বুয়েটে যখন ছাত্র রাজনীতিকে ‘না’ বলে আন্দোলন চলছে, তখন আদালতের এক আদেশ ছাত্র রাজনীতির পথ দিয়েছে খুলে।
সোমবার হাইকোর্টের আদেশের পর বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদারও বলেছেন, তারা আদালতের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিচ্ছেন।
এর মধ্য দিয়ে পাঁচ বছর পর দেশে প্রকৌশল শিক্ষার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠানটিতে ছাত্র সংগঠনগুলোর তৎপরতা চালানোর সুযোগ তৈরি হলো।
এই অবস্থায় ছাত্র সংগঠনগুলো কী ভাবছে?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ জানিয়েছে, তারা বুয়েটে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ ছাত্র রাজনীতির পক্ষে। বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল বলছে, তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বুয়েটের পরিস্থিতি আরও কিছু দিন পর্যবেক্ষণ করতে চায়।
বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে কেউ বুয়েটের পরিস্থিতি আরেকটু বুঝে নিতে সময় নিতে চাইছে। কেউবা নিজের সংগঠনকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তা করছে।
দেশের আর সব উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটেও ছাত্র সংগঠনগুলোর সক্রিয়তা ছিল। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে (ইউকসু) ছাত্র সংগঠনের পরিচয়েই প্যানেল হতো।
তবে ২০১৯ সালে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এক জরুরি বিজ্ঞপ্তি জারি করে রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় বুয়েট প্রশাসন।
ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর পিটুনিতে নিহত হয়েছিলেন আবরার। সেই হত্যাকাণ্ডের মামলায় সংগঠনটির ২০ নেতা-কর্মীর মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়।
এরপর গত পাঁচ বছর ধরে বুয়েটে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা চললেও সম্প্রতি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বুয়েটে উপস্থিতি নতুন করে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়।
গত বুধবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ কয়েকজন নেতা-কর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে গেলে তার প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার থেকে শুরু হয় বিক্ষোভ।
আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখার পাশাপাশি ছাত্রলীগ নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া বুয়েট শিক্ষার্থীদেরও শাস্তির দাবি তোলে। তাদের দাবির মুখে সাদ্দামদের ক্যাম্পাসে আমন্ত্রণ জানানো বুয়েট শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ইমতিয়াজ রাব্বি রাহিমের হলের সিট বাতিল করে বুয়েট প্রশাসন।
বুয়েটের এই আন্দোলন হিযবুত তাহরীর ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের মদদে হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলে ছাত্রলীগ; যদিও আন্দোলনকারীরা এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।
এই পাল্টাপাল্টির মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। সেই আবেদনে আদালত ছাত্র রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পাঁচ বছর আগের বিজ্ঞপ্তিটির কার্যকারিতা স্থগিত করে।
রিট আবেদনকারীর আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এর ফলে বুয়েটে ছাত্র সংগঠনগুলোর কাজ চালানোর ক্ষেত্রে আর কোনও বাধা থাকল না।
অভিমান ভাঙাতে চায় ছাত্রলীগ
ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম সোমবার আদালতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বুয়েটে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ রাজনীতির পক্ষে তার সংগঠন।
২০১৯ সালে আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটে ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছিল।
এখন নতুন করে কমিটি দেওয়া হবে কি না, সকাল সন্ধ্যার প্রশ্নে সরাসরি উত্তর দেননি সাদ্দাম।
তিনি বলেন, “বুয়েটে কীভাবে রাজনীতি হবে, তা বুয়েটের শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত করবে, এটা তাদের সিদ্ধান্ত। আমরা আমাদের দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আন্দোলন করেছি, তাদের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য।
“আমরা চাই, বুয়েটের সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাসহ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো একত্রে একটি গাইডলাইন তৈরি করুক, বুয়েটে কীভাবে সাংগঠনিক রাজনীতি হবে। এই গাইডলাইন তৈরিতে প্রয়োজনে আমরা সাহায্য করব।”
বুয়েট যে চর্চা তৈরি করবে, তা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অনুসরণীয় হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন ছাত্রলীগ সভাপতি।
বুয়েটের আন্দোলনকারীদের কটাক্ষ করে ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতা নানা বক্তব্য দিলেও সাদ্দাম তাদের কথাও শুনতে চান।
তিনি বলেন, “বুয়েটের শিক্ষার্থীদের যে অভিমান রয়েছে, তা আমরা কাটাতে চাই। ফলে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে, কীভাবে কী হবে বুয়েটে। এটা আমরা চাই।”
ছাত্রদল চায় আরেকটু দেখতে
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার মধ্যেই ২০২০ সালের ২৪ জুলাই এই বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করেছিল বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল। আসিফ হোসেনকে আহ্বায়ক, আলী আহমদকে সদস্য সচিব ও ফয়সাল নূরকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে আংশিক কমিটি তখন ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে সেই কমিটির কোনও সক্রিয়তা পরে আর দেখা যায়নি।
তখন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন বলেছিলেন, বুয়েট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ‘অপরিপক্ব’। তারা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছে না।
এখন আদালতের আদেশের পর ছাত্রদলের বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, তারা বুয়েট পরিস্থিতি বুঝে তারপর সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চান।
ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি মূলত ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বলেই তারা মনে করেন।
“সাধারণ শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন, এখানে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনও দায় নেই। গত ১৫ বছর ধরে বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাকে ছাত্রলীগ একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। যে পরিস্থিতি ক্রিয়েট হয়েছে, তার জন্য ছাত্রলীগই একমাত্র দায়ী। বাংলাদেশে যতদিন গণতন্ত্র ফিরবে না ততদিন এ সংস্কৃতির অবসান হবে না।”
ছাত্রদল কমিটি দেবে কি না- প্রশ্নে তিনি সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বলেন, “আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সক্ষম হলে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদল সুস্থ ধারার রাজনীতি উপহার দেবে। তখন ক্যাম্পাসে রাজনীতিবিমুখতার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হবে না।”
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বুয়েটের ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের যে দাবি করেছে, তা মূলত ছাত্রলীগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য। তাদের আন্দোলন ছাত্রসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে না। আমাদের একটি সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে বুয়েটে, সেটি নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কিন্তু আমাদের কোনও নেতিবাচক মনোভাব দেখায়নি।
“আদালতের রায়কে আমরা সম্মান জানাই। তবে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি, থাকবে না, সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের। বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের স্পিরিটের সাথে আমরা একমত। আমরা পুরো বিষয়টি অবজার্ভ করব আগে।”
ছাত্রদল বুয়েটে কমিটি দেবে কি না, সেই প্রশ্ন তিনিও এড়িয়ে যান।
ছাত্রফ্রন্টও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে
বাম ছাত্র সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টও বুয়েট পরিস্থিতি বুঝে ওঠার জন্য সময় নিতে চাইছে।
সংগঠনটির একাংশের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ আদালতের আদেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একটি নাটক সাজিয়ে ছাত্রলীগ আজকের রায়টি নিল। এই রায়ের ফলে বুয়েটে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসবে বলে আমরা মনে করি না।
“আমরা আগেই বলেছি, ছাত্র রাজনীতি নয়, সন্ত্রাসীদের বর্জনের মাধ্যমেই ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।”
বুয়েটে ছাত্রফ্রন্ট কমিটি গঠন করবে কি না- প্রশ্নে মুক্তা বলেন, “আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। পরবর্তীতে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নেব।”
ছাত্র ইউনিয়নের দুই অংশের দু্ই চিন্তা
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করতে চাইলেও অন্য অংশ সময় নিতে চায়।
একাংশের সভাপতি দীপক শীল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের আগেও সাংগঠনিক কাজ ছিল, আমরা আবার শুরু করব। খুব তাড়াতাড়ি আমরা কমিটি করব বলে আশা করি।”
ছাত্র রাজনীতির গুরুত্ব বুয়েট শিক্ষার্থীদের উপলব্ধি করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে, ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতে রাজনীতি করার কোনও বিকল্প নেই।”
ছাত্র ইউনিয়নের আরেক অংশের সভাপতি রাগীব নাঈম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখার যে আন্দোলন করছিল, তাদের সেই আন্দোলনের স্পিরিটের সাথে একমত থাকলেও আন্দোলনের সকল বক্তব্যের ক্ষেত্রে আমরা একমত নই।
“সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, কিন্তু তাই বলে রাজনীতি বন্ধ রাখা কোনও সমাধান নয়। মাথাব্যথা হলেই তো আপনি মাথা কেটে ফেলবেন না? ফলে সন্ত্রাসী রাজনীতিকে ঠেকাতে হবে নীতির রাজনীতি দিয়েই।”
বাংলাদেশে কোনও ক্যাম্পাসেই এখন গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই দাবি করে তিনি বলেন, “সকল জায়গাতেই ছাত্রলীগের দখলদারি চলছে। ফলে, আদালত কি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে পারবে?”
সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করবেন কি না- প্রশ্নে রাগীব বলেন, “এতদিন বুয়েটের প্রশাসন এবং শিক্ষার্থীদের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান রেখে আমরা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করিনি। মাত্র রায়টি হল … পরিস্থিতি বুঝে আমরা আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করব বুয়েটে।”
আগে ইউকসু নির্বাচন চায় ছাত্র ফেডারেশন
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি চালুর আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাইছে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন।
আদালতের আদেশে কোনও আশা না দেখার কথা জানিয়ে বাম সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা বুয়েটের আন্দোলনের সাথে একমত। আদালত রায় দিয়েছে মূলত ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব নিশ্চিত করার জন্য। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি তৈরি না হলে এ রায়ে কিছু আসবে যাবে না। ছাত্রলীগ শুধু তাদের পুরাতন দখলদারিত্বের জায়গায় যেতে চায়, সেটাই তারা নিশ্চিত করল।”
বুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানাই এবং আমরা মনে করি শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে জয়ী হবে।
“আমরা বুয়েট প্রশাসনকে বলব, রাজনীতি শুরু করার পূর্বে যেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে। তার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কীভাবে রাজনীতি সেখানে চলবে।”
সহাবস্থানের নিশ্চয়তা চায় বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী
বুয়েটে সব ছাত্র সংগঠন যেন অবাধে কাজ করতে পারে, তার পরিবেশ নিশ্চিতের দাবি জানাচ্ছে বাম সংগঠন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক দীলিপ রায় সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বুয়েটে আমরা কাজ করতেই চাই, যেভাবে সকল সংগঠন কাজ করতে চায়। কিন্তু হাইকোর্টকে দিয়ে যে সিদ্ধান্তটা নেওয়ানো হলো, তাতে যে বুয়েটও অন্যান্য ক্যাম্পাসের মতো দখলদারত্বের খপ্পড়ে পড়বে না, তার তো ঠিক নেই।
“ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের যে কাঠামোগত দখলদারত্ব, তা নিরসন না করলে ছাত্র রাজনীতি ওপেন করা বা না করা একই হবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করার জন্য সকলের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হয়।”
তবে বুয়েটে সহাবস্থান নিশ্চিত হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ী দীলিপ।