গুগল, আইবিএম ও ডেলসহ যুক্তরাষ্ট্রের সাতটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে আর কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি লাগে না।
২০০৮-২০০৯ সালের মহামন্দার পর উচ্চতর ডিগ্রির অভাবে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ শ্রম শক্তির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লাখ লাখ ভালো বেতনের চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়। এসব কাজের জন্য আসলে চার বছরের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির কোনও দরকারই নেই বলে ২০১৭ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে।
উচ্চতর ডিগ্রির বাধ্যবাধকতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনোরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ তাদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের হার অনেক কম। এজন্য তারা চাকরির বাজারেও অনেক পিছিয়ে পড়ে।
টেসলার সিইও ইলন মাস্ক এবং অ্যাপলের সিইও টিম কুকের মতো ব্যক্তিরা উচ্চতর কলেজ ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এতে আরও অনেক কোম্পানিও উপলব্ধি করছে, ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা তাদেরকে অসুবিধায় ফেলছে। কারণ এর ফলে তাদের শ্রমশক্তির ঘাটতি মিটছে না এবং তারা প্রয়োজনের চেয়ে কম লোক নিয়োগ দিতে বাধ্য হচ্ছে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাস করাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৫.৮ শতাংশ, যেখানে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পাস করাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল মাত্র ২.৯ শতাংশ। এর ফলে লাখ লাখ সম্ভাবনাময় কর্মী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কোম্পানিগুলো, যাদের অনেকেই কলেজ ডিগ্রি না থাকলেও দুর্দান্ত কাজ করতে পারত।
এখন বেশ কয়েকটি কোম্পানি তাদের কর্মশক্তি বাড়াতে এবং বৈচিত্র্যময় করার জন্য উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা বাতিল করেছে। ২০২২ সালে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বার্নিং গ্লাস ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ ও ২০১৯ সালের মধ্যে নিয়োগকর্তারা ৪৬ শতাংশ মাঝারি-দক্ষতা ও ৩১ শতাংশ উচ্চ-দক্ষতার চাকরির জন্য কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা বাদ দিয়েছেন।
এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে অর্থ, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, প্রকৌশল ও স্বাস্থ্যসেবা পেশায়। উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা বাতিলের বেশিরভাগ পদক্ষেপই স্থায়ী হবে বলেও মনে করা হচ্ছে।
কর্মশক্তি উন্নয়ন বিষয়ক অলাভজনক সংস্থা অপরচুনিটি অ্যাট ওয়ার্ক এর হিসাব মতে, এই কোম্পানিগুলো দেশব্যাপী ৭ কোটিরও বেশি চাকরিপ্রার্থীর মধ্য থেকে নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয়দের কর্মী বাছাই করছে। এই কর্মীরা চার বছরের কলেজ ডিগ্রি না নিয়ে বরং কাজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, হোক তা কমিউনিটি কলেজ, সামরিক সার্ভিস, বুট ক্যাম্প বা চাকরির মাধ্যমে।
বার্নিং গ্লাস ইনস্টিটিউট ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, আরও বহু কোম্পানি চাকরিতে উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা কমানোয় আগামী পাঁচ বছরে আরও ১৪ লাখ চাকরি তৈরি হবে।
উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা বাদ দিয়ে চাকরির বাজারে দক্ষতা-ভিত্তিক এই সমুদ্রসম পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে ৭টি কোম্পানি।
আইবিএম
২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিন কর্পোরেশন (আইবিএম) স্নাতক ডিগ্রির পরিবর্তে হস্তান্তরযোগ্য দক্ষতা ভিত্তিক পদগুলোর জন্য ‘নিউ কলার’ শব্দটি তৈরি করে। কোম্পানিটি জানায়, ২০২০ সালে তাদের নতুন নিয়োগের ১৫ শতাংশ ছিল এই নিউ কলার জবের জন্য। নিউ কলার জবগুলোর মধ্যে ছিল অ্যাপ ডেভেলপার, সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, সফটওয়্যার ডেভেলপার ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ।
২০২১ সালে আইবিএম ঘোষণা করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অর্ধেকেরও বেশি পদের জন্য স্নাতক ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা বাতিল করেছে।
নিউ কলার কর্মীদের সরবরাহ পাইপলাইন তৈরির জন্য প্রযুক্তি সংস্থাটি পি-টেক নামে প্রোগ্রামও চালু করেছে। এর মাধ্যমে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক প্রযুক্তিগত দক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে যোগ্যদের আইবিএমে সবেতন ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ দেওয়া হয়।
সফটওয়্যার কিউএ ইঞ্জিনিয়ার ও নেটওয়ার্ক অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পদের জন্য আইবিএমের ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা জাতীয় গড় থেকেও কম। তাদের শুধুমাত্র ৩১ শতাংশ সফটওয়্যার ডেভেলপার/ইঞ্জিনিয়ার পদের জন্য উচ্চতর কলেজ ডিগ্রি প্রয়োজন হয়। বার্নিং গ্লাস ইনস্টিটিউট বলছে, এই সংখ্যা একই ধরনের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
