জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণে সমুদ্রের সক্ষমতা বাড়াতে সিঙ্গাপুর বিশ্বের বৃহত্তম কার্বন অপসারণ প্ল্যান্ট তৈরির ঘোষণা দিয়েছে।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের জাতীয় পানি সংস্থা পিইউবি ও যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক স্টার্ট-আপ একুয়াটিক এই ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছে, তারা ইতোমধ্যে এমন প্ল্যান্টের সফল পরীক্ষা চালিয়েছেন।
একুয়াটিক-১ নামের প্ল্যান্টটি নির্মাণে খরচ পড়বে ২০ মিলিয়ন ডলারে (প্রায় ২২০ কোটি টাকা)। এটি সমুদ্রের পানি থেকে বছরে প্রায় ৩ হাজার ৬৫০ টন বা দিনে ১০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ করতে পারবে।
পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের পানি সংস্থা পিইউবির পানি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াকেও কার্বনমুক্ত করবে। এই প্ল্যান্ট থেকে পুনরায় সমুদ্রে ছাড়া পানিও বায়ুমণ্ডল থেকে আরও বেশি কার্বন শোষণ করতে পারবে।
দুটি ছোট পরীক্ষামূলক প্ল্যান্টের সাফল্যের পর এই বড় প্ল্যান্টটি নির্মাণের ঘোষণা এলো। ছোট দুটি প্ল্যান্টের একটি সিঙ্গাপুরের তুয়াস-এ পিইউবির গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্টে এবং অন্যটি লস অ্যাঞ্জেলেস বন্দরে স্থাপন করা হয়েছিল। দুটিই সফল প্রমাণিত হয়েছে।
২০২৩ সালের এপ্রিলে স্থাপিত ওই ছোট দুটি প্ল্যান্ট প্রতিদিন সমুদ্র থেকে প্রায় ১০০ কেজি করে গ্রিনহাউস গ্যাস অপসারণ করতে পারে।
দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুর একাই শুধু ২০২১ সালে ৫ কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করেছে, যা প্ল্যান্টটির অপসারণ সক্ষমতার ১৩ হাজার গুণ বেশি।
একুয়াটিক ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লস অ্যাঞ্জেলেসের (ইউসিএলএ) ইনস্টিটিউট ফর কার্বন ম্যানেজমেন্টের গবেষক এবং বিশেষজ্ঞরা আগামী ১৮ মাসের মধ্যে প্ল্যান্টটি নির্মাণ করবেন। এটি পশ্চিম সিঙ্গাপুরে অবস্থিত তুয়াস-এ পিইউবির গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে নির্মাণ করা হবে।
২০২৪ সালের শেষ তিন মাসের মধ্যেই একুয়াটিক-১ দিনে এক টন করে কার্বন নিঃসরণ দিয়ে কাজ শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর ২০২৫ সালের দ্বিতীয় তিন মাসের মধ্যে এটি প্রতিদিন ১০ টন পর্যন্ত কার্বন অপসারণের সক্ষমতা অর্জন করবে।
একুয়াটিক কোম্পানি প্রথমে সি চেঞ্জ নামে যাত্রা শুরু করেছিল। কোম্পানিটি ২০২১ সালে দ্য লাইভঅ্যাবিলিটি চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ১০ লাখ ডলার জিতে নেয়।
দ্য লাইভঅ্যাবিলিটি চ্যালেঞ্জ হলো টেমাসেক ফাউন্ডেশন উপস্থাপিত এবং ইকো-বিজনেস আয়োজিত একটি বিশ্বব্যাপী টেকসই উদ্ভাবন প্রতিযোগিতা। ২০২১ সালে এর সপ্তম সংস্করণ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি মেটাতে প্রযুক্তিগত সমাধানের আহ্বান জানানো হয়। সেবছর রেকর্ড সংখ্যক গবেষণা প্রকল্প জমা পড়েছিল।
প্ল্যান্টটি কীভাবে কাজ করবে
একুয়াটিক কোম্পানি ও ইউসিএলএর ইনস্টিটিউট ফর কার্বন ম্যানেজমেন্টের বিজ্ঞানীদের তৈরি একটি অভিনব ইলেক্ট্রোলাইটিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে প্ল্যান্টটি কাজ করবে। এটি বিদ্যুতের মাধ্যমে সংলগ্ন ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট থেকে সমুদ্রের পানিকে পাম্প করার মাধ্যমে কাজ করবে। এতে সিরিজ রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে সমুদ্রের পানিকে কার্বনমুক্ত হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে বিভক্ত করা হবে।
আর দ্রবীভূত কার্বন সামুদ্রিক পানির ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের মতো খনিজ পদার্থের সঙ্গে মিলিত হয়ে কঠিন চুনাপাথর তৈরি হবে। এতে ওই কার্বন ডাইঅক্সাইড অন্তত ১০ হাজার বছরের জন্য আটকা পড়বে। সমুদ্রের পানিতে থাকা কার্বনকে কঠিন চুনাপাথরে পরিণত করার এই প্রক্রিয়াটি সামুদ্রিক ঝিনুক তৈরির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মতো। আর কঠিন ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম-ভিত্তিক উপাদানগুলো হয় সমুদ্রের তলায় সংরক্ষণ করা যেতে পারে, অথবা নির্মাণ সামগ্রীর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, যদি তা টেকসই হয়।
কার্বনমুক্ত পানি পুনরায় সমুদ্রে ছাড়ার আগে ক্ষারীয় শিলা দ্রবীভূত করে এর ক্ষারত্বও পুনরুদ্ধার করা হবে। এই পানি সমুদ্রে গিয়ে আরও বেশি কার্বন শোষণ করতে পারবে।
পিইউবি বলেছে, “প্ল্যান্টে প্রক্রিয়াকৃত সামুদ্রিক পানিকে আরও শোধন করা হবে যাতে সামুদ্রিক পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাবও সীমিত থাকে। একটি স্বাধীন পরামর্শদাতা গ্রুপের মাধ্যমে প্ল্যান্টের কার্যক্রম থেকে উদ্ভূত যে কোনও পরিবেশগত প্রভাব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।”
আমরা জানি যে, পৃথিবীর মহাসাগরগুলো কার্বন ডাই অক্সাইডের একটি প্রাকৃতিক শোষক, যা মানুষের কার্যকলাপ থেকে নির্গত কার্বনের প্রায় ৩০ শতাংশই শোষণ করে নেয়।
তবে বাড়তি কার্বন শোষণের ফলে সমুদ্রের তাপমাত্রা ও সাগরের পানির অম্লতা বাড়ছে এবং অক্সিজেন কমাসহ অনেক সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। এতে সমুদ্রের বিশ্বকে খাদ্য সরবরাহ, জীবিকা নির্বাহ এবং বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব তথা বিশ্ব উষ্ণায়ন থেকে বাঁচানোর ক্ষমতাও কমছে।
প্ল্যান্টে উৎপাদিত কঠিন কার্বনেটের কী হবে
গড়ে প্রতি টন কার্বন অপসারণের ফলে প্রতিদিন ২২০ কেজি কঠিন ক্যালসিয়াম কার্বনেট উৎপাদিত হবে। বর্তমান পরীক্ষামূলক প্রকল্পে প্রতিদিন উৎপাদিত ১০০ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইডের মধ্যে ২২ কেজি এই কঠিন পদার্থে পরিণত হয়। অবশিষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড দ্রবীভূত ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট ও বাইকার্বনেট হিসেবে অপসারণ করা হয়।
পিইউবি ও একুয়াটিক কঠিন কার্বনেটের সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করতে সিঙ্গাপুরে সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করছে। একুয়াটিকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা দান্তে সিমোনেত্তি বলেন, “এই কঠিন কার্বনেটগুলো সম্ভাব্যভাবে জমি, পুনরুদ্ধার, সিমেন্ট বা কংক্রিটের জন্য নির্মাণ শিল্পে ব্যবহার করা যেতে পারে।” দান্তে ইউসিএলএ স্যামুয়েলি স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের রাসায়নিক ও বায়োমোলিকুলার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহযোগী অধ্যাপক।
হাইড্রোজেনের কী হবে
প্ল্যান্টটিতে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ কেজি বা বছরে ১০৫ মেট্রিক টন কার্বন-নেগেটিভ হাইড্রোজেন উৎপাদিত হবে। এই হাইড্রোজেন পরিষ্কার জ্বালানি শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ব্যবহারের উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে হাইড্রোজেন জ্বালানি কোষ, তাপ ও শক্তির জন্য হাইড্রোজেন টারবাইন, সেইসঙ্গে সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য হাইড্রোজেন।
সিমোনেত্তি ইকো-বিজনেসকে বলেছেন, “উদাহরণস্বরূপ, হাইড্রোজেন একই সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন অপসারণ করার পাশাপাশি একটি পরিষ্কার জ্বালানি শক্তির উৎস হিসেবে একুয়াটিক প্রক্রিয়াকে জ্বালানি শক্তি সরবরাহে ব্যবহার করা যেতে পারে।”
প্ল্যান্টে কত শক্তি ব্যয় হবে
প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সমুদ্রের পানি থেকে প্রতি টন কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণের জন্য ২ মেগাওয়াট-এর কম বিদ্যুৎ শক্তি খরচের লক্ষ্যমাত্রা নিচ্ছেন তার, যা ২০২৩ সালে সিঙ্গাপুরের পরিবার প্রতি গড় শক্তি খরচের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ কম।
তবে পিইউবি জানিয়েছে, তারা প্ল্যান্টটিকে ডিস্যালাইনেশন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একীভূত করার সম্ভাব্যতা নিয়েও গবেষণা চালিয়ে যাবে। প্রক্রিয়াটির কোন পর্যায় কার্বন কমানোর ক্ষেত্রে সর্বাধিক সুবিধা দেবে তা নির্ধারণ করতে।
উদাহরণস্বরূপ, ডিস্যালাইনেশন প্রক্রিয়ার শুরুতেই সমুদ্রের পানি থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ করা ডিস্যালাইনেশনের জন্য বিদ্যুৎ শক্তির খরচ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
প্ল্যান্টটির রক্ষণাবেক্ষণ কতটা ব্যয়বহুল
২০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে বানানোর পর প্ল্যান্টটির রক্ষণাবেক্ষণে কত খরচ পড়বে তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি। তবে দান্তে সিমোনেত্তি বলেছেন, প্লান্টটি রক্ষণাবেক্ষণেও একই রকম পরিষেবা ও অনুরূপ শিল্প, যেমন, পানি শোধনাগার, ডিস্যালাইনেশন ও হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য ওয়াটার ইলেকট্রোলিইসিস প্ল্যান্টের মতোই খরচ হবে।
মহাসাগর থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণের প্রযুক্তির খরচ এখনও অনেক বেশি। আর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের উপর তাদের প্রভাব কী হতে পারে, বা বড় পরিসরে তা কতটুকু কার্যকর হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
বাণিজ্যিক উৎপাদন
প্ল্যান্টটি সফল হলে একুয়াটিক তাদের প্রযুক্তিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে এর বাণিজ্যিকীকরণ করবে বলে জানিয়েছেন স্টার্ট-আপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ইনস্টিটিউট ফর কার্বন ম্যানেজমেন্টের পরিচালক অধ্যাপক গৌরব সান্ত।
দান্তে সিমোনেত্তিও বলেন, “একুয়াটিক-১ প্ল্যান্ট কার্বন অপসারণে তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারলে আমরা প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণে সক্ষম বাণিজ্যিক প্ল্যান্ট তৈরির পরিকল্পনা করব।” ২৫ হাজার মানুষ বছরে এই পরিমাণ কার্বন নিঃসরন করে।
আরও যেসব কোম্পানি কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের আরও বেশ কয়েকটি স্টার্ট-আপ সমুদ্র থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণের জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক সংস্থা এব কার্বন (Ebb Carbon) সমুদ্রের পানির ক্ষারত্ব বাড়াতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে, যাতে তা বায়ুমণ্ডল থেকে আরও বেশ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে পারে। কার্বন অপসারণ করে মাটির নিচে ঢুকিয়ে রাখা বা শিল্প প্রক্রিয়ায় ব্যবহারের জন্যও প্ল্যান্ট তৈরির পরিকল্পনা করছে তারা। ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনা শহরে তারা তাদের প্রথম ছোট আকারের প্ল্যান্টটি তৈরির পরিকল্পনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মেইন-এ অবস্থিত রানিং টাইড নামের একটি কোম্পানি সমুদ্র থেকে কার্বন অপসারনের জন্য মাইক্রোসফটের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মাইক্রোসফট ২০৩০ সালের মধ্যে নিজেদের কার্বন নির্গমন শুন্যে নামিয়ে আনতে চায়। চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানি দুটি সামুদ্রিক শৈবালের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে সমুদ্র থেকে প্রায় ১২ হাজার টন কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণের লক্ষ্য নিয়েছে। সামুদ্রিক শৈবাল প্রচুর পরিমাণে কার্বন শোষণ করে।
তথ্যসূত্র: ইকো-বিজনেস, স্ট্রেইট টাইমস