কাজী সালাউদ্দিন হঠাৎ করে চাপে ফেলে দিয়েছেন হাভিয়ের কাবরেরাকে। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ফিলিস্তিনের বিপক্ষে দুটো ম্যাচ হারের পর বাংলাদেশ দলের স্প্যানিশ কোচের ওপর ক্ষোভ ঝেড়েছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। এই প্রসঙ্গে তিনি সম্ভাব্য ‘সম্পর্কচ্ছেদ’- এর কথা বলে ফেলায় ব্যাপারটা রহস্যময় ঠেকছে অনেকের কাছে।
তাহলে বাফুফে সভাপতি কি ভেবেছিলেন, ৮৬ ধাপ এগিয়ে থাকা ফিলিস্তিনকে হারিয়ে দেবে তার দল?
লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি ছিল কাবরেরার
নতুন চুক্তির পর এ বছর জানুয়ারি থেকে হাভিয়ের কাবরেরা টানা তৃতীয় বছর শুরু করেছেন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে। শুরুর সময় ঘুরে-ফিরেই এসেছিল লেবানন ও ফিলিস্তিন ম্যাচে বাংলাদেশের সম্ভাবনার প্রশ্ন। এই কোচ কখনো দুটো দলকে হারানোর প্রতিশ্রুতি দেননি। বার বার দুই প্রতিপক্ষের শক্তির কথা বলেছেন, নানা দিকে তাদের এগিয়ে থাকার কথা বলেছেন। ওই ম্যাচগুলোতে পয়েন্টের স্বপ্ন দেখলেও কোচ সেটা প্রকাশ না করে তার দলের লড়াই করার সামর্থ্যকে বড় করে দেখিয়েছিলেন।
তবে ২১ মার্চ কুয়েতে বাংলাদেশ কোনও লড়াই করতে পারেনি ফিলিস্তিনের বিপক্ষে, হারে ০-৫ গোলে। ৪ দিন বাদে ঢাকায় ফিরতি ম্যাচে অবশ্য জামাল ভূঁইয়ার দল তুমুল লড়াই করে ম্যাচ ড্র করার সম্ভাবনা জাগিয়ে শেষমেষ ৯৪ মিনিটে গোল খেয়ে হারে।
কোচের ওপর ক্ষুব্ধ সালাউদ্দিন
কুয়েতে ম্যাচের পর কাজী সালাউদ্দিন দেশে সরব হয়েছিলেন হাভিয়ের কাবরেরার বিপক্ষে। ম্যাচে বাংলাদেশ দলের বিভিন্ন পজিশনে গলদ খুঁজে পেয়েছিলেন বাফুফে সভপতি। ৫-০ গোলে হারার পর তিনি খুঁত ধরতেই পারেন। কিন্তু ২৬ মার্চ ঘরের মাঠে সেই ফিলিস্তিনের বিপক্ষে দারুন লড়াই করে বাংলাদেশ শেষ মুহূর্তের গোলে হারার পরও সভাপতির একই রকম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া বিস্মিত করেছে অনেককে।
কারণ ৮৬ ধাপ এগিয়ে থাকা দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ লড়াই করেছে। ৯৪ মিনিটের ওই গোলটি বাদ দিলে এই ম্যাচে অনেক ইতিবাচক দিক আছে জামাল ভূইঁয়াদের খেলায়। এরপরও সালাউদ্দিন বলেছিলেন, “ম্যানেজমেন্টের টেকনিক্যাল ভুলে আমরা এই ম্যাচ দুটো হেরেছি। এজন্য কোচকে জবাবদিহি করতে হবে।”ম্যাচের কয়েকদিন পর তিনি বলেছেন, “শুধু ভাল খেলা দিয়ে হবে না, জিততে হবে। কোচের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তার অনেক ভুল ছিল। সেগুলো শুধরাতে না পারলে আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক তো কমপ্লিট হবে না।” অর্থাৎ বাফুফে সভাপতি ছাঁটাইয়ের হুমকি দিয়ে রেখেছেন কোচকে।
কাবরেরা নীরব
সভাপতির মন্তব্যগুলো নিশ্চয়ই কোচও দেখেছেন তবে পাল্টা কোনও জবাব দিতে চাননি তিনি। বরং সকাল সন্ধ্যার কাছে হাভিয়ের কাবরেরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তার ফুটবলারদের পারফরম্যান্স নিয়ে,“এই দল অনেক ভাল খেলেছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের ইতিবাচক থাকতে হবে।”এদের নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করার সুবাদে কোচের মনে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে,“এই ফুটবলারদের সামর্থ্য আছে। ভবিষ্যতে তারা এ দেশের ফুটবলে চমৎকার কিছু করতে পারে।”
