রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার পরপরই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার পেছনে দায়ী ব্যক্তি ও কারণ চিহ্নিত করা গেছে। কিন্তু প্রথমটি অর্থাৎ সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে কলামনিস্ট, মনোবিদ ও নেটিজানরা এখন পর্যন্ত নানা মতে বিভক্ত।
কেউ যদি বাংলাদেশের শো-বিজের সবচেয়ে আলোচিত আত্মহত্যার ঘটনাটি খুঁজতে চান, তাহলে অবশ্যই তালিকার প্রথম নামটি আসবে চিত্রনায়ক সালমান শাহ। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে ঢাকার ইস্কাটনে নিজ বাসভবনে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নানা রহস্যময়তায় ঘেরা এই নায়কের মৃত্যু নিয়ে দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় বিতর্কের পরে ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশের তদন্ত বিভাগ নিশ্চিত করে, তিনি আত্মহত্যাই করেছিলেন।
ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে এই নায়ক আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন বলেই হয়তো অনেকের কাছে বিস্ময় ছিল- কেন তিনি নিজেকে এভাবে শেষ করে দিলেন! তার মৃত্যু নিয়ে নানা জল্পনার ডালপালার বিস্তার ঘটে। মৃত্যুর আগে যে সুইসাইড নোট সালমান শাহ লিখেছিলেন তাতে তার স্বাক্ষর ছিল না। সেখানে মৃত্যুর কোনও কারণও লেখা ছিল না।
লেখা ছিল- “আমি চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার। পিতা কমরুদ্দীন আহমেদ চৌধুরী। ১৪৬/৫, গ্রীন রোড, ঢাকা #১২১৫ ওরফে সালমান শাহ এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে, আজ বা আজকের পরে যে কোনো দিন আমার মৃত্যু হলে তার জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে আমি আত্মহত্যা করছি।”
২০২৪ সালের ১৩ মার্চে সাদি মহম্মদের আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ছিল বাংলাদেশের মিডিয়ায় সবশেষ আত্মহত্যার উদাহরণ। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সালমান শাহ এবং সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার মধ্যে রয়েছে প্রকৃতিগত এক মিল। আর এ অন্তঃমিলের কারণ খুঁজতে অবশ্যই আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলোর চাহিদা সোপানটিতে আরেকবার আলো ফেলতে হবে।
মাসলোর এই চাহিদা সোপানটি দিয়ে এই দুই মৃত্যুর ব্যাখ্যার আগে বাংলাদেশের শো-বিজ জগতে যারা আত্মহত্যা করেছেন, তাদের তালিকা ও মৃত্যুর কারণগুলো একনজর দেখে আসাটা জরুরি।
বাংলাদেশের শো-বিজে আত্মহত্যাকারীরা
সালমান শাহের আগে বাংলাদেশের শো-বিজে আত্মহত্যার শুরুটা সম্ভবত অভিনেত্রী ডলি আনোয়ারকে দিয়ে। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেন। স্বামীর অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াই তার আত্মহত্যার কারণ বলে জানা যায়। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’তে জয়গুন চরিত্রে অভিনয় করে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছিলেন ডলি।
২০১১ সালে শো-বিজের একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও মডেল মিতা নূরের আত্মহত্যায় দ্বিতীয়বারের মতো থমকে দিয়েছিল বাংলাদেশের শো-বিজকে। অভিযোগ রয়েছে, তার ক্ষেত্রেও কারণ ছিল স্বামীর অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। তার জের ধরে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন এ জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেত্রী।
এভাবে একে একে আরও তারকাদের নাম যোগ হয়েছে আত্মহত্যাকারীর তালিকায়।
২০১৩ সালের গলায় ফাঁস নেন লাক্স তারকা সুমাইয়া আসগর রাহা। এই মৃত্যুর কোনও কারণ কেউ জানে না এখনও।
