কোক স্টুডিও বাংলার চমকে ঠাসা তৃতীয় সিজনে গানের ‘ফিউশন’ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ জমে উঠেছে। এ পর্যন্ত যে তিনটি গান এই সিজনে রিলিজ হয়েছে, তার মধ্যে শেষেরটি অর্থাৎ ওয়ারফেইজের ‘অবাক ভালোবাসা’ গানটিও বিতর্কের জের এড়াতে পারেনি।
প্রথম দুটো গান কম্পোজিশন, কোরিওগ্রাফি এবং ফিউশনের স্বাতন্ত্র্যে তাক লাগিয়ে দেয় শ্রোতাদের। তবে তাক লাগাতে গিয়ে মূল গানগুলোর স্বকীয়তা নষ্ট হয়েছে বলেও প্রশ্ন তুলেছেন শ্রোতাদের একটি বড় অংশ।
আর সিজনের তৃতীয় গানে কিংবদন্তী বাংলা ব্যান্ড ‘ওয়ারফেইজ’কে হাজির করা হবে তার পুরনো-নতুন লাইন আপ মিলিয়ে, এমন কথা শ্রোতাদের কেইবা ভেবেছিল। ওয়ারফেইজ পারফর্ম করলো তাদের অন্যতম সেরা গান ‘অবাক ভালোবাসা’। যে গানটি তর্কসাপেক্ষে বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসের অন্যতম সেরা ‘লিরিকাল ব্যালাড’।
মেলোডিধর্মী প্রগ্রেসিভ রক জনরার আর কিছুটা সাইকেডেলিক ঘরানার এই গানটি স্থান পেয়েছিল ‘ওয়ারফেইজ’ এর দ্বিতীয় (১৯৯৪) অ্যালবামে। এটি ছিল ওই অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাক। সে সময় গানটি শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মূলত ‘অবাক ভালোবাসা’ গানটির কারণেই অ্যালবামটির গায়ে জোটে সুপার-ডুপার হিটের তকমা।
গানের কম্পোজার এবং গায়ক বাবনা করিম স্বয়ং কোক স্টুডিওর আয়োজনে উপস্থিত থাকবেন এটা কল্পনা করা একটু কঠিনই ছিল। কারণ ১৯৯৬ সালে ওয়ারফেইজের অ্যালবাম ‘জীবনধারা’ প্রকাশিত হওয়ার পর বাবনা করিম উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকা পাড়ি দেন। এরপর থেকে তিনি আর ব্যান্ডের সঙ্গে নেই।
বাবনা করিমকে বলা হয় বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসের অন্যতম সেরা কম্পোজার। ‘অবাক ভালোবাসা’ সেই সাক্ষ্যই দেয়। একবার গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাবনা বলেছিলেন, ২২ বছর আগে লেখা এই গানটি যে এতটা জনপ্রিয় হবে সে কথা কখনোই ভাবেননি।
এই গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাবনার প্রথম সমুদ্র দর্শনের স্মৃতি। তখন তিনি সদ্য ভর্তি হয়েছেন বুয়েটে। কখনোই সমুদ্র না দেখা বাবনার ইচ্ছে হলো সমুদ্র দেখবেন। বন্ধুদের সঙ্গে দলেবলে চলে গেলেন কক্সবাজার। সেখানে ‘শুভ্র বালুর সৈকতে’ বসেই লিখে ফেলেন ‘অবাক ভালোবাসা’।
গানটির কোক স্টুডিও সংস্করণ শুনে শ্রোতাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সেইসব প্রতিক্রিয়ায় সংগীতপ্রিয়দের ফেইসবুক নিউজফিড রীতিমত সয়লাব। রকপ্রেমী শ্রোতাদের কেউ কেউ মনে করছেন মূল গানের ধারেকাছেও যায়নি কোক স্টুডিও প্রকাশিত রিমেকটি।
বাংলা ব্যান্ডগানের একজন নিয়মিত শ্রোতা এবং এ নিয়ে একটি ফেইসবুক পেইজের এডমিন কাজল আব্দুল্লাহ। তিনি নিজের ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “… প্রচুর ড্রাম, বেইজ, বাঁশি, সেতার আরো কতো কী! গানের মূল পিয়ানো পিস বাজানোই হলো না! সর্বনাশ যা হলো, তা আমাদের! গানটি মারা গেলো!”
কবি ও সাংবাদিক হাসনাত শোয়েব অবশ্য বলছেন ভিন্ন কথা। তার ফেইসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “কোক স্টুডিওর এই গান নিজেদের মান বিবেচনায় ভালো। মূল গানের সঙ্গে তুলনায় যাব না, সেটা ন্যায্য হবে না। তবে এইটা কোকের মাস্টার স্ট্রোক হয়ে গেল, একরকম সেভিয়রও। বিশেষ করে বাবনা করিমকে আনতে পারাটা। বাংলা ব্যান্ডের আনসাং হিরো এই লোকটা সত্যিই ম্যাজিকাল!”
গানটির কোক স্টুডিও সংস্করণকে উদ্দেশ করে আরেকজন লিখেছেন, “নতুনটা ছাতার মাথা !”
মূল গানের কিবোর্ড সলোটি কোক স্টুডিও সংস্করণে বাজানো হয়েছে বাঁশিতে। অনেক সংগীত বোদ্ধা এর সঙ্গে ফরাসি পিয়ানিস্ট রিচার্ড ক্লেডারম্যানের বিখ্যাত ট্র্যাক ‘প্রমেনেড ডান্স লেস বইজ’ এর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন।
কোক স্টুডিওর ইউটিউব চ্যানেলের কমেন্ট সেকশনে পাওয়া গেল ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া।
সেখানে একজন মন্তব্য করেছেন, “আমার চাচা ২৭ থেকে ৫২ হলেন, আমি হলাম ১২ থেকে ৩৭। কিন্তু এই গান কখনোই পুরোনো হলো না।”
কোক স্টুডিওকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরেক আইডি থেকে মন্তব্য করা হয়েছে, “অসাধারণ সৃষ্টি, কালোত্তীর্ণ। কোক স্টুডিওকে ধন্যবাদ এই গান পরিবেশনের জন্য।”
আরেকজন মন্তব্য করেছেন, “বাংলা ব্যান্ড মিউজিক বাংলাদেশি গানের মূল শক্তি। