Beta
শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫

ঠাঁই মেলেনি আর্চারিতে, ঠাঁই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে

আর্চারি খেলে জীবনের চাকা ঘোরাতে চেয়েছিলেন অসীম কুমার দাস। ছবি: সংগৃহীত।
আর্চারি খেলে জীবনের চাকা ঘোরাতে চেয়েছিলেন অসীম কুমার দাস। ছবি: সংগৃহীত।
[publishpress_authors_box]

নিউইয়র্কে কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করেন অসীম কুমার দাস। কাজের সুবাদে প্রতিদিন কত কিছুই তো বিলি করতে হয় তাকে! কখনো যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কোনও নেপালির জন্য কুরিয়ারে করে ধনুক আসে কাঠমান্ডু থেকে। কখনও ভুটান থেকে কারও জন্য আসে তির।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক আর্চার অসীম পারলে কুরিয়ারের প্যাকেট খুলে সেই তির-ধনুক নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। কিন্তু খেলাটা যে ছেড়েই দিয়েছেন অসীম।

আর্চারিতে দুটো বিভাগ-রিকার্ভ ও কম্পাউন্ড। অলিম্পিকে শুধু রিকার্ভ ইভেন্ট খেলানো হয় বলে কম্পাউন্ড অনেকটা আড়ালেই থেকে যায়। তাই জাতীয় দলের হয়ে বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলো ছড়িয়েও কখনও ফেডারেশন কর্মকর্তাদের নজরে আসতে পারেননি অসীম। সেই হতাশা থেকেই খেলা ছেড়ে এখন দূর প্রবাসে ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছেন কুরিয়ার-কর্মী হিসেবে।

অথচ কখনোই প্রিয় আর্চারি ছাড়তে চাননি অসীম। কখনও ছেড়ে যেতে চাননি প্রিয় বাংলাদেশ। কুড়িগ্রামের অস্বচ্ছল কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা খেলোয়াড় অসীম চেয়েছিলেন আর্চারির মাধ্যমে যেন একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়। এজন্য দেশের বিভিন্ন সার্ভিসেস সংস্থার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন দিনের পর দিন।

বাংলাদেশ গেমসে রেকর্ড গড়ে সোনা জয়ের পর অসীম কুমার। ছবি: সংগৃহীত।

এমনকি ২০২২ সালে যখন বাংলাদেশ দল ‘দশে দশ’মেরেছিল নেপালের পোখারায় অনুষ্ঠিত এসএ গেমসের আর্চারিতে, তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন একটা চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে। সেই চাকরিও পাননি। কোথাও দিশা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর কঠিন সিদ্ধান্ত নেন অসীম।

২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে অসীম খেলা ছেড়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। অসীমের জন্য সুংসবাদ-যুক্তরাষ্ট্র সরকার শনিবার তাকে দিয়েছে সে দেশে থাকার আনুষ্ঠানিক অনুমতি। প্রায় এক বছরের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিননকার্ড পেলেন তিনি।

আর্চারিই অসীমকে নিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে

চাকরির আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনও ফল না পেয়ে অসীম কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এদিকে হতাশায় তার পারফরম্যান্সও নীচের দিকে নামতে থাকে। ঘটনাটা ২০২১ সালের নভেম্বরের। ওই সময় বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ। প্রতিযোগিতায় খেলতে এসেছিলেন ভারতের চ্যাম্পিয়ন কম্পাউন্ড আর্চার ও বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ের ৫ নম্বরে থাকা অভিষেক ভার্মা।

বন্ধুত্বের সুবাদে অভিষেককে কথায় কথায় নিজের অবস্থাটা খুলে বলেছিলেন অসীম। এই ঘটনার মাস দুয়েক আগে অসীম ২০২১ সালের নভেম্বরে বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সঙ্গে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেই সুবাদে তার পাসপোর্টে ৫ বছরের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা লাগানো ছিল। সুবাদে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া-আসার ব্যাপারে কোনও সমস্যা ছিল না অসীমের।

জাতীয় দলের কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখের সঙ্গে ট্রফিসহ অসীম কুমার। ছবি: সংগৃহীত।