২০১২ সালে মডেল অভিনেতা মইনুল হক অলি, ২০১৪ সালে সঙ্গীতশিল্পী পিয়াস রেজা, একই বছরে হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিন রাত্রি’ ধারাবাহিক নাটকের টুনি চরিত্র রূপদানকারী অভিনেত্রী লোপা নায়ার এবং ২০১৫ সালে অভিনেত্রী নায়লা বেছে নেন আত্মহননের পথ।
এ সব ঘটনাই পারিবারিক অশান্তির কারণে ঘটেছে বলে মনে করছে পুলিশ।
২০১৭ সালে পরের আলোচিত শো-বিজের আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটান উঠতি মডেল জ্যাকুলিন মিথিলা। জ্যাকুলিন মিথিলা সিনেমা বা নাটকের জগতের কেউ ছিলেন না। সোশাল মিডিয়ায় খোলামেলা পোশাক পরে ছবি বা ভিডিও দেওয়ার কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই হয়ে উঠেছিলেন পরিচিত এবং সমালোচিত। তার আসল নাম ছিল জয়া শীল। তার বাবার বরাতে তখন জানা গিয়েছিল, শ্বশুরবাড়িতে বিয়ে মেনে না নেওয়ায় তিনি আত্মহত্যা করেছেন। জ্যাকুলিন মিথিলাও গলাও ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।
ওই বছর জুলাই মাসে আত্মহত্যা করেন মাইলস ব্যান্ডের কিবোর্ডিস্ট মানাম আহমেদের ছেলে জাহিন আহমেদ। ব্যান্ড ম্যাকানিক্স এর গিটারিস্ট জাহিনের মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। র্যাম্প মডেল ও অভিনেত্রী রিসিলা বিনতে ওয়াজও এ মাসেই বেছে নেন পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার একই রাস্তা। তার মৃত্যুর কারণ অবশ্য দাম্পত্য কলহ।
অভিযোগ রয়েছে, একই কারণে ২০১৮ সালে চিত্রপরিচালক শামীম আহমেদ রনির সাবেক স্ত্রী ও অভিনেত্রী তমা খান গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
২০২০ সালে তরুণ মডেল ও অভিনেত্রী লরেন মেন্ডেস এবং ২০২৩ সালে হোমাইরার হিমুর আত্মাহুতি শো-বিজ জগতের পরের দুইটি আঘাত। এ দুইটির পেছনেও রয়েছে দাম্পত্য বা প্রেমের কলহ।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ২০১১ সালের পর সেলেব্রিটির আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়েছে। তবে একটা বিষয় এখানে লক্ষ্যণীয় যে, যেসব সেলেব্রিটিরা আত্মহত্যা করেছেন তারা কেউই ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় ছিলেন এবং প্রায় সবার ক্ষেত্রেই প্রেম কিংবা দাম্পত্য দ্বন্দ্বের প্রাধান্য ছিল।
সালমান শাহের মৃত্যুতেও প্রেমে ব্যর্থতা কিংবা পরকিয়া প্রসঙ্গ এসেছিল। তবে তা না-ও হতে পারে। যদি সেটা নাই হয়, তবে সাদি মহম্মদের মৃত্যুর কারণের সঙ্গে তার চলে যাওয়ার কারণও মিলে যাবে।
কণ্ঠশিল্পী সাদি মহম্মদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশকে দাঁড়াতে হয়েছে একটি নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি। তবে কি তিনি অভিমানে মৃত্যু বেছে নিলেন?
এই মৃত্যুর সঙ্গে জীবনানন্দের মতো জীবনের প্রতি উদাসীনতার যোগ রয়েছে কি? এ প্রশ্ন উঠছে বারবার।
মাসলোর চাহিদা সোপান এবং সেলেব্রিটিদের আত্মহত্যা
বিখ্যাত আমেরিকান মনোবিদ আব্রাহাম মাসলোর চাহিদা সোপান বা পিরামিডটিতে রয়েছে ৫টি ধাপ। সব থেকে নিচ থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে ধাপগুলো হলো- ১. শারীরিক বা শরীরবৃত্তীয় প্রয়োজন; ২. নিরাপত্তা; ৩. সামাজিক প্রয়োজন; ৪. আত্মতৃপ্তির প্রয়োজন; এবং ৫. সৃজনশীলতা ও বিশেষ অবদানের প্রয়োজন।
খাওয়া-দাওয়া ও বেঁচে থাকার জন্য যা দরকার সেটি-ই মাসলোর চাহিদা পিরামিডের প্রথম অংশ। দ্বিতীয় ধাপটি বাসস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলে। ৩ নম্বর ধাপটি বলে- সামাজিক প্রয়োজন বা ভালোবাসার কথা। ৪. আত্মতৃপ্তি হচ্ছে সেই ধাপটি যে ধাপে কেউ একজন তার কাজ করতে পেরে, মনে মনে সন্তুষ্টি লাভ করেন। আর পঞ্চম ধাপটি হচ্ছে সৃজনশীলতা ও বিশেষ স্বীকৃতির চাহিদা।
সারা পৃথিবীর সেলেব্রিটি বা তারকাদের ক্ষেত্রে মাসলোর চাহিদা সোপানের চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপটি প্রযোজ্য। এর অর্থ হচ্ছে সুখ বা বেঁচে থাকার প্রেরণাই তাদের মূল প্রয়োজন। তাহলে তারা এত আত্মহত্যা করেন কেন? তারা কি সুখী নন?
বাংলাদেশের তারকাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সাদি মহম্মদই সন্দেহাতীতভাবে চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের কোনও একটি চাহিদা পূরণের অভাবে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু এ পর্যায়ে তিনি আসলেন কীভাবে?
সেলেব্রিটিদের আত্মহত্যার সুলুক সন্ধান
প্রত্যেক মানুষের আত্মহত্যার পেছনেই রয়েছে অসুখী ও বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত হওয়া। সেলিব্রেটিরা যেহেতু মানুষের বাইরে নন, কাজেই তাদের আত্মহত্যার ব্যাপারটিও একই রকম। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণাও হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোতে।
সুখ বনাম অসুখ
সুখ অনেকের কাছেই একটি সাধারণ শব্দ হতে পারে। কিন্তু সুখের সংজ্ঞা বেশ জটিল।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডি অব অ্যাডাল্ট ডেভেলপমেন্ট ৭২৪ জন পুরুষকে দুইটি দলে ভাগ করে ৭৫ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ চালায়। পরে তাদের স্ত্রীদেরও গবেষণার আওতায় আনা হয়। এমনকি ওই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের সন্তানসন্ততিদের ২ হাজার জনের ওপরও গবেষণার প্রয়োজনে জরিপ চালানো হয়। মূলত সুখের স্বরূপ আবিষ্কারে ওই গবেষণা চালানো হয়েছিল।
২০১৭ সালে হার্ভার্ড গেজেটে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে গবেষণার পরিচালক রবার্ট ওয়াল্ডিংগার বলেন, “গবেষণায় আমরা যে আশ্চর্য ফলটি পেয়েছি তা হলো- আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে আমরা কতোটা সুখী, তার ওপর নির্ভর করে আমাদের স্বাস্থ্য কতটা ভালো।”
ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের মনোরোগবিদ্যার অধ্যাপক ওয়াল্ডিংগার টেড সিরিজের এক বক্তৃতায় বলেন, “যখন আমরা ৫০ বছর বয়সে তাদেরকে (গবেষণা যাদের ওপর চালানো হয়) আমাদের সামনে একত্রিত করেছিলাম তখন তাদের বয়স বা সুস্থতা নির্ধারণের জন্য এটা দেখিনি যে তাদের শরীরে কোলেস্টরেলের মাত্রা কত বেশি। বরং তারা কতটা সুখি সেটি যাচাইয়ের চেষ্টা করেছি। যারা বেশি সুখি ছিলেন তারা ৮০ বছর বয়সেও সবচেয়ে সুস্থ ছিলেন।”
তার মানে এ গবেষণায় থেকে দেখা যাচ্ছে যে, মাসলোর চাহিদা সোপানের তৃতীয় স্তরটি সুখি থাকার জন্য এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দাম্পত্য সম্পর্ক এবং অন্যান্য ভালোবাসার সম্পর্ক শারীরিক যন্ত্রণাকেও কমিয়ে দিতে পারে। এর মানে যে মানসিক ব্যথার কারণে মানুষ আত্মহত্যার দিকে যায়, সেটি ভালো সম্পর্কের মাধ্যমে কমানো যায়। বাংলাদেশের আত্মহত্যা করা সেলিব্রেটিদের ৯৫ শতাংশের বেশি ঠিক তৃতীয় সোপানটিতেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।
নিঃসঙ্গতা সব মানুষের একই
‘একাকিত্ব হত্যা করে। এটি ধূমপান বা মদ্যপানের মতোই শক্তিশালী’, ওয়াল্ডিংগার ২০১৭ সালে টেড টকে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে বলেছিলেন, বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যেও সাধারণ মানুষের মতোই একাকিত্ব কাজ করে।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার কেট স্পেড আত্মহত্যা করেন। কেট স্পেডের প্রচারণা বিষয়ক প্রধান রব শুটার, এক্সট্রা টিভিতে (একটি সেলিব্রেটি টিভি সিরিজ) এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “কেট সত্যিই বিচ্ছিন্ন এবং একাকি ছিলেন। তার জীবনের শেষ দিকে, তার একজন গৃহকর্মী ছিল, তার সহকারী ছিল এবং তার সন্তান ছিল এবং আমি মনে করি এটিই ছিল অনেক বেশি। কিন্তু কেটের খুব বেশি বন্ধু ছিল না।” এভাবেই কেটের বন্ধুহীনতা ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের তারকা শেফ অ্যান্টনি বোরডেইনও ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করেন। তার প্রাক্তন বান্ধবী পাওলা ফ্রোইলিচ তার মৃত্যু সম্পর্কে টুইট করেছেন, “আপনি অনেক ধনী হতে পারেন, সম্পূর্ণ সফল কিন্তু একাকী…।” বোরডেইন অবশ্য একসময় মাদকাসক্ত ছিলেন। পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলেন। তবে সমস্যা যে কাটেনি সেটি তার আত্মহননের পথ বেছে নেওয়াই প্রমাণ করে।
২০০৯ সালের একটি ছোট-নমুনা সমীক্ষা অনুসারে, “শীর্ষে থাকা ব্যক্তিরা জনস্বীকৃতির দ্বীপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন। যার ফলে হয়ে যান একাকি।”
সেলিব্রেটিরা, তাদের খ্যাতির উচ্চতায় পৌঁছে সত্যিকার অর্থেই বিচ্ছিন্নতা এবং জনসাধারণের অযৌক্তিক প্রত্যাশা পূরণের অনুভূতির কারণে উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার শিকার হন।
মনোবিশ্লেষক ফ্রিদা ফ্রম–রাইখম্যানের কাজ
বিশ্বব্যাপী প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে বলে জানাচ্ছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। এর এক শতাংশেরও কম খবরের শিরোনাম হয়। স্পষ্টতই, বিশ্বব্যাপী ঘটে চলা আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে ফাঁক রয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপি যত রোগে মানুষ মারা যান, তার মধ্যে আত্মহত্যার অবস্থান ১৭ তম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, “প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ আত্মহত্যার কারণে মারা যান। আরও অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বিশ্বব্যাপী ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ আত্মহনন।”
কেট স্পেড, রবিন উইলিয়ামস এবং অ্যান্টনি বোর্ডেইনের মতো সেলেব্রিটিরা যখন তাদের নিজের জীবন নেয়, তখন বিশ্ব হতবাক হয়ে যায়। টাকা-পয়সা, যশ-বিত্ত সবই ছিল তাদের, তাহলে কেন? কেন এমন একটি চরম পদক্ষেপ তারা নিলেন!
১৯৫০ সালে মনোবিশ্লেষক ফ্রিদা ফ্রম-রাইখম্যানের আবেগগত বিচ্ছিন্নতাবোধ বা একাকিত্ব নিয়ে যুগান্তকারী কাজ রয়েছে। কোনও রোমান্টিক একাকিত্বের ধারণা নিয়ে নয়, বরং জনসমাগমে থেকেও মানসিক যোগাযোগ স্থাপনের, নিজেকে বুঝতে-বোঝাতে পারানোর আকুলতা নিয়েই রাইখম্যানের কাজ।
প্রত্যেকেরই জীবনে এরকম কিছু বিচ্ছিন্নতাবোধের মুহূর্ত আসে। কিন্তু প্রকৃতি এসব মুহূর্তকে মোকাবেলা করার মতো করেই মানুষকে তৈরি করেছে। আমরা এসব মুহূর্তের মুখোমুখি হলে, গ্রামে বেড়াতে যাই, প্রিয়জনকে ফোনে কল করে স্নায়ু শান্ত করি। আর এতেই আমাদের স্নায়ুর উত্তেজনা প্রশমিত হয়।
প্রকৃতি মায়েদের নিজ সন্তানের এই আবেগ ধারণ করা এবং বোঝার উপযোগী করে বানিয়েছে। আর তাই আত্মহত্যার বড় কারণগুলোর পেছনে ব্রোকেন ফ্যামিলি, কড়া শাসনকারী বা শারিরীকভাবে নির্যাতনকারী বাবা-মা এবং বাজে পারিবারিক সম্পর্ক থাকতে পারে।
আমরা বলতে ভালোবাসি কোনও মানুষই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। কিন্তু বাস্তবে সব মানুষই একটা একটা দ্বীপের মতোই একা।
প্রয়াত রাইখম্যানের গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই অধ্যাপক জন ক্যাসিওপ্পোর হাত ধরে সামাজিক নিওরোসায়েন্সের কাজের পরিধি বেড়েছে। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর কগনিটিভ অ্যান্ড সোশাল নিওরোসায়েন্স বিভাগের প্রধান ছিলেন জন ক্যাসিওপ্পো। দুই যুগেরও বেশি সময় নিয়ে কাজ করছেন ‘একাকিত্ব’ নিয়ে। লিখেছেন ‘লোনলিনেস: হিউম্যান নেচার অ্যান্ড দ্য নিড ফর সোশাল কানেকশন’ শিরোনামে বই।
ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানে দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেন, “উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিচ্ছিন্নতা (Objective loneliness) এবং বিচ্ছিন্নতা বোধ (Percieved loneliness) এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগেই আমরা জেনেছি পরেরটি অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতা বোধ আসলে একাকিত্ব।
এ বিষয়ে বিলিয়নেয়রদের উদারহরণ টেনে তিনি বলেন, “সবাই তাদের বন্ধু হতে চাইলেও, বিলিয়নিয়ারের চোখে এই সম্পর্কটি গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা তার কাছে হয়তো এইসব বন্ধুত্ব ফায়দা হাসিল করার পন্থা মাত্র।”
“আমি মনে করি একাকিত্ব অনেকটা ব্যথা, ক্ষুধা ও তৃষ্ণার অনুভূতির মতো। আমাদের কাছে কিন্তু এর বিকল্পও নেই।”
বিজ্ঞান ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে যে, একজন ব্যক্তির ক্রনিক একাকিত্বে ভোগার সম্ভাবনা জিনেটিক্সের ওপরও নির্ভর করে। এর সঙ্গে যোগ হয় মদ ও মাদকের নেশা। এছাড়া কম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ব্যক্তিরাও রয়েছেন, যারা খুব সহজেই আত্মহত্যায় প্ররোচিত হন।
কিন্তু, এমন বুদ্ধিমান ও দৃঢ়চেতা লোকও আছেন, যারাও শেষ পর্যন্ত জীবন চালিয়ে যাওয়াকে কঠিন মনে করেন।
অনেকেই বলেন যে, আত্মহত্যা একটি তাৎক্ষণিক আবেগপ্রবণ কাজ। কিন্তু আসন্ন বিপদ বা ব্যথার যে কোনও পরিস্থিতিতে ‘লড়াই’ করার সহজাত প্রবৃত্তি তো মানুষের জিনেই রয়েছে। কাজেই স্বেচ্ছায় মারাত্মক আত্ম-ক্ষতি ঘটানোর সিদ্ধান্ত সেই নিছক ‘আবেগপ্রবণ হওয়ার চূড়ান্ত মুহূর্তে’র অনুমানকে অস্বীকার করে।
গভীর একাকিত্ব এবং হতাশার অন্ধকার থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসে বলে মনে করছেন অনেক বিজ্ঞানী।
লেখক অ্যান্ড্রু সলোমন ২০১৪ সালে দ্য নিউ ইয়র্কারের তার এ বিষয়ক মন্তব্যে বলেছিলেন, এটি সফল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও সত্য। তারা অসম্ভব উচ্চ মান নির্ধারণ করে – বেঞ্চমার্ক, যা তাদের কিছু স্তরে অপ্রতুলতার অনুভূতিতে আরও বেশি করে ঠেলে দেয়।
তিনি লিখেছেন, “একাকিত্বের একটি ‘অপরাধ’ হলো আত্মহত্যা, এবং প্রশংসিত ব্যক্তিরা ভয়ঙ্করভাবে একা হতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে বুদ্ধিমত্তা সাহায্য করে না; উজ্জ্বলতা মানুষকে সুদূরতম জায়গায় বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।”
“…যতবার কেউ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সুখ অগ্রিম অনুমান করা যায় না অথবা চাইলেই পাওয়া যায় না, তখনই আশা চুরমার হয়ে যায়- আমরা সবাই আমাদের নিজেদের ত্রুটিপূর্ণ মস্তিষ্কে বন্দি; আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে চূড়ান্ত একাকিত্ব দানা বেঁধে ওঠে এবং অবশেষে এটি অলঙ্ঘনীয় হয়ে দাঁড়ায়।”
তাহলে উপায় কী বাঁচার?
সামাজিক স্নায়ু ও মনোবিজ্ঞান বিচ্ছিন্নতা ও সংযোগহীনতা নিয়ে কাজ করছে। জন ক্যাসিওপ্পোর দাবি, এটিতে সাফল্যও পাওয়া যাচ্ছে। তবে অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে এখন বেশি একাকিত্বের মহামারীটি ঠিকঠাকভাবে বোঝার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে । এর কোনও রাতারাতি সমাধান নেই। একমাত্র কাজ হলো, হয় সাহায্য চাওয়া বা সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকা।
হতাশা ও বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো কী?
লাইফ সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং সেন্টারের ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ড. মরাবেত জিহেনের মতে, “ব্যক্তি অসহায়, ক্রমাগত দুঃখিত এবং উদ্বেগ বোধ করবেন। তারা বলবেন, যে তারা শূন্যতা অনুভব করছেন। নিজের ওপর কিছুটা বিরক্তিও প্রকাশ করতে পারে। এবং অপরাধবোধও যোগ হতে পারে। … কেননা তারা সর্বদা ভাবেন যে তাদের ভেতরে সমস্যা রয়েছে।”
কারও কারও ক্ষেত্রে দুর্বল একাগ্রতা এবং স্মৃতিশক্তিহীনতার ঘটনাও ঘটে। অনেকে জিনের কারণে শিশুকাল থেকেই এতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
জার্মান নিউরোসায়েন্স সেন্টারের ড. ড্যানিয়েলা গ্রাফ বলছেন, “অনেক ডিপ্রেশনে আক্রান্ত শিশুর অ্যাটেনশন ডেফিসিট/হাই আ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি) পরীক্ষার ফলাফলেও অস্বাভাবিকতা আসে।”
অর্থাৎ এডিএইচডি ব্যধি মনোযোগ-ঘাটতি ও অতি সক্রিয়তাকে বোঝায়। বিষণ্ণতার অন্যান্য উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে- এক সময়ের পছন্দের জিনিসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, বন্ধু বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, দুর্বল অনুভব করা, খাওয়ার ও ঘুমের অনিয়ম ইত্যাদি। হজমের সমস্যা বা মাথাব্যথা হতে পারে আরেক উপসর্গ।
আত্মঘাতী হওয়ার জন্য শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, সম্পর্কের সমস্যা, কাজের চাপ, আর্থিক চাপ, আইনি ঝামেলা এবং পারিবারিক সমস্যা মূলত দায়ী। অনেক সময় একাধিক কারণও দায়ী হতে পারে।
সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রে নিখুঁত বা পরিপূর্ণ হওয়ার চাপ থাকে। আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী সিডনি ব্ল্যাট তার এক প্রবন্ধে নিখুঁত বা পারফেকশনিস্ট হওয়ার চাপের সঙ্গে আত্মহত্যার একটি যোগসূত্র তুলে ধরেছেন।
মোদ্দাকথা লক্ষণগুলোর প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখলেই অনেকাংশে আত্মহত্যা রোধ করা সম্ভব, এমনকি সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।
আত্মহত্যা এবং কোরিয়ান সেলিব্রেটি
আত্মহত্যা প্রবণ দেশগুলোর তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে আফ্রিকার দেশগুলো। ধরেই নেওয়া যায়, সেইসব দারিদ্রপীড়িত দেশে মাসলোর চাহিদা সোপানের নিচের দুইটি ধাপ- মৌলিক চাহিদা ও নিরাপত্তার অভাব মানুষকে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। তবে সেলেব্রিটি বা তারকা জগতের আত্মহত্যায় সম্ভবত সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া।
কোরিয়ান সেলেব্রিটিদের আত্মহত্যার প্রবণতার খবর পুরোনো। কোরিয়ার বিনোদন সাংবাদিক কিম দায়ে তার সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারে অন্তত ৩০টি সেলিব্রেটির আত্মহত্যা নিয়ে রিপোর্ট করার কথা দাবি করেছেন ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত তার এক নিবন্ধে। শিরোনামটাও এরকম- ‘আই হ্যাভ রিপোর্টেড অন থার্টি কোরিয়ান সেলেব্রেটি সুইসাইডস। দ্য ব্লেম গেইম নেভার চেইঞ্জ।”
সাংবাদিক কিম লিখেছেন, “৩০ বছর ধরে আমি কোরিয়ার বিনোদন জগত নিয়ে রিপোর্ট করছি। এরই মধ্যে ৩০টি আত্মহত্যা নিয়ে একাই কাভার করেছি, এবং আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি এটা দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজের একটি সংকট।”
অনলাইন ম্যাগাজিন মিডিয়াম বলছে, এই আত্মহত্যা প্রবণতা বিশেষ করে তাদের কে-পপ ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের মধ্যে প্রবল। নিখুঁত স্টেইজ পারফরম্যান্স দিয়ে দুনিয়া মাত করে রাখা কে-পপ তারকারাও যে ভুগতে পারেন বিষণ্ণতায় একথা কে বলবে! কিন্তু ‘হোয়াই ডু সো মেনি কোরিয়ান স্টারস কমিট সুইসাইড’ শিরোনামের লেখায় লেখক ওয়াই যে জান তুলে আনেন কোরিয়ান পপ ইন্ডাস্ট্রির ভিন্ন এক দিক।
ওয়াই যে জান এর মতে, কে-পপ তারকাদের ভক্ত অনুরাগীদের পক্ষ থেকে আরও বেশি ‘হাই স্টান্ডার্ডস’ অর্থাৎ নিখুঁত হবার চাপ তো আছেই, আছে অনলাইনে হেনস্তা হওয়ার মতো ভুরি ভুরি ঘটনা। এই নিখুঁত হওয়ার ‘স্টান্ডার্ড’ ঠিক করে দিচ্ছে এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানিগুলোও।
এ দুটো সামলাতে না পেরে নিজেদের শেষ করে দেওয়ার পথে হাঁটছেন কোনও কোনও কে-পপ তারকা।
কে-পপ তারকা মুনবিনের ঘটনাটিই উল্লেখ করা যাক। এক সন্ধ্যায় তার ম্যানেজার তার নিথর দেহ আবিষ্কার করে মুনবিনের নিজ অ্যাপার্টমেন্টে। ধারণা করা হয় তিনিও হেঁটেছেন আত্মহত্যার পথে। অথচ ঠিক তার আগের দিন মুনবিন নাকি ভক্ত অনুরাগীদের অনলাইনে মোটিভেশনাল স্পিচ দিচ্ছিলেন।
তবে কোরিয়ায় এই আত্মহত্যা প্রবণতা কে-পপ ইন্ডাস্ট্রি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আরও নানান ক্ষেত্রে। এই তালিকায় আছেন অভিনয় শিল্পী, কমেডিয়ান এমনকি রাজনীতিবিদও।
ওয়াই যে জান বিশেষভাবে উল্লেখ করেন কোরিয়ান কমেডিয়ান পার্ক জি সানের কথা, যাকে তার মায়ের সঙ্গেই নিজ ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
কোরিয়ান পুলিশ তদন্তে কোন হত্যার আলামত না পাওয়ায় একে আত্মহত্যা বলে ঘোষণা দেয়। এখানে সাদি মহম্মদের সঙ্গে তার একটি মিলও রয়েছে। মায়ের মৃত্যুতে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন সাদি মহম্মদও।
লেখক তার বিশ্লেষণধর্মী ওই লেখায় আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ান সমাজ এবং বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিকেই দায়ী করেন।
ওয়াই যে জান এর একই সুরে পরিসংখ্যান কথা বলছে। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আত্মহত্যার হারে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান চতুর্থ।
আবার বিশ্বব্যাংকের দেওয়া ডেটা অনুযায়ী ওইসিডি ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আত্মহত্যার হারে দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম।
আত্মহত্যা ও ‘দ্য বিয়াথা ইফেক্ট’
‘দ্য বিয়াথা (ইংরেজিতে Werther) ইফেক্ট ফলোয়িং দ্য সুইসাইডস অব থ্রি কোরিয়ান সেলিব্রিটিস (২০১৭-২০১৮): অ্যান একোলজিকাল টাইম-সিরিজ স্টাডি’ শিরোনামের গবেষণা পত্রে উঠে এসেছে কিছু চমকপ্রদ তথ্য।
লি হিউন কিম এবং জিয়ং মিন লিসহ দক্ষিণ কোরিয়ার বেশ কয়েকজন গবেষকের একটি যৌথ দল গবেষণাটি করেন।
কী এই ‘বিয়াথা ইফেক্ট’?
সংবাদ মাধ্যমে আত্মহত্যার ঘটনা প্রকাশের পর সমাজে বেড়ে যায় আত্মহত্যা। একে বলা হচ্ছে, বিয়াথা ইফেক্ট। একে কপিক্যাট সুইসাইডও বলা হয়। গবেষক ডেভিড ফিলিপস ১৯৭৪ সালে প্রথম শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। জার্মান মহাকবি গোথের (যিনি আমাদের দেশে গ্যেটে বা গেয়েটে নামেই পরিচিত) একটি উপন্যাস থেকে শব্দটি ধার করেন তিনি।
১৭৭৪ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সরোজ অব ইয়াং বিয়েথা’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বিয়েথা এক নারীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করে। এই উপন্যাস প্রকাশের কিছুদিন পরই জার্মানির অনেক যুবক ঠিক একই ভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। উপন্যাসে আত্মহত্যার নিখুঁত ও বিস্তৃত বর্ণনা ছিল। ফলে অনেক দেশই গোথের এই উপন্যাসটি বাজেয়াপ্ত করে।
ফিলিপ তার গবেষণায় দেখান যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একবার একটি সংবাদপত্র আত্মহত্যার ঘটনা রিপোর্ট করার পরে হুট করে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে যায়। তার মতে, আত্মহত্যার ঘটনাকে যত বেশি প্রচার করা হবে, আত্মহত্যার সংখ্যা তত বাড়তে থাকবে।
আর দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষক দলের ওই গবেষণা আবর্তিত হয়েছিল ৩ কোরিয়ান সেলিব্রেটির আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে।
এই তিন সেলেব্রিটি হলেন- গায়ক ও গীতিকার কিম জংহিউন, অভিনেত্রী চোই জিন রি ওরফে সুলি এবং গায়িকা গু হারা।
গবেষকরা দেখান যে, তিন সেলেব্রিটির আত্মহত্যার পর আত্মহত্যার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।
আত্মহত্যার হার পুরুষদের তুলনায় বেশি ছিল নারীদের মধ্যে। ১০ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের আত্মহত্যার হার অন্যান্য বয়সীদের তুলনায় বেশি ছিল।
গবেষণায় উঠে আসে আরও একটি দিক। সেটি হলো- তিন সেলেব্রিটির প্রত্যেকের আত্মহত্যার পরের ১০ সপ্তাহে আত্মহত্যার গড় সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় ছিল বেশি।
জংহিউনের আত্মহত্যার পর দ্বিতীয়,পঞ্চম থেকে সপ্তম এবং দশম সপ্তাহে আত্মহত্যার সংখ্যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় ছিল বেশি।
একইভাবে, সুলির আত্মহত্যার পর, ১ম থেকে-১০ম সপ্তাহের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা অন্যান্য বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়ে যায় আশঙ্কাজনক হারে।
ঠিক তেমনি, হারা গু’র আত্মহত্যার পর, ১ম থেকে ৭ম সপ্তাহে আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায়।
অর্থাৎ ‘বিয়াথা ইফেক্ট’ অনুযায়ী, কোনও সেলেব্রিটির আত্মহত্যার খবর সেইসব সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে যাদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা রয়েছে। উন্নত বিশ্বে ইতিমধ্যে এই ইফেক্টের কথা স্মরণ রেখেই তারকাদের আত্মহননের খবর ছাপাতে কিছু গাইডলাইন ধরে এগোনো হয়।
অবন্তিকার আত্মহত্যা এবং সাদি মহম্মদ
সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার একদিন পরেই একই পথ বেছে নেন ফাইরুজ অবন্তিকা। মৃত্যুর পরপরই তার ফেইসবুক পেইজের আত্মহত্যার ঘোষণা দেওয়া পোস্টটি ভাইরাল হয়। তার পোস্টটি শুরু হয়েছে এভাবে,
‘আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই…’। অর্থাৎ যখন তিনি পোস্ট লিখছিলেন তখন আত্মহত্যার কথা হয়তো মাথাতে ছিল না।
শেষে এসে অবন্তিকা সরাসরি আত্মহত্যার ঘোষণা দিয়েছেন-
“…আমি উপাচার্য সাদেকা হালিম ম্যামের কাছে আপনি এই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে আপনার কাছে বিচার চাইলাম। আর আমি ফাঁসি দিয়ে মরতেসি। আমার ওপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এতো ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইছিলাম!”
তিনি কি ফেইসবুক পোস্ট লিখতে লিখতে এই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন! আগেই থেকেই একটি সামাজিক ও নিরাপত্তার চাপ তিনি অনুভব করছিলেন। মাসলোর চাহিদা তত্ত্ব অনুযায়ী, তিন নম্বর ধাপ।
সাদি মহম্মদের সঙ্গে এই মৃত্যুর যোগাযোগটা কোথায়? যোগাযোগটা ‘বিয়াথা ইফেক্টে’ হয়তো। একদিন আগে সাদি মহম্মদের আত্মহত্যার বিষয়টি কি কাজ করেছে অবন্তিকার মাথায়!
আমাদের দেশে এ নিয়ে তেমন গবেষণা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি অবশ্য।