বাংলাদেশে এটা তার তৃতীয় বছর। ২০২৩ সালে জুনে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে কাবরেরার অধীনে বাংলাদেশের বদলে যাওয়া শুরু। ১৪ বছর পর বাংলাদেশ ইতিবাচক ফুটবল খেলে এই টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে উঠেছে। এরপর আফগানিস্তান ও লেবাননের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে দুর্দান্ত খেলে ড্র করেছে কাবরেরার দল। আসল পরিবর্তনটা হয়েছে, খেলোয়াড়দের সাহস ও শরীরি ভাষায়। যে কোন ম্যাচে জামাল-তপুরা ইতিবাচক হয়ে মাঠে নামছেন, লড়াই করছেন।
এরই পুরস্কার হিসাবে এ বছরের শুরুতে বেতন বাড়িয়ে সফল কোচের সঙ্গে নতুন চুক্তি করে বাফুফে। নতুন বছরে তার অধীনে র্যাঙ্কিংয়ে ৮৬ ধাপ এগিয়ে থাকা শক্তিশালী ফিলিস্তিনের সঙ্গে দুটো ম্যাচ হারলেও লাল-সবুজের সেই লড়াকু মনোভাব অটুট আছে। তাই এই কোচের বিরুদ্ধে বাফুফে সভাপতির ক্ষুব্ধ মনোভাব বেশ রহস্যজনকই মনে হচ্ছে।
দলনেতা জাহাঙ্গীর কি বলছেন
বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশ দলের দলনেতা হয়ে সঙ্গী হয়েছিলেন বাফুফে সদস্য শওকত আলী খান জাহাঙ্গীর। তিনি ঢালাওভাবে কোচের সমালোচনা করতে চান না। খুব কাছ থেকে কাবরেরার কাজ দেখে তিনি সন্তুষ্ট, “এই কোচ খুব আন্তরিক। ট্রেনিংয়ে তার এতটুকু গাফিলতি দেখিনি। ম্যাচ নিয়ে তার নিজস্ব পরিকল্পনা থাকে। কুয়েতে ফিলিস্তিনের বিপক্ষে আমরা বাজে খেলেছি তবে ঢাকায় দল ভাল খেলেছে।” এরপর এই সংগঠক যোগ করেন “ফিলিস্তিন খুব শক্তিশালী দল, পক্ষান্তরে আমার দলে কি অস্ত্র আছে সেটাও তো হিসাব করতে হবে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে শুরু করে দলটাকে একটা ভাল অবস্থায় নিয়ে এসেছে এই কোচ, এটাও স্বীকার করতে হবে।”
সালাউদ্দিনের হুমকিতে নির্বাচনী গন্ধ
কাবরেরার অধীনে ফুটবলে যে হঠাৎ প্রাণ ফিরেছে, এটা সত্যি। বাফুফের লোকজনও তা মানেন। তাদের কাছেও তাই কাজী সালাউদ্দিনের প্রতিক্রিয়া বোধগম্য নয়। তবে বাইরের লোকজন তার কথায় অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছে। সাবেক ফুটবলার আব্দুল গাফফারের কাছে এটা সালাউদ্দিনের নাটক, “কোচকে নিয়ে বাফুফে সভাপতির চোটপাটের কারণ হলো সামনে বাফুফে নির্বাচন। দল খারাপ করলে কোচের ওপর দিয়ে যাবে আর ভাল করলে আমার সাফল্য, এই নীতিতেই বিশ্বাসী তিনি। অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিস্তিন অনেক শক্তিশালী দল, এটা সবাই জানে। এদিকে আপনি ফুটবলের কোনও সংস্কার না করে, ফুটবলার আসার ভাল পাইপ-লাইন তৈরি না করেই তাদের হারানোর কথা বলছেন ! এটা স্রেফ সালাউদ্দিন সাহেবের স্ট্যান্টবাজি।”
কাজী সালাউদ্দিন এখন চতুর্থ মেয়াদে অর্থাৎ টানা ১৬ বছর বাফুফে সভাপতি পদে আছেন। আগামী অক্টোবরে বাফুফে নির্বাচনে তিনি পঞ্চমবারের জন্যও লড়বেন? গাফফারের জবাব, “আগে সালাউদ্দিন বলেছিলেন, এটাই তার শেষ মেয়াদ। এখন বলছেন যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন ফুটবলের সঙ্গে থাকতে চান। তার মানে হলো, গত ১৬ বছরে ফুটবলকে ধ্বংস করেও তিনি ক্ষান্ত হননি। গত বাফুফে নির্বাচনে তিনি বলেছিলেন র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশকে ১৫০-এ নামিয়ে আনার কথা। কিন্তু আছে আগের মতোই, ১৮০ এর ওপরে।”
আরেক সাবেক ফুটবল তারকা নাম প্রকাশ না করে বলছেন, “দেশের ফুটবল এক বিন্দুও এগোয়নি। কোচ নিয়োগ দিয়ে আর ছাঁটাই করে দেখান যে তিনি বেশ কাজ করেন। আর সরকারও মজে থাকে সালাউদ্দিনকে নিয়ে। অন্য কেউ নির্বাচন করতে চাইলে তার বেহাল অবস্থা করে ছাড়ে একটা মহল।”