অ্যাকসেনচার
প্রযুক্তি পরিষেবা এবং পরামর্শে আইবিএমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অ্যাকসেনচার। ২০১৬ সালে কোম্পানিটি শিক্ষানবিশ প্রোগ্রাম চালু করে। তারপর থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১২০০ জনকে নিয়োগ দিয়েছে কোম্পানিটি, যাদের ৮০ শতাংশেরই চার বছরের কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি নেই। কোম্পানিটি এখন অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট, সাইবার সিকিউরিটি ও ক্লাউড অ্যান্ড প্ল্যাটফর্ম ইঞ্জিনিয়ারিংসহ এন্ট্রি-লেভেলের ২০ শতাংশ পদের জন্য শিক্ষানবিশদের নিয়োগ দেয়। এজন্য প্রার্থীদের উচ্চতর কোনও ডিগ্রি লাগে না।
বার্নিং গ্লাস ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন মতে, ২০২১ সালে অ্যাকসেনচার তার সফটওয়্যার কিউএ ইঞ্জিনিয়ারিং পদগুলোর মাত্র ২৬ শতাংশ পদের জন্য উচ্চতর কলেজ ডিগ্রি চেয়েছে। এই সংখ্যা একই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। কম্পিউটার সহায়তা বিশেষজ্ঞ, সফটওয়্যার ডেভেলপার/ইঞ্জিনিয়ার ও নেটওয়ার্ক অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পদের জন্য কোম্পানিটিতে ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা জাতীয় গড়ের চেয়েও কম।
ওকটা
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ইউজার অথেনটিকেশন সার্ভিস কোম্পানি ওকটা। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে এবং কর্মশক্তিকে বৈচিত্র্যময় করতে কোম্পানিটি ২০২১ সালে তাদের সেলস বিভাগের বেশ কিছু পদের জন্য কলেজ-ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়। তার পরিবর্তে দক্ষতা ও সম্ভাবনার ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগের জন্য একটি বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েট প্রোগ্রাম চালু করে।
ডেল
শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডেল উন্নতমানের ব্যক্তিগত কম্পিউটার তৈরির জন্য পরিচিত। সিএনবিসির প্রতিবেদন মতে, কোম্পানিটি এর সাইবার নিরাপত্তা, প্রকৌশল, প্রযুক্তি সহায়তা, প্রযুক্তি বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের বিভিন্ন পদে কমিউনিটি কলেজ থেকে নিয়োগ দিচ্ছে। এর জন্য ২০২১ সাল থেকে ডেল একটি দক্ষতা ভিত্তিক নিয়োগ প্রোগ্রাম চালু করেছে।
ব্যাংক অব আমেরিকা
সিএনবিসির প্রতিবেদন মতে, কোম্পানিটি এর সেলস, অপারেশন ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট বিভাগে নিম্ন আয়ের এলাকা থেকে কর্মী নিয়োগের জন্য ২০১৮ সালে একটি পাথওয়ে প্রোগ্রাম চালু করেছে। এর মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে ২০ হাজার কর্মী নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সংস্থাটি বলেছে, তারা তাদের বেশিরভাগ এন্ট্রি-লেভেল চাকরির জন্য উচ্চতর কলেজ-ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা বাতিল করেছে।
গুগল
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন মতে, তথ্যপ্রযুক্তি জায়ান্ট গুগল ২০২২ সালে তাদের নির্দিষ্ট কিছু পদের জন্য উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা বাদ দেয়। এন্ট্রি-লেভেল পদের জন্য গুগল তার অনলাইন সার্টিফিকেট প্রোগ্রামকেই চার বছরের ডিগ্রির সমতুল্য হিসেবে গণ্য করছে।
বার্নিং গ্লাস ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ২০১৭-২০২১ সালের মধ্যে গুগলের চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলোর ২৩ শতাংশেই স্নাতক ডিগ্রির কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। এর আগে মাত্র ৭ শতাংশ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে স্নাতক ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা থাকতো না। তার মানে স্নাতক ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা ৯৩ শতাংশ থেকে ৭৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
ডেল্টা এয়ারলাইনস
এভিয়েশন স্কুল নর্থ সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ডেল্টা এয়ারলাইনস ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে তাদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পাইলট পদের জন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা বাদ দিয়েছে। এর আগে তাদের প্রতিযোগী সাউথওয়েস্ট, ইউনাইটেড ও আমেরিকান এয়ারলাইনসও একই পদের জন্য কলেজ-ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা বাতিল করে। প্রতিষ্ঠানটিতে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। এজন্য নতুন পাইলটদের প্রলুব্ধ করতে বেতন বাড়ানোসহ আঞ্চলিক ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে।
দ্য সেন্টার স্কয়ারের প্রতিবেদন মতে, ২০১৯ সালে ডেল্টার চার হাজার চাকরির বিজ্ঞাপনের ৯০ শতাংশেই উচ্চতর কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না।
তথ্যসূত্র: বিজনেস ইনসাইডার