Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

বাংলার হাঁড়ি বাংলার চুলো

আন্দালিব রাশদী।প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

ঠাকুর বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল নিয়ে যতো জপই জপুন না কেনো তারই বিটকেল শিষ্যদের একজন হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়েছেন হাটে ও মাঠে, বাটে ও ঘাটে। সতীশচন্দ্র ঘটক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তারই গান তারই সুর কব্জা করে একহাত নিলেন:

বাংলার ঢেঁকি                    বাংলার কুলো
বাংলার হাঁড়ি                     বাংলার চুলো
পূজ্য হউক                                পূজ্য হোক
পূজ্য হউক, হে ভগবান।
বাংলার টিকি                    বাংলার কোঁচা
বাংলার টিকি
বাংলার কচু                      বাংলার মোচা
দীর্ঘ হউক                        দীর্ঘ হউক
দীর্ঘ হউক, হে ভগবান।
বাঙ্গালীর জেদ                  বাঙ্গালীর চাড়
বাঙ্গালীর পিলে                 বাঙ্গালীর ঘাড়
শক্ত হউক
শক্ত হউক, হে ভগবান।
বাঙ্গালীর মত                    বাঙ্গালীর বেশ
বাঙ্গালীর কাজে                লুচি সন্দেশ
অনেক হউক                             অনেক হউক
অনেক হউক, হে ভগবান।

এই সংক্ষিপ্ত রচনাটিতে শতবর্ষ পুরোনো বাংলার বিভিন্ন বিষয়ের একটি কোলাজ উপস্থাপন করা হয়েছে, এটিই এবারের বৈশাখ বন্দনা:

বাংলায় দেশলাই
বাংলার উপর যতোই ক্ষুব্ধ হোন, রেগেমেগে আগুন লাগিয়ে যে বাংলা ভষ্মীভূত করে দেবেন তারও উপায় নেই। দেশলাই পাবেন কোথায়?

১৩১৯ বাংলা সনের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় মহাজন বন্ধু রীতিমত রায় দিয়েছে বাংলায় বড় কোনো দেশলাই ফ্যাক্টরি চালানো অসম্ভব।

‘বাঙ্গালা দেশেই দেশালাইয়ের কল নাই’, কারণ বঙ্গে গহন কানন প্রায় দেখা যায় না; পরন্ত দেখা গেলেও কোমলকাষ্ঠ তদ্রুপ পাওয়া যায় না, যাহা পাওয়া যায়, তাহা দ্বারা দেশালাইয়ের বড় কল ভিন্ন পড়তায় সুবিধা হওয়া অসম্ভব।’

বাংলায় দেশলাইয়ের কল না থাকলেও ভারতে বেশ ক’টি কল রয়েছে যার উৎপাদন ক্ষমতা বার্ষিক ৭ লক্ষ গ্রোস। প্রতিদিন ৭০০ গ্রোস উৎপাদনে সক্ষম ৫৬টি ফ্যাক্টরি নিরবিচ্ছন্ন উৎপাদন চালিয়ে গেলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটবে। কিন্তু ভালোভাবে রফতানি করতে হলে ৭০টি ফ্যাক্টরি দরকার।

দক্ষিণ ভারতে তেমন গহীন বনেব কোনো কমতি নেই। বন থেকে ফ্যাক্টরিতে রেল যোগে কাঠ বহন করতে প্রতি কিউবিক ফুটের পরিবহন ব্যয় চার আনা। সেই কাঠ থেকে তৈরি দেশলাই বাংলায় আনতে পড়তায় মিলে না। এ কারণেই দেশলাইয়ের দাম বেশি।

এ অবস্থায় মহাজন বন্ধু বঙ্গবাসীকে যৌথ কারবার করার অথাৎ পুঁজি ও শ্রমের ভাগীদার হয়ে সেখানে দেশলাই ফ্যাক্টরি স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন। তবেই সাশ্রয়ী মূল্যে বাংলার হাট বাজারে ন্যায্য মূল্যে দেশলাই ক্রয় করা সম্ভব হবে।

দেশলাই কাঠিকে উপেক্ষা করার সুযোগ যে নেই স্বয়ং সুকান্ত সেই সাক্ষ্য দিয়েছেন:

আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি
মনে আছে সেদিন হুলস্থূল বেধেছিল?…
আমাকে অবজ্ঞাভরে না নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়
কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে
কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ
আমি একাই, ছোট্ট একটা দেশলাই কাঠি
এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে…

ভেজালে দেশ ছাইয়া গেছে
নোয়াখালী হিতৈষী জানিয়েছে, কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর, নোয়াখালীর চৌমুহনী এবং নোয়াখালী সদরের বড় বড় মুদি দোকান ও আড়ত ভেজালদ্রব্য আমদানি ও বিক্রয়ের প্রধান আড্ডায় পরিণত হয়েছে। দুধ, তেল, চাল, ময়দা, ঘি, চিনি, খাবার ও রুটিওয়ালার দোকানে সব ধরনের খাদ্যেই ভেজাল মেশানো হচ্ছে।

পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে, আসাম মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট অনুযায়ী ধুবড়ী পৌরসভা বেশ ক’জন ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বিক্রেতাকে গ্রেফতার করেছে। ভেজাল খাবার উদরাময়সহ বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগ বিস্তার করছে। এ  ক্ষেত্রে ‘ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বিক্রেতা এবং ভেজাল মিশ্রণকারী দুর্বৃত্তদিগকে অর্থদণ্ডের সহিত কঠোর কারাদণ্ড প্রদান না করিলে কখনও এ পাপ দূরীভূত হইবে না। কোনও কোনও উৎকোচগ্রাহী ভেজাল-পরীক্ষাকারীকেও অনুরূপ দণ্ড প্রদান করা বিধেয় বলে মনে করি।’

(বৈশাখ ১৩৩৭ সংখ্যা ‘আর্থিক উন্নতি’)

‘সৌভাগ্যই বল আর দুর্ভাগ্যই বল, আজি বাঙালির অধঃপতনের শেষ সীমা। বাঙালি ঘরের অন্ন পরের হাতে দিয়া উপবাসে মরিতেছে, তাহার পরিধেয় বস্ত্র, রোগের ওষুধ, তৃষ্ণার জল, শিশুর খেলনা, যুবকের গ্রন্থ-তাহার কালি, কলম, কাগজ, তাহার বাক্স, দেরাজ, আয়না, চিরুনি, তাহার বাসন, বিছানা প্রায় সমস্ত গৃহসজ্জা, অধিক কি দেশলাইটি পর্যন্ত বিদেশী বণিক যোগাইতেছে। ইহার অপেক্ষা মর্মান্তিক ক্লেশ এই যে, বাঙালির যিনি রক্ষক শাসক সেই সুসভ্য সদাশয় রাজা-যে রাজার প্রজা হইয়া বাঙালি মানিতেছে, সেই রাজা বিদেশী বণিকের অনুকূল।’

ময়মনসিংহ কেনো আমদানি নির্ভর জেলা হয়ে উঠছে?
১৩৩৭ বঙ্গাব্দে আর্থিক উন্নতি লিখছে: পঁচিশ বছর আগে ময়মনসিংহ কোনও মোটরকার ছিল না। এখন মোটরকার ও বাসের সংখ্যা অনেক, সাইকেল অসংখ্য। এখন ঘরে ঘরে গ্রামোফোন। সেলাইয়ের কল ও টর্চ লাইট। এর সবই বিদেশী।