এটা শুনেই অসীমকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর বুদ্ধি দেন অভিষেক। গল্পটা অসীমের মুখেই শুনুন, “অভিষেকের কাছে আমার অবস্থার কথা খুলে বলতেই উনি যুক্তরাষ্ট্রে আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। এরপর দিল্লি হয়ে নিউইয়র্কে চলে আসি।”

যদিও পেনসিলভেনিয়ায় তাকে কাজ দিয়েছিলেন অভিষেক। কিন্তু গ্রিনকার্ড পেতে উকিলের কাছে দৌড়াদৌড়ি এবং নিউইয়র্কে চেনাজানা বাঙালী বেশি থাকায় পেনসিলভেনিয়ায় যাননি অসীম।

অসীমের আর্চারি প্রোফাইল

২০১৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সলিডারিটি আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে কম্পাউন্ড পুরুষ এককে সোনা জেতেন অসীম। এছাড়া জার্মানি, চীন, সুইজারল্যান্ডে বিশ্বকাপ, ব্যাংককে  এশিয়া কাপ ও এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ, নেদারল্যান্ডসে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ ও বাংলাদেশে এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছেন। খেলেছেন ২০১৮ জাকার্ত এশিয়ান গেমস, ২০১৯ কাঠমান্ডু-পোখারা এসএ গেমসে।

টেলিভিশনে খেলা দেখে আর্চারিতে আসা      

অসীমদের বাড়ির পাশেই ভারতের সীমান্ত। দূরদর্শনে নিয়মিত খেলা দেখতেন একসময়। বিশ্বকাপে সোনাজয়ী ভারতীয় তিরন্দাজ দীপিকা কুমারীর খেলা দেখে আর্চারিতে আসার আগ্রহ জাগে। কিন্তু কোথায় বাংলাদেশে আর্চারি খেলাটার চর্চা হয়, সেটাই জানতেন না।

অসীম কুমার দাস (মাঝে) বর্তমানে নিউইয়র্কে। হাতে ধরা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ড। ছবি: সংগৃহীত।

২০১২ সালে ফেডারেশন থেকে আর্চারি প্রতিভা বাছাইয়ের ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে ট্রায়ালের পর প্রতিবছর নিজের টাকায় কেনা বাঁশের তৈরি ধনুক দিয়ে অনুশীলন করে ঢাকায় এসে জাতীয় পর্যায়ে খেলে যেতেন। একপর্যায়ে ভালো পারফরম্যান্সের সুবাদে তিরন্দাজ ক্লাবে খেলার সুযোগ পান। এরপর জাতীয় দলের হয়ে দেশ-বিদেশে খেলেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়।

২০২১ বাংলাদেশ গেমসে র‍্যাঙ্কিং রাউন্ডে গেমস রেকর্ড গড়ে স্কোর করেন সর্বোচ্চ ৭০৪ পয়েন্ট। সেবার জেতেন এককে সোনা।

আবারও খেলবেন আর্চারি

যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুঠোফোনে অসীম বলছিলেন, “আমি আর্চারি ছাড়তে চাইনি। আসলে নিয়তিই আমাকে এখানে এনেছে। যখন দেশে কেউ আমাকে একটা চাকরি দিতে পারল না তখনই এই সিদ্ধান্ত নিলাম।”

সারাদিন ব্যস্ততা আর ছোটাছুটি অসীমের। যে ফ্ল্যাটে বাঙালিদের সঙ্গে কক্ষ ভাগাভাগি করে থাকেন, সেখানে ফিরে রাতে নিজের জন্য রান্না করতে হয়। ক্লান্ত শরীরে এরপর আর খেলার ইচ্ছা থাকে না। তারপরও সময় পেলে যুক্তরাষ্ট্রে খেলতে চান, “বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা ইনডোর আর্চারি টুর্নামেন্ট হয় লাস ভেগাসে। ভেগাস শুট নামের এই প্রতিযোগিতা সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রায় ৪ হাজার আর্চার খেলে। সেখানে আমি খেলতে চাই।”

দেশের হয়ে সোনা জিতেছেন অসীম। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে চিনিয়েছেন আর্চারির সুবাদে। অথচ সেই অসীমের ঠাঁই হয়নি দেশের আর্চারি অঙ্গনে। যুক্তরাষ্ট্রে ঠাঁই মেলা অসীমের বুকের মধ্যে তবুও লুকিয়ে আছে তির-ধনুকের ভালোবাসা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত