৫. ব্রিটিশের ভুল
স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পাবার ক্ষেত্রে হিন্দু বিধবা স্ত্রীদের সুদূরপরাহতদশা (সবিস্তারে বলেছি দ্বিতীয় পর্বে ‘শাস্ত্রীয় কথা’-তে) ঘোঁচাতে ব্রিটিশ ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে জারি করে Hindu Women’s Rights to Property Act। বিধবা স্ত্রীই শুধু নয়, বিধবা পুত্রবধু ও বিধবা পৌত্রবধুদের চিরবঞ্চিতদশাও ব্রিটিশ ঘোঁচায় এ-অ্যাক্টে (সবিস্তারে বলেছি তৃতীয় পর্বে প্রণীত আইনের কথা’-তে)। কিন্তু সমস্যা বাধাল বিধবাদের ভাগ দিতে নারাজ গোঁড়ারা, ব্রিটিশের আইনের ফাঁক পেয়ে টান দিল একেবারে আইন প্রণয়নে ব্রিটিশের কর্তৃত্বের গোড়া ধরে, বিশেষ করে কৃষি জমির ব্যাপারে। Hindu Women’s Rights to Property Act প্রণীত হয় ১৯৩৭ সালের ১৪ এপ্রিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের দ্বিকক্ষীয় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে।
তাতে ফাঁকের কী হলো?
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে [গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট] ব্রিটিশ ভারতকে ব্রিটিশরাজের অধীন একটি ফেডারেশনে রূপ দেবার লক্ষ্যে চিফ কমিশনার্স প্রভিন্সগুলো [Chief Commissioner’s Provinces] ও বশ্যতাস্বীকারকারী ছোট ছোট দেশীয় রাজ্যগুলোর (৫৬৫টির মতো এরকম দেশীয় রাজ্য ছিল ১৯৪৭ সালেও) জন্য ‘ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া’-য় যোগ দেবার বিধান রেখে সেন্ট্রাল প্রভিন্স ও বেরার, ইউনাইটেড প্রভিন্স, নর্থ-ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স, বিহার, বোম্বে, সিন্ধু, আসাম, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, মাদ্রাজ ও বেঙ্গল এই ১১টি প্রদেশ (কেতাবি নাম দেয়া হয় Governor’s Provinces) করা হয়। এই ১১টি প্রদেশে সরাসরি ব্রিটিশরাজের নিযুক্ত (পার্লামেন্টকে ডিঙিয়ে কিছু করার ক্ষমতা হারিয়েছে রাজা অনেক আগেই) গভর্নরকে প্রধান রেখে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত Legislative Assembly-এর সদস্যদের মধ্যে থেকে মনোনীত মন্ত্রিপরিষদ সরকারের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। এই প্রথম ব্রিটিশ ভারতের শাসন ও আইন প্রণয়ণের কর্তৃত্ব সুনির্দিষ্ট বিষয় ভিত্তিতে সুষ্পষ্টভাবে কেন্দ্র ও প্রদেশসমূহের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেয়া হয়: ৭ম তপশিলে তিনটি তালিকায় : List I.-Federal Legislative List, List II.-Provincial Legislative List, List III.-Concurrent Legislative List। কিন্তু সেই ভারত শাসন আইন রইল পড়ে কেতাবে, বাস্তবে আর কার্যকর হতে পারল না ফেডারেশনে যোগ দিতে দেশীয় রাজ্যগুলোর অনীহার কারণে (ব্রিটিশের ভাষ্যমতে)।
তাতে তো ব্রিটিশেরই সুবিধা!
তা বটে, তবে অসুবিধা হলো হিন্দু বিধবাদের। Hindu Women’s Rights to Property Act-এর বিল ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের নিম্নকক্ষ Legislative Assembly-তে পাস হবার পরপরই উচ্চকক্ষ Council of States-এ তা পাস করিয়ে গভর্নর জেনারেলের সম্মতি নিয়ে আইন জারি করে দিলে আর সে অসুবিধা হতো না। কিন্তু, ১৯৩৭-এর ৪ ফেব্রুয়ারি নিম্নকক্ষ লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে বিলটা পাস হবার পর দু-মাস ধরে তা পড়ে রইল উচ্চকক্ষ কাউন্সিল অব স্টেটস-এ। ওদিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চাপা দিতে ১৯৩৭-এর ১ এপ্রিল ব্রিটিশ কার্যকর করে দেয় ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত বিধানগুলো। ফলে, ৬ এপ্রিল যখন Hindu Women’s Rights to Property Act উচ্চকক্ষ কাউন্সিল অব স্টেটস-এ পাস হয় এবং ১৪ এপ্রিল যখন গভর্নর জেনারেল তাতে সম্মতি দেন তার আগেই সমগ্র ব্রিটিশ ভারতের শাসন ও আইন প্রণয়ণের কর্তৃত্ব কেন্দ্র ও প্রদেশগুলের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায় ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে। কেন্দ্রে ফেডারেশন গঠিত না হওয়ায় ফেডারেল সরকারের ও ফেডারেল আইন পরিষদের জায়গায় ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদই চালু রাখা হয় কিছুটা সংশোধন-সংযোজন করে। তবে, প্রাদেশিক সরকারের ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিক্ষেত্রে ও এক্তিয়ারে দিয়ে দেওয়া কোনো বিষয়েই আর শাসনের বা আইন প্রণয়নের কর্তৃত্ব ও এক্তিয়ার কেন্দ্রের থাকে না।
তাতে কৃষি জমি নিয়ে সমস্যার কী?
প্রাদেশিক সরকার ও আইন পরিষদের অধিক্ষেত্র ছিল নিজ নিজ প্রদেশের এলাকার মধ্যে। এই ভারত শাসন আইনের ৭ম তপশিলের ২য় তালিকার প্রভিন্সিয়াল লেজিসলেটিভ লিস্টে ২১ নম্বরে প্রদেশের মধ্যেকার কৃষি জমির হস্তান্তর ও উত্তরাধিকার সংক্রান্তে [“transfer, alienation and devolution of agricultural land”] আইন প্রণয়নের একচ্ছত্র এক্তিয়ার ও কর্তৃত্ব দেওয়া হয় প্রাদেশিক আইন পরিষদকে। আর, কৃষি জমি বাদে অন্য সব সম্পত্তির উইল ও উত্তরাধিকার সংক্রান্তে [“Wills, intestacy, and succession, save as regards agricultural land”] আইন প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদকে একইসঙ্গে সমান [Concurrent] এক্তিয়ার দেওয়া হয় ঐ ৭ম তপশিলের ৩য় তালিকায় Concurrent Legislative List-এর ৭ নম্বরে।
তাতে কী? কর্তৃত্ব ভাগাভাগির আগেই তো আইনটার বিল পাস হয়ে গেছে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের নিম্নকক্ষে!
তর্ক বাধে তাই নিয়ে। হিন্দু বিধবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল উদারপন্থীদের অভিমত ছিল সেই পক্ষে। বিতর্ক অবসানের জন্য ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ৫ নম্বর ধারা যোগ করা হলো সে-আইনে (সে-কথা বলেছি তৃতীয় পর্বে ‘প্রণীত আইনের কথা’-তে)। গোঁড়াদের গোঁ ছুটে না তবু কিছুতেই। তাদের পরিষ্কার কথা : গভর্নর জেনারেলের সম্মতি শেষে জারির তারিখ ১৪ এপ্রিলই হলো আইনটার প্রণয়নের তারিখ। সেই তারিখে উত্তরাধিকার সংক্রান্তে, বিশেষত প্রদেশগুলোর কৃষি জমির উত্তরাধিকার সংক্রান্তে আইন প্রণয়নের কর্তৃত্ব ও এক্তিয়ারই কেন্দ্রের আর ছিল না। কেন্দ্রের এই কর্তৃত্বহীনতা আর এক্তিয়ারহীনতার কারণে ১৯৩৭ সালের এ-আইনে বৃহত্তর অর্থের “any property” আর “separate property” লেখা থাকলেও প্রদেশসমূহের কৃষি জমির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সে-আইন প্রযোজ্য হতে পারে না। ব্যাপক বিতর্কের চোটে ব্রিটিশ ভারতের তখনকার গভর্নর জেনারেল (যিনি ভাইসরয়ও বটে) বিষয়টির ওপর মতামত চেয়ে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২১৩ ধারায় ফেডারেল কোর্টে বিশেষ রেফারেন্স পাঠান, যার ভিত্তিতে ১৯৪১ সালের ১ নম্বর ফেডারেল কোর্ট কেস হয়।
কৃষি জমির উত্তরাধিকারে হিন্দু বিধবা স্ত্রীর ভাগবখরা-৪
কী হলো সেই কেসে?
১৯৪১ সালের ২২ এপ্রিল সেই কেসে চিফ জাস্টিসের নেতৃত্বে ফেডারেল কোর্টের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে সুস্পষ্ট মতামত দেওয়া হয় : ১৯৩৭ সালের Hindu Women’s Rights to Property Act-এ বৃহত্তর অর্থের “any property”, “separate property” এসবের মধ্যে কৃষি জমিও অন্তর্ভুক্ত। তবে, ১৯৩৭ সালের ১৪ এপ্রিল আইনটা জারির সময়ে কার্যকর থাকা ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৭ম তপশিলের ২য় তালিকায় ২১ নম্বর ক্রমিকে কৃষি জমির হস্তান্তর ও উত্তরাধিকার সংক্রান্তে আইন করার একচ্ছত্র এক্তিয়ার ছিল কেবলই প্রাদেশিক আইন পরিষদের, কেন্দ্রের কোনো এক্তিয়ার ও কর্তৃত্বই ছিল না প্রদেশসমূহের কৃষি জমির উত্তরাধিকার সংক্রান্তে আইন করার। কেন্দ্রের এই এক্তিয়ারহীনতা ও কর্তৃত্বহীনতার কারণে ১৯৩৭ সালের এ-আইনটি প্রদেশসমূহের কৃষি জমির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে মোটেও প্রযোজ্য হবে না। তবে, কৃষি জমি বাদে উইল ও উত্তরাধিকার সংক্রান্তে আইন প্রণয়নে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৭ম তপশিলে ৩য় তালিকায় ৭ নম্বর ক্রমিকে প্রদেশের সঙ্গে কেন্দ্রেরও একই সমান এক্তিয়ার ও কর্তৃত্ব থাকায় ১৯৩৭ সালের এ-আইনটি প্রদেশসমূহের কৃষি জমি বাদে অন্য যে-কোনো সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য। (ব্যাপারটা ব্রিটিশ ঠিকই বুঝেছিল ফেডারেরেল কোর্টের এ-রায়ের আগেই, তাই Muslim Personal law (Shariat) Application Act, 1937-এর ২ ধারায় “(save questions relating to agricultural land)” বসিয়ে রেখেছিল ১৯৩৭-এর ৭ অক্টোবরে আইনটি করার সময়টাতেই।)
ফলাফল কী দাঁড়ালো তাহলে?
১৯৩৭ সালের Hindu Women’s Rights to Property Act-এর বদৌলতে ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু বিধবা স্ত্রীরা পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্রদের সাথে একই সময়ে এক পুত্রের মতো অংশে জীবনস্বত্বে অন্য সব সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারিণী হতে পারলেও কোনো প্রদেশের কৃষি জমিতে তা পারবে না। তেমনি পূর্বমৃত পুত্রের কোনো পুত্র না থাকলে এক পুত্রের মতো অংশে, আর পূর্বমৃত পুত্রের পুত্র বা পৌত্র থাকলে এক পৌত্রের মতো অংশে জীবনস্বত্বে বিধবা পুত্রবধু অন্য সব সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারিণী হতে পারলেও কোনো প্রদেশের কৃষি জমিতে তা পারবে না। তেমনি পূর্বমৃত পুত্রের পূর্বমৃত পুত্রের কোনো পুত্র বা পৌত্র না থাকলে এক পৌত্রের মতো অংশে, আর পূর্বমৃত পুত্রের পূর্বমৃত পুত্রের পুত্র বা পৌত্র থাকলে এক প্রপৌত্রের মতো অংশে জীবনস্বত্বে বিধবা পৌত্রবধু অন্য সব সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারিণী হতে পারলেও কোনো প্রদেশের কৃষি জমিতে তা পারবে না।
হায়, হায়! ফসকে গেল বিধবার কৃষি জমি ব্রিটিশের একটুখানি ভুলে!
তারপরে অবশ্য শুধরেছিল সে-ভুল কিছু কিছু প্রদেশে। ফেডারেল কোর্টের ঐ-সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে তখনকার ব্রিটিশ ভারতের ১১টি প্রদেশের মধ্যে সেন্ট্রাল প্রভিন্স ও বেরার, ইউনাইটেড প্রভিন্স, নর্থ-ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স, বিহার এবং বোম্বে এই ৫টি প্রদেশে ১৯৪২ সালে, সিন্ধু এবং আসাম এই দুটি প্রদেশে ১৯৪৩ সালে, আর উড়িষ্যা প্রদেশে ১৯৪৪ সালে তাদের প্রাদেশিক আইন পরিষদ ও সরকারগুলো Hindu Women’s Rights to Property (Extension to Agricultural Land) Act প্রণয়ন ও জারি করে নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের কৃষি জমিতেও ১৯৩৭ সালের Hindu Women’s Rights to Property Act প্রযোজ্য করে। ফলে, ব্রিটিশ ভারতে ঐ ৮টি প্রদেশের কৃষি জমিতেও হিন্দু বিধবারা পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্রদের সাথে একই সময়ে উত্তরাধিকারিণী হতে পারেন তাদের প্রাদেশিক ঐ Extension to Agricultural Land Act-এর বদৌলতে। কিন্তু, পাঞ্জাব, মাদ্রাজ আর বেঙ্গল এই ৩টি প্রদেশের প্রাদেশিক আইন পরিষদ ও সরকারগুলো তাদের অধিক্ষেত্রের কৃষি জমির ব্যাপারে আর সেরকম কোনো Extension to Agricultural Land Act প্রণয়নই করেনি। আর তাই, পাঞ্জাব, মাদ্রাজ আর বেঙ্গল—এই ৩টি প্রদেশের কৃষি জমিতে হিন্দু বিধবারা পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্রদের সাথে একই সময়ে উত্তরাধিকারিণী হবার সুযোগ পায়নি ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির আগে পর্যন্ত।
ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির পরে তাহলে কী হলো?
সেই শেষ কথা হবে পরবর্তী পর্বে।
(চলবে)
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, আইনগ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক। ইমেইল: [email protected]