বিদেশ থেকে এ শহরের অধিবাসীদের জন্য ব্যবসায়ীরা আরও আমদানি করছেন: দামি কাপড়, লবণ, চিনি, জুতা, ছাতা, ছুরি, কাঁচি, ক্ষুর, কড়াই, কোদাল, চুরুট, কাগজ, কলম, কালি, পেনসিল, সুই, সুতা, সাবান, বিস্কুট, চিনামাটির বাসনকোসন, খেলনা, ওষুধ, ডাক্তারি যন্ত্রপাতি, এনামেল ও অ্যালুমিনিয়ামের সামগ্রী বিভিন্ন ধরনের কলকব্জা, বই, সুগন্ধী, ফিতা, ক্যানভাস, কেরোসিন, করোগেটেড আয়রন শিট (ঘরের চালের টিন), টিনের পাত, অয়েল ক্লথ, রঙ, বার্নিশ, দেয়াশলাই, বিলেতি মাটি, শ্লেট, কাঠের জিনিস, ব্যাট, বল, ফুটবল চামচ, আয়না, চিরুনি, কৌটা, বোতাম, ব্রাশ, টুথ পাউডার, বার্লি, মদ ও মাদকজাতদ্রব্য।

ভারতের অন্যান্য প্রদেশ ও কাবুল থেকে আমদানি করা হচ্ছে : মুগ, মাষ, খেসারি, মসুরি, মটর, ছোলা, অড়হর, কলাই, কবিরাজি ওষুধের উপাদান, আলু, তিল, পেঁয়াজ, রসুন, লংকা, গোলমরিচ, লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি, গম, জব, বার্লি, গুড়, চিনি, মিছরি, আম, কমলালেবু, বেদানা, পোস্তা, কিশমিশ, বাদাম, আখরোট, জাফরান, চিনাবাদাম, কুল, পেয়ারা, আঙুর, আপেল, লাক্ষা, ধূপ, আলকাতরা, মাদুর,  সোডা ও সোড়া, তামাক, চুলা, চা, নারকেল, তিল, তিসি, সরিষা, বেড়ির তেল, সৈন্ধব লবণ, গোলাপজল, আতর, ওষুধপত্র, আদা, হলুদ কাপড়-চোপড়।

এখানেই শেষ নয়। বাংলার অন্যান্য জেলা থেকে ময়সনসিংহে আসছে—সুপারি, কাপড়, কাচের জিনিস, লোহার জিনিস, আলু, পটল, তামাক, গুড়, চাল, কাঠের জিনিস, মাটির পুতুল, কাঁসার বাসন, কুচু, কচুমুখী, আনারস এবং গাঁজা।

এ তালিকা থেকেই বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলার মানুষের আর্থিক সঙ্গতি এবং লেনদেনের একটি চিত্র পাওয়া যায়। কিন্তু বিশাল এই জেলা কেনো এমন আমদানি নির্ভর হবে?

বাঙালির অধঃপতন
৩ বৈশাখ ১৩১৩ বঙ্গবাসিনী এক পত্রলেখিকা জ্যৈষ্ঠ ১৩১৩/জুন ১৯০৬ সংখ্যা বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত একটি পত্রে জানিয়েছেন, বিদেশী জিনিসে বাসগৃহ পরিপূর্ণ, গোপনে বিদেশী বর্জনের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে বাঙ্গালি জনগোষ্ঠি দেশদ্রোহিতার চূড়ান্ত পরিচয় দিচ্ছে।

‘সৌভাগ্যই বল আর দুর্ভাগ্যই বল, আজি বাঙালির অধঃপতনের শেষ সীমা। বাঙালি ঘরের অন্ন পরের হাতে দিয়া উপবাসে মরিতেছে, তাহার পরিধেয় বস্ত্র, রোগের ওষুধ, তৃষ্ণার জল, শিশুর খেলনা, যুবকের গ্রন্থ-তাহার কালি, কলম, কাগজ, তাহার বাক্স, দেরাজ, আয়না, চিরুনি, তাহার বাসন, বিছানা প্রায় সমস্ত গৃহসজ্জা, অধিক কি দেশলাইটি পর্যন্ত বিদেশী বণিক যোগাইতেছে। ইহার অপেক্ষা মর্মান্তিক ক্লেশ এই যে, বাঙালির যিনি রক্ষক শাসক সেই সুসভ্য সদাশয় রাজা-যে রাজার প্রজা হইয়া বাঙালি মানিতেছে, সেই রাজা বিদেশী বণিকের অনুকূল।’

… এই বাণিজ্য-কুশল অর্থপ্রিয় বণিকগণ দোষী না যে হতভাগ্য নির্ব্বোধ জাতি ইহাদিগের হস্তে সমস্ত ভার দিয়া, কর্ম্মফল অদৃষ্টের উপর চাপাইয়া পরিপূর্ণ নিস্ফলতা লইয়া অহিফেনভোজীর মতো অর্দ্ধোম্মীলিত নেত্রে ঢুলিতেছিল, সেই হতভাগ্য জাতি দোষী?’

পত্রলেখিকা উল্লেখ করেছেন— ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, ফরাসডাঙ্গা, সিমলা, শান্তিপুর, চন্দ্রকোনার তন্তবায়, বহরমপুর, খাগড়া, বরিশালের স্যাকরা, ঢাকার শঙ্খকার যে জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করতে পারে সে জাতির অলস অকর্মণ্য ও পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকার কথা নয়। দোষ বিদেশী বণিকেরও নয়, দেশী কারিগরেরও নয়, অমার্জনীয় দোষ সমষ্টিগতভাবে দেশের সর্বসাধারণের, তাদের পরনির্ভর মানসিকতার।

পত্রলেখিকা উল্লেখ করেছেন— ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, ফরাসডাঙ্গা, সিমলা, শান্তিপুর, চন্দ্রকোনার তন্তবায়, বহরমপুর, খাগড়া, বরিশালের স্যাকরা, ঢাকার শঙ্খকার যে জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করতে পারে সে জাতির অলস অকর্মণ্য ও পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকার কথা নয়। দোষ বিদেশী বণিকেরও নয়, দেশী কারিগরেরও নয়, অমার্জনীয় দোষ সমষ্টিগতভাবে দেশের সর্বসাধারণের, তাদের পরনির্ভর মানসিকতার।

ঢাকার উপর যেন অভিসস্পাত পতিত হয়েছে:
মহামারি কি আসন্ন?
ঢাকা থেকে প্রকাশিত পঞ্চায়েত পত্রিকায় প্রকাশিত মহম্মদ আলীর একটি চিঠি আর্থিক উন্নতির পৌষ ১৩৩৭ সংখ্যার পুণর্মুদ্রিত হয়েছে :

ঢাকা জেলার অন্তর্গত মনোহরদী থানার অধীন ১নং লেবুতলা ইউনিয়নে কৃষককুলের ভয়ানক অন্নাভাব উপস্থিত হইয়াছে। বিগত ফাল্গুন মাস হইতে আরম্ভ করিয়া এ পর্যন্ত দুইবেলা পেট ভরিয়া খাইতে পাইতেছে না। এই বৎসর অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টিতে আউশ ধান মোটেও জন্মে নাই। যে ২০ মণ ধানের জমিচাষ করিয়াছিল সে মাত্র ৫ মণ ধান পাইয়াছে। আশা ছিল ইহা বিক্রি করিয়া জীবন রক্ষা হইবে; কিন্তু পাটও প্রত্যেকের গড়ে অর্দ্ধেকের কম হইয়াছে। বর্তমানে এখানে পাটের দর প্রতিমণ আড়াই থেকে ৩ টাকা মাত্র। ক্ষুধার তাড়নায় কৃষকগণ উক্ত মূল্যেই পাট বিক্রি করিতেছে। আশ্বিন মাস অতীত হইবার পূর্বেই অনেক কৃষকের পাট বিক্রয় শেষ হইয়াছে। তৎপর কৃষকগণ যে কি খাইয়া জীবন ধারণ করিবে জানি না। স্থানীয় মহাজনগণের হাতে টাকা না থাকায় কোন কৃষকই এক পয়সা ঋণ পাইতেছে না। বর্তমানে এখানে হাহাকার উঠিয়াছে। আর কেহ যদি ভাত পাক করিয়া পাশের ঘর হইতে বাহির যায় লোকে তাহাও চুরি করিয়া নিয়া যায়। মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় নানারূপ অখাদ্য ভোজন করিয়া স্বাস্থ্য নষ্ট করিতেছে। পেটের পীড়া আমাশায় ইত্যাদি সংক্রমণ ব্যধি দেখা দিয়াছে। মানুষ এইরূপ অখাদ্য ভোজন করিলে মহামারি উপস্থিত হইবে সন্দেহ নাই।

মহাম্মদ আলী
সেক্রেটারী দাইড়ের পার কোঃ অঃ ব্যাঙ্ক
নরেন্দ্রপুর ঢাকা

পঞ্চায়েত পত্রিকার প্রতিবেদনে ঢাকার মফস্বল এলাকার শোচনীয় অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে—ঢাকার উপর যেন অভিসস্পাত পতিত হয়েছে। এত অর্থাভাব প্রতিবেদক আগে কখনো দেখেননি। গ্রামের শতকরা ৯৯ ভাগ বাড়িতে খোরাকির সংস্থান নেই। ব্যাঙ্কগুলোর ও ঋণ দেবার ক্ষমতা লুপ্ত হয়েছে।

বাংলার বয়নশিল্প
অসহযোগ আন্দোলনের সময় নারায়ণগঞ্জ মহকুমার মধাবদী বাজার এবং সংলগ্ন অঞ্চল বাংলার ম্যানচেষ্টার হিসেবে খ্যাত হয়ে উঠে। বয়নশিল্পের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। ‘দিন নাই রাত নাই, যখনই সে অঞ্চলে যাওয়া যায় কেবলই তাতের ঠকাঠক শব্দ। মনে হয় ভারতের বয়নশিল্প বুঝি আবার আপন গৌরবে সমুদ্ভাসিত হইয়া উঠিবে।’

মধাবদী বাজারের উত্তরে ৪ মাইল, পূর্বে ২ মাইল অর্থাৎ মেঘনা নদী পর্যন্ত, দক্ষিণে ৫ মাইল অর্থাৎ ছাওয়াল-বামনী নদী পর্যন্ত এবং পশ্চিমে ৪ মাইল অর্থাৎ লক্ষ্যা নদী পর্যন্ত তাঁত বসানো হয়েছে।

এক হাজার তাঁতে আনুমানিক ৫ হাজার পুরুষ ও মহিলা কাজ করছে। এই পাঁচ হাজারের মধ্যে অন্তত; ২ হাজার স্ত্রী লোক, বিধবা অথবা ভিক্ষুক এরা নলী জড়াবার কাজ করে, এক হাজার অল্প বয়স্ক বালিকা যারা খেলাধুলা করে দিন কাটাত এখন সূতার টানা দেয়। বাকী ২ হাজার বখে যাওয়া সন্তান যারা বাবা মার ঘাড়ে বোঝা হিসেবে অবস্থান করত এখন তারা কামাই করে।

প্রতি সোমবারে মাধবদী হাট বসে, প্রতি হাটে ৫০/৬০ হাজার টাকার তাঁতের কাপড় বিক্রি হয়। এ অঞ্চলে তৈরি ২৪ লক্ষ টাকার কাপড় মাধবদী বাজারে বিক্রি হয়।

দু’টি বালক বুননের কাজে এবং একটি ৮/৯ বছরের বালিকা টাচার কাজে থাকলে তাদের মাসিক ৫০/৬০ টাকা আয় হতে পারে; দু’জন ভিক্ষুক বা বিধবা নলীর কাজে মাসে ১১/১২ টাকা উপার্জন করতে পারে। এই পাঁচ হাজার লোক বৎসরে সোয়া সাত লক্ষ টাকা রোজগার করে। মাধবদী অঞ্চলে ভিক্ষাবৃত্তি নেই বললেই চলে। তাঁতীরা অধেক দেশি ও অর্ধেক বিলেতি সুতা ব্যবহার করে। মাধবদীতে পরিবহন সংকট রয়েছে। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের জিনারদি স্টেশন মাধবদীর ৬ মাইল উত্তরে এবং নারায়ণগঞ্জ-ভৈরব স্টিমার লাইনের ভঙ্গাঁরচর স্টেশন ৩ মাইল পূর্বে। মাল আনা নেওয়ার খরচ বেশি পড়ে। কাছাকাছি কোন সুতার কলও নাই।

