করেছি। ভাষা আন্দোলনসহ ইতিহাস, ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ এ স্থানকে সিলেটবাসীর মর্যাদার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করব।”