“এই দলের অনেক দূর যাওয়ার সামর্থ্য আছে। আমরা যে দারুণ কিছু করব, এতে আমার কোনও সন্দেহ নেই।”- স্পেনের বিপক্ষে ড্রয়ের পর এভাবেই সমর্থকদের বিশ্বাস রাখতে বলেছেন ব্রাজিল কোচ দোরিভাল জুনিয়র। বিশ্বাসের বীজ তিনি ইতিমধ্যে ব্রাজিলিয়ানদের মনে বুনে দিয়েছেন। ইউরোপিয়ান পরাশক্তি ইংল্যান্ডকে হারানোর পর স্পেনের সঙ্গে ড্র করে নতুন কোচ দিয়েছেন সেলেসাও সাফল্যের নতুন বার্তা।
গত ২৩ মার্চ ওয়েম্বলি দিয়ে ব্রাজিল অধ্যায় শুরু করেছেন দোরিভাল। তিন দিন পর সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে দ্বিতীয়বার দাঁড়িয়েছিলেন ডাগ আউটে। মাত্র দুই ম্যাচ দিয়ে কি একজন কোচ নিয়ে মাতামাতির সুযোগ আছে? ম্যাচ সংখ্যায় হয়তো খুশির জোয়ারে ভেসে যাওয়ার সুযোগ নেই, তবে যে দুই দলের বিপক্ষে ব্রাজিল খেলেছে, সেই প্রতিপক্ষদের দিকে তাকালে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেই পারেন ব্রাজিলিয়ানরা। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে টানা তিন ম্যাচ হারা একটা দলকে নিয়ে প্রথম অভিযানে যিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন ফুটবলে আসছে ‘নতুন ব্রাজিল’।
কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দোরিভাল
২০২২ কাতার বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনও নতুন শুরুর পরিকল্পনা করেছিল। দেশের ভেতর যেমন ইউরোপীয় কোচ নিয়োগের দাবি উঠেছিল তেমনি সিবিএফ-ও সেটাকেই পথ ভেবে নিয়েছিল। সাফল্যের খোঁজে তারা ঐতিহ্য ভাঙ্গারও চেষ্টা করেছিল। দেশি কোচে আস্থা হারিয়ে ৫৮ বছর পর বিদেশি কোচের হাতে ব্রাজিল ফুটবলের দায়িত্ব তুলে দিতে চেয়েছিল।
পছন্দের তালিকায় শীর্ষে ছিলেন কার্লো আনচেলত্তি। একসময় রিয়াল মাদ্রিদ কোচকে দায়িত্ব দেওয়ার ঘোষণাও আসে সিবিএফ থেকে! যদিও সেটা ‘ওয়ান সাইড লাভ’।কারণ ব্রাজিলের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না আনচেলত্তি। তিনি থেকে গেলেন রিয়ালে। ওদিকে অনেক জলঘোলার পর ব্রাজিলকে দেশি কোচের ওপরই আস্থা রাখতে হয়। নতুন কোচ হিসেবে ঘোষণা করে এই দোরিভালের নাম।
২২ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে ২৫ বার দল পাল্টানো এক কোচ কতটা দিতে পারবেন ব্রাজিলকে, সেই প্রশ্ন উঠতে সময় লাগেনি। ব্রাজিলিয়ান ও লাতিন ফুটবলে তার সুনাম থাকলেও বিশ্ব ফুটবলে যে তিনি মোটেও পরিচিত নন। ব্রাজিলের বাইরে কাজ করার অভিজ্ঞতাও নেই। ফলে কোচের সমস্যা সমাধানের সঙ্গে আশঙ্কার মেঘও জমে- এখনকার ‘অ্যাডভান্সড’ ফুটবলের সঙ্গে কতটা মানিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য আছে তার?
ইউরোপের গতিশীল ও ট্যাকটিকস-নির্ভর ফুটবলের চেয়ে পিছিয়ে লাতিন দেশগুলো- ব্রাজিলের সাবেক কোচ তিতে নিজেই মেনে নিয়েছেন কথাটা। এ কারণেই ইউরোপের শীর্ষ পর্যায়ে কাজ করা কোনও কোচকে আনতে চেয়েছিল ব্রাজিল। সেটি বাস্তবে রূপ না দিতে পেরে দেশি দোরিভালে আস্থা রাখে সিবিএফ। এই দেশি কোচের ভোজবাজিতে সবাই মুগ্ধ। ইউরোপে গিয়ে ৬১ বছর বয়সী এই অখ্যাত কোচ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে এবং স্পেনের সঙ্গে ড্র করে চমকে দিয়েছেন সবাইকে। যে কোনও ব্রাজিলিয়ান কোচের জন্য ইউরোপে ফুটবল পরীক্ষাটাই কঠিন বিষয় হয়ে যায়। সেখানে দোরিভাল প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে উতরে গেছেন বড় পরীক্ষা। সুবাদে আস্থা হারানোর সুযোগ নেই আপাতত।
আত্মবিশ্বাসই তার শক্তি
বিশ্বের সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিল। শিরোপা সংখ্যা অন্তত তাই বলে। রেকর্ড পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা সোনালি সময় পেছনে ফেলে এসেছে। ব্রাজিল দলে একটা সময় তারার হাট ছিল, অথচ এখন তারকা খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এক নেইমার ছাড়া প্রভাব বিস্তার করা কোনও ব্রাজিলিয়ান নেই। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র কিংবা রোদ্রিগোর মাঝে সম্ভাবনার ঝিলিক দেখা যায়, তবে সুপারস্টার খ্যাতি হবে কিনা সময় বলে দেবে। তাহলে বড় তারকার অভাবটাই কি ব্রাজিলের সাফল্য না পাওয়ার কারণ? ইংল্যান্ড ম্যাচের আগে এক সাক্ষাৎকারে দোরিভাল জানিয়েছিলেন, “আমাদের এখনও দারুণ সব খেলোয়াড় আছে। হয়তো আগের সময়ের মতো ওই পর্যায়ের নয়, তবে এখনও ভালো খেলোয়াড় আছে।”
দোরিভাল অবশ্য তারকা-নির্ভর কোচও নন। ব্রাজিলের ক্লাবে বড় তারকাদের নিয়েও তার কাজকারবারও ছিল না। মাঝারি মানের খেলোয়াড়দের নিয়েই তার পথচলা এবং ক্লাব ফুটবলের সাফল্য। সুবাদে নিজের ওপর বিশ্বাস বেড়েছে এবং সুপারস্টারহীন দল নিয়েও তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন। এ কারণে প্রথমবার ডাগ আউটে নামার আগেই ঘোষণা দিতে পারেন এই বলে, “আমি আমার কাজ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। অনেক পরিশ্রম করে এই জায়গায় পৌঁছেছি।” এই বিশ্বাসের শক্তি এমন প্রবল যে ১১ জন আনক্যাপড খেলোয়াড় নিয়ে তিনি চলে আসতে পারেন ইউরোপ-মিশনে। তারকা-খচিত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অবলীলায় অভিষেক করিয়ে দিতে পারেন পাঁচজনকে।
খেলোয়াড় বুঝেই তার ট্যাকটিকস
দোরিভাল ট্যাকটিকস নিয়েও খুব বেশি মাথায় ঘামান না। তার মূল শক্তি গতি ও অ্যাটাকিং ফুটবল। অবশ্য সেখানে আবার নির্দিষ্ট কোনও ফরমেশন নেই। যেমন সান্তোসকে তিনি খেলিয়েছেন ৪-২-৩-১ ছকে। আবার ফ্লামেঙ্গোতে একাদশ সাজিয়েছেন মাঝমাঠ নির্ভর ছকে। ডায়মন্ড ধাঁচের মাঝমাঠের ওপরে দুজন স্ট্রাইকার। ফরমেশন নিয়ে আসলে তিনি খুব একটা ভাবেন না। দলের অবস্থান বুঝে নেন সিদ্ধান্ত, “আগেই চিন্তাভাবনা করে কোনও পদ্ধতি নিয়ে আমি আসি না। হাতে যা আছে তা নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। এরপর ঠিক করি ট্যাকটিকস।”
ব্রাজিলের দায়িত্ব নিয়ে যেমন অন্য ফরমেশনে সামনে এসেছেন তিনি। ইংল্যান্ড ও স্পেন দুই দলের বিপক্ষে দল সাজিয়েছেন ৪-৩-৩ ছকে। “হাতে যা আছে”- সেই অনুযায়ী দল সাজিয়ে ফলও পেয়েছেন দোরিভাল।
মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন ব্রাজিল কোচ
এ কারণেই অনেক ব্রাজিলিয়ানের কাছে তিনি জাতীয় দলের ‘সেরা বিকল্প’। দেশটির সাবেক অধিনায়ক কাফুর কাছে যেমন, “দারুণ এক কোচ।” ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের পরিচিত মুখ মুরিচি রামালহো। এই সাবেক মিডফিল্ডার ও কোচ মনে করেন, “দোরিভাল লম্বা সময় ধরে কোচ থাকার দাবিদার।”
ফুটবলবিষয়ক ব্রাজিলিয়ান দৈনিক গ্লোবোস্পোর্তের কলামিস্ট ও ফুটবল কোচ লিওনার্দো মিরান্দা অনেক বড় ভক্ত দোরিভালের। তিনি দ্য অ্যাথলেটিককে বলেছেন, “২০২২ বিশ্বকাপের পর তিতে দায়িত্ব ছাড়লে, ভেবেছিলাম তখনই দোরিভালকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। একইসঙ্গে এটাও ভেবেছিলাম, তিনি কি আসলে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে মানিয়ে নিতে পারবেন?”
মিরান্দার প্রশ্নটা যৌক্তিক। কারণ ২০০২ সালে কোচিংয়ে নাম লেখানোর পর দুই বছরের বেশি সময় কোনও দায়িত্ব পালন করেননি দোরিভাল। গত ২২ বছরে ব্রাজিল জাতীয় দল তার ২৬ নম্বর চাকরি! যার মধ্যে রয়েছে তার দেশের শীর্ষ ১২ দলের মধ্যে আটটির ডাগ আউটে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা।
এই কোচই ব্রাজিলের দরকার
দোরিভালের সবচেয়ে বড় গুণ হলো খাদের কিনারায় থাকা দলকে টেনে তুলতে পারেন। দ্বিতীয় বিভাগ থেকে যেমন শীর্ষ পর্যায়ে একটা দলকে খেলিয়েছেন, তেমনি পথ হারানো দলকে ভাসিয়েছেন শিরোপার আনন্দে। ২০০৯ সালে ভাস্কো দা গামাকে ব্রাজিলের শীর্ষ লিগে ফিরিয়েছিলেন তিনি। ২০২২ সালে ফ্লামেঙ্গোকে এনে দেন কোপা লিবার্তাদোরেসের শিরোপা। ২০২২ বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর লাইনচ্যুত ব্রাজিল দলকে পথে ফেরাতে তার চেয়ে ভালো বিকল্প আর কে হতে পারেন!
আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবল তার নখদর্পনে। স্থানীয়দের সঙ্গে বিদেশি লিগে খেলা ফুটবলারদের সেতুবন্ধন তৈরি হতে পারে তার মাধ্যমে। কারণ দোরিভাল মনে করেন, ব্রাজিল অতিমাত্রায় ইউরোপে খেলা ফুটবলারদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় সাফল্যে ভাটা পড়েছে। তার যুক্তি, “ব্রাজিল দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় বিদেশি লিগে খেলে। ক্লাব ফুটবলের যান্ত্রিক জীবনে তারা বাধা পড়ে। এটা দোষের নয়। জাতীয় দলে এলে কতটুই-বা সময় পায় তারা। এখানে স্থানীয় ফুটবলাররা ভূমিকা রাখতে পারে।”
পরিশেষে
তার সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মঞ্চ সামনের কোপা আমেরিকা। ইউরোপ পরীক্ষায় ‘ফুল মার্কস’ নিয়ে পাস করা এই কোচ চোখ রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতায়। আগামী জুনে এই টুর্নামেন্টে হবে তার বড় পরীক্ষা। এখানে সফল হলে ফুটবলারদের ছাপিয়ে ব্রাজিলের বড় তারকা হয়ে উঠবেন দোরিভাল জুনিয়র।