Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

শাজাহান খানের রাজ্যে বিধির কী হাল

শাজাহান খান।
শাজাহান খান।
[publishpress_authors_box]

শাজাহান খান, মাদারীপুর-২ আসনের আট বারের সংসদ সদস্য। ভোটে দাঁড়িয়ে কখনও না হেরে আসনটি নিজের করে নিয়েছেন তিনি।

রাজৈর ও সদর উপজেলার একাংশ নিয়ে গঠিত এই আসনে গত কয়েকদিন ধরেই অবস্থান করছেন তিনি। ১০ দিনের কর্মসূচিও আছে তার এলাকার সফরসূচিতে।

অথচ তার এই ধরনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারার কথা নয়। কেননা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চলছে, আর সেই নির্বাচনে মাদারীপুর সদর উপজেলায় তার ছেলে আসিবুর রহমান খান চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, এলাকায় সংসদ সদস্য হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচির আড়ালে শাজাহান খান আসলে ছেলের নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন।

সংসদ সদস্যদের স্বজনরা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না বলে আওয়ামী লীগ থেকে নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু শাজাহান খান তা কেয়ারই করছেন না।  

তার এই কর্মকাণ্ড নিয়ে বিব্রত হওয়ার কথা জানিয়েছে তার দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাও।

তবে বিধি লঙ্ঘন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনও পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

শাজাহান খান অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, নির্বাচনী কোনও প্রচারে তিনি অংশ নিচ্ছেন না।

ভোটের দিনও থাকছেন এলাকায়

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথম ধাপে আগামী ৮ মে যেসব উপজেলায় ভোট হবে, তার মধ্যে রয়েেছ মাদারীপুর সদর। সংসদের এই আসনে ১৯৮৬ সাল থেকে যে আটবার ভোটে দাঁড়িয়েছেন, প্রতিবারই জিতেছেন শাজাহান খান। মন্ত্রীও হয়েছিলেন প্রভাবশালী এই পরিবহন শ্রমিক নেতা।  

বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তিনি। খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্বেও আছেন।

গত মঙ্গলবার ঢাকা থেকে মাদারীপুরে বাড়িতে ফিরে তিনি সফরসূচি প্রকাশ করেন। সেই অনুযায়ী ২ থেকে ১১ মে তিনি স্থানীয় নানা কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। তবে সুনির্দিষ্ট কোনও কর্মসূচির কথা সূচিতে উল্লেখ করা হয়নি।

শাজাহান খানের ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে দলে বিভেদের আশঙ্কা করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে। তিনি বলেন, “শাজাহান খানের কর্মকাণ্ডে শুধু জেলা আওয়ামী লীগ নয়, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগও বিব্রত। তিনি কোনও কিছুই মেনে চলেন না।”

বিরোধের প্রকাশ ভোটে

বিএনপি না আসায় এবার উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। ফলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকছে। তবে সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন।

শাজাহান খানের বড় ছেলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য আসিবুর রহমান আনারস প্রতীকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন।

ভোটে আসিবুরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাভেলুর রহমান শফিক খান। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। মোটরসাইকেল প্রতীকে ভোট করছেন তিনি।

পাভেল আবার শাজাহান খানেরই চাচাত ভাই। তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার অবস্থান শাজাহান খানের প্রতিপক্ষ অংশে। পাভেল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারী। তার সঙ্গে শাজাহান খানের তিন দশক ধরে রাজনৈতিক বিরোধ আছে।

শাজাহান খান ও নাছিমের বিরোধের জেরে মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের বড় অংশ পাভেলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের বড় অংশ আছে আসিবুরের পক্ষে।

প্রচারের ছবি ভাইরাল

ভোটের প্রচারে শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান।

শাজাহান খান ছেলের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন, এমন কয়েকটি ছবি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে।

গত বুধবার রাতে সদর উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মিঠাপুর এলাকায় অসুস্থ এক ব্যক্তিকে দেখতে যান শাজাহান খান। সেখানে বাহাদুরপুর ইউপির চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনসহ স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া শাজাহান খানের বাসভবনে অনুসারীদের নিয়ে ছেলের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, এমন কয়েকটি ছবিও ছড়িয়ে পড়েেছ।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা বলেন, “শাজাহান খান ছেলেকে জেতাতে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ভোট চাইছেন। বিভিন্ন এলাকায় গোপনে সভা করছেন। তার পক্ষে গ্রামের মুরুব্বিদের ম্যানেজ করে আনতে যা যা করা লাগছে, সবই করছেন।

“তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত মানছেন না। আচারণবিধিরও তোয়াক্কা করছেন না। তার এমন কর্মকাণ্ডে আমরা যারা আওয়ামী লীগের কর্মী আছি, আমরা সবাই বিব্রত হচ্ছি।”

তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাখাওয়াত এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “ঢাকা থেকে বাড়িতে ফেরার পথে ধুরাইলে রাত ১১টায় একটি জানাজায় অংশ নেন শাজাহান খান। পরে আমার এলাকায় দুজন প্রবীণ ব্যক্তিকে দেখতে যান। তিনি কোনও প্রচারণা চালাননি।

“নিজের নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নেওয়া তো অপরাধ নয়। এটি নির্বাচনের অংশ না।”

ভোটে পরাজয়ের শঙ্কা দেখে প্রতিপক্ষ শাজাহান খানের নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে তার দাবি।

ভোটের প্রচারে পাভেলুর রহমান শফিক খান।

পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

প্রচার শুরুর পর থেকে আসিবুর রহমান তার চাচা পাভেলের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ১০টির বেশি অভিযোগ করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে। বিপরীতে পাভেল ভাতিজা ও ভাই শাজাহান খানের বিরুদ্ধে ২২টি অভিযোগ করেছেন।

পাভেল বলেন, “তিনি ছেলের পক্ষে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কাজ করছেন। আচরণবিধি মানছেন না। তার বিরুদ্ধে কমিশনে অভিযোগ দিয়েও সুরাহা হচ্ছে না।

“আমরা এখন অনেকটা নিরুপায়। সে এখন আচরণবিধি তোয়াক্কা করে এলাকায় মাস্তানি করে বেড়াচ্ছে। নির্বাচনে তার টাকার প্রভাবও দেখাচ্ছে।”

বিপরীতে আসিবুর বলেন, “তারা যে অভিযোগ দিচ্ছে, তারাই সেই অপরাধ করছে। তাদের সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমরা বিধি অনুযায়ী প্রচারণা চালাচ্ছি।

“আমার বাবা ৮ বারের সংসদ সদস্য। তার জনপ্রিয়তা আমার নির্বাচনকে বেগবান করেছে। তবে তিনি আমার নির্বাচনী কাজে অংশ নেননি।”

‘বাড়িতেও থাকতে পারব না?’

নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নাকচ করে শাজহান খান দাবি করেছেন, তিনি বাড়িতেই থাকছেন। কোনও প্রচারে যাচ্ছেন না।

“আমি বাড়িতে থাকি। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সময় দেই। বাড়িতে বিভিন্ন কাজে লোকজন আসে, তাদের সময় দেই, কথা বলি।”

শাজাহান খান বলেন, “নির্বাচন নিয়ে কোনও কাজ আমি করি না। যে আমাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের কথা বলেছেন, তিনি মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছেন। আমি কি আমার বাড়িতে থাকতে পারব না?”

শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খানের শ্বশুর হচ্ছেন কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। ২০২২ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য এমপি বাহারকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিল ইসি। কিন্তু তিনি তারপরও এলাকা ছাড়েননি। ২০২৪ সালে সংসদ নির্বাচনের সময়ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে তিন দফায় ইসি শোকজ করেছিল বাহারকে।

শাজাহান খানের দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ের স্বামী তানভীর হাসান (ছোট মনির) টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য।

যা বলছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা

নির্বাচনে যেন সংসদ সদস্যরা প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন, সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েেছ। নির্বাচন কমিশন থেকেও তা বলা হচ্ছে।

নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান সম্প্রতি বলেন, উপজেলা নির্বাচনে সংসদ সদস্যরা যাতে আচরণবিধি মেনে চলেন, সে বিষয়ে কর্মকর্তাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

শাজাহান খানের এলাকায় অবস্থানের বিষয়ে মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আহমেদ আলী বলেন, “সংসদ সদস্য এলাকায় অবস্থান করলে কোনও সমস্যা নেই। তবে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় থাকতে পারবেন না।”

তার বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর অভিযোগ উঠলেও এখনও কোনও পদক্ষেপ নেননি রিটার্নিং কর্মকর্তা।  

তিনি বলেন, “পাভেলুর রহমান খান অভিযোগ দিয়েছে। আমরা অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করছি। শাজাহান খান আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে কমিশনকে জানানো হবে।”

১৫ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ২৮৩ দশমিক ১৪ কিলোমিটার আয়তনের মাদারীপুর সদর উপজেলায় মোট ভোটার ৩ লাখ ২২ হাজার ৪২৬ জন। এরমধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৬৬ হাজার, নারী ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪২১ জন। ৫ জন হিজড়া ভোটার রয়েছে এখানে। মোট ১১৭টি ভোটকেন্দ্রে ৭৯৪টি বুথে ভোট দেবেন ভোটাররা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত