সন্ধ্যায় ইফতার করেছিলেন সাদি মহম্মদ। তারপর বসেন তানপুরা নিয়ে। সুরের সঙ্গে গলা মেলান। পরিবারের কেউ তখনও জানতেন না, এর একটু পরেই তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেবেন।
শোকাহত বিজ্ঞাপন নির্মাতা গাওসুল আলম শাওন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এভাবে জানালেন মামা সাদি মহম্মদের শেষ মুহূর্ত যাপনের কথা।
যার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে মন জুড়াতেন হাজারো শ্রোতা, তিনি কেন এভাবে চলে গেলেন?
সংবাদ মাধ্যমকে গাওসুল আলম শাওন বলেন, “মামা ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। গত এক বছর সময়টা কঠিন ছিল।”
গত বছরের ৮ জুলাই মা জেবুন্নেসা সলিমউল্লাহকে হারান এই শিল্পী। ৯৬ বছর বয়সে জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ বয়স জনিত রোগে মারা যান।
স্বজনরা বলছেন, মায়ের মৃত্যুতে ট্রমা ঘিরে ধরেছিল সাদি মহম্মদকে।
৭টা ২০ কি সাড়ে সাতটা নাগাদ মোহাম্মদপুরে নিজ বাড়িতে মারা যান তিনি।
তার ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন, সন্ধ্যার পর থেকেই সাদি মহম্মদের ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। পরে দরজা ভেঙে তার ঝুলন্ত মরদেহ দেখা যায়।
একাধারে শিল্পী, শিক্ষক ও সুরকার সাদি মহম্মদের এই চলে যাওয়া হতবাক করেছে তার ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের। তাদের অনেকের স্মৃতিচারণে বারবার একটি কথাই উঠে আসছে, সাদি মহম্মদের মনে অনেক অভিমান জমে ছিল।
বৃহস্পতিবার বাদ জোহর মোহাম্মদপুর জামে মসজিদে তার জানাজা হয়। এরপর তাকে মোহাম্মদপুর জামে মসজিদ কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শিল্পীর মরদেহ আলাদা সময় নিয়ে শহীদ মিনারে নেওয়া হয়নি। তারপরও মানুষের প্রাণঢালা ভালোবাসা পেয়েছেন এই রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী।
সাদি মহম্মদ ১৯৫৭ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বেঁচে থাকলে এ বছর ৪ অক্টোবর তিনি ৬৭ বছর বয়সে পা রাখতেন।
সাদি মহম্মদের বেড়ে ওঠা ছিল ঢাকার মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডেই। বাবা সলিম উল্লাহকে কিশোর বয়সেই হারিয়েছিলেন তিনি। সলিম উল্লাহ ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা। ১৯৭১ সালে তাদের বাড়িতে নিয়মিত যারা বৈঠকে বসতেন তাদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুপুত্র শহীদ শেখ কামালও।
একাত্তরের ২৩ মার্চ বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন সলিম উল্লাহ। ওই পতাকা এঁকেছিলেন তার সেজ ছেলে সাদি মহম্মদ।
এই ঘটনায় বাংলাদেশ বিরোধীদের কালো তালিকায় চলে যায় ওই বাড়ি। একাত্তরের ২৬ মার্চ অবাঙ্গালী ও পাকিস্তানি সেনারা এসে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আর সলিম উল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে।
তার নামেই মোহাম্মদপুরের সলিম উল্লাহ রোডের নাম রাখা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর পরিবারের ইচ্ছা মেনে নিয়ে সাদি মহম্মদ ভর্তি হলেন বুয়েটে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং তাকে টানেনি।
বুয়েটে পড়ার সময়ই ১৯৭৫ সালে বিশ্বভারতী থেকে স্কলারশিপ পেলেন। বিশ্বভারতীতে শান্তিদেব ঘোষ ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গানের দীক্ষা নেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে তারপর দেশে ফেরেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং আধুনিক গানসহ সাদি মহম্মদের মোট অ্যালবামের সংখ্যা ৬০টিরও বেশি। সাংস্কৃতিক সংগঠন রবিরাগের পরিচালক ছিলেন এই শিল্পী।
২০০৭ সালে ‘আমাকে খুঁজে পাবে ভোরের শিশিরে’ অ্যালবামের মধ্যে দিয়ে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সাদি। এরপর ২০০৯ সালে ‘শ্রাবণ আকাশে’ এবং ২০১২ সালে ‘সার্থক জনম আমার’ অ্যালবাম প্রকাশ পায় তার।
সঙ্গীতে অবদানের জন্য ২০১২ সালে চ্যানেল আইয়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন আজীবন সম্মাননা। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার।
শেষ কয়েক বছর নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলেন এই গুণী শিল্পী। বিশেষ করে গত বছর মায়ের মৃত্যুর পর।