এখনকার লুঙ্গি, শাড়ি, গামছা, তোয়ালে, মশারির কাপড় ও শীতের মোটা চাদরের চাহিদা বেশি। এগুলোর কাটতি মূলত পূর্ব বাংলা ও আসামে।

১৯০৫-০৬ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সময় এক ব্যক্তি মাধবদীতে হেটার্সলি তাঁত নিয়ে আসেন এবং নিজ খরচে অন্য একজনকে চালানো শেখান। ১৯২১-২২ সালে অপর এক ব্যক্তি জাপানি নমুনার একটি তাঁত নিয়ে আসেন। এটির দেশীয় সংস্করণ চিত্তরঞ্জন তাঁত নামে পরিচিত, মাধবদীতে এই তাঁতের চাহিদাই প্রবল। তাঁতের মাকু ছাড়া তাঁতযন্ত্র ও আর সকলই স্থানীয়ভাবে তৈরি। সরকার এন্ড সন্সের আধিকারিক মনে করেন মাধবদীতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ দিলেই এখানকার বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হতে শুরু করবে।

(ঢাকার বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত সরকার এন্ড সন্স এর আধিকারিকের সাক্ষাৎকার ১৩৩৭ পৌষ সংখ্যা ‘আর্থিক উন্নতি’তে ছাপা হয়। সেই সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করেই এই টীকাটি রচিত।)

অসহযোগ আন্দোলনের সময় নারায়ণগঞ্জ মহকুমার মধাবদী বাজার এবং সংলগ্ন অঞ্চল বাংলার ম্যানচেষ্টার হিসেবে খ্যাত হয়ে উঠে। বয়নশিল্পের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। ‘দিন নাই রাত নাই, যখনই সে অঞ্চলে যাওয়া যায় কেবলই তাতের ঠকাঠক শব্দ। মনে হয় ভারতের বয়নশিল্প বুঝি আবার আপন গৌরবে সমুদ্ভাসিত হইয়া উঠিবে।’

স্বদেশী আন্দোলনের শুভ ফল
বিলেতি বর্জনের একটি চিত্র পাওয়া যায় রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাংলার ইতিহাস চতুর্থ খণ্ডে : মৈমনসিংহ জেলার মুচিরা একত্র হইয়া ঘোষণা করিল যে অতঃপর তাহারা বিলাতী জুতা মেরামত করিবে না। বরিশাল জেলার ঠাকুর-চাকরেরা সভা ডাকিয়া স্থির করিল যে যাহারা বিলাতী দ্রব্য কিনিবে তাহাদের বাড়িতে কাজ করিবে না। কালীঘাটের ধোপারা সভায় মিলিত হইয়া স্থির করিল যে তাহারা বিলাতী কাপড় কাচিবে না। ফরিদপুরের ধোপা ও মুচিরাও অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল। ছয় বছরের একটি বালিকা গুরুতর অসুখের সময়ও বিলাতী ওষুধ খাইতে অস্বীকার করিল। ব্রাহ্মণেরা স্থির করিলেন বিলাতী কাপড় ব্যবহার করিলে বিবাহে পৌরহিত্য করিবেন না। পরীক্ষার উত্তর লিখিবার খাতা বিলাতী কাগজের বলিয়া ছাত্ররা পরীক্ষা দিতে অস্বীকার করিল। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা ব্যবস্থা দিলেন যে বিলাতী লবণ ও চিনি ব্যবহার করা হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের বিরোধী।’

স্বদেশী আন্দোলনের একটি হাতিয়ার বিলেতি দ্রব্য বর্জন। আর বর্জনের বিকল্পই স্বদেশী দ্রব্য উৎপাদন।

বামাবোধিনী পত্রিকা আশ্বিন ১৩১২ হতে এক বছর সময়ের মধ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি কলকারখানার একটি তালিকা দিয়েছে :

বঙ্গলক্ষী কটনমিল (শ্রীরামপুর)—মূলধন ১২ লাখ টাকা, বঙ্গীয় শিল্প বিদ্যালয়—মূলধন অজ্ঞাত, শিল্প-বিজ্ঞান চর্চা সমিতির স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি লিমিটেড—দুই লাখ টাকা, ত্রিপুরা কোম্পানি লিমিটেড—১৫ লাখ টাকা, ইন্ডিয়ান স্পিনিং অ্যান্ড উইভিং কোম্পানি লিমিটেড (ভারতীয় বস্ত্রবয়ন কোম্পানি) —১২ লাখ টাকা, দেশী বস্ত্র কোম্পানি লিমিটেড—৬ লাখ টাকা, ভারত হিতৈষী স্পিনিং এ্যান্ড উইভিং মিলস লিমিটেউ— ১ কোটি টাকা, কলকাতা উইভিং কোম্পানি লিমিটেউ—৩০ হাজার টাকা, গোয়াবাগান স্পিনিং এন্ড উইভিং কোম্পানি লিমিটেড— ৫০ হাজার টাকা, কলকাতা পটারি ওয়ার্কস (মৃৎপাত্র নির্মাণালয়) লিমিটেউ— ২ লাখ টাকা, ওরিয়েন্টাল সোপ ফ্যাক্টরি— ৩০ হাজার টাকা, লোটাস সোপ ফ্যাক্টরি—মূলধন অজ্ঞাত, ওরি ম্যাচ ফ্যাক্টরি— এক লাখ টাকা, বুলবুল সোপ ফ্যাক্টরি— মূলধন অজ্ঞাত, বেঙ্গল কেমিক্যাল এ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস— ২ লাখ টাকা, বেঙ্গল স্টিম নেভিগেশান কোং লিমিটেড— মূলধন অজ্ঞাত, জানকী নাথ রায় ব্রাদার্স পূর্ববঙ্গীয় স্টিমার সার্ভিস— ৪ লাখ টাকা, গ্লোব সিগারেট কোম্পানি—মূলধন অজ্ঞাত, বেঙ্গল পেন্সিল ফ্যাক্টারি—মূলধন অজ্ঞাত।

এ ছাড়াও স্টিল ট্যাঙ্ক, চিরুনি, গন্ধদ্রব্য, আচার, হস্তিদন্তের দ্রব্য, জমাট দুগ্ধজাত খাবারের অনেক কারখানা স্থাপিত হয়েছে।

লক্ষীমিল-বস্ত্রবয়ন কারখানার মূল্য পরিশোধ হয়ে যাওয়ার আনন্দ সংবাদে সেপ্টেম্বর ১৯০৬ সংখ্যায় মন্তব্য করা হয়েছে :

‘একটি মিলে দেশের অভাব পূরণের আশা করা যায় না। কিন্তু ইহার প্রস্তুত বস্ত্র সকল ক্রয় করিয়া উৎসাহ দান করিলে কলসংখ্যা ক্রমেই বাড়িবে। ঘরে ঘরে চরকার সুতা তৈয়ার হোক এবং গ্রামে নগরে নগরে তাঁত সকল বসুক তাহাতে অভাব অনেক পূর্ণ হইবে।’

আজকের বাংলাদেশে?
ভারতীয় পণ্য বর্জন? তার চেয়ে স্বদেশে ভালো জিনিস উৎপাদন করুন, কম লাভে দেশবাসীকে স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করুন। না চাইলেও বর্জিত হয়ে যাবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: [email protected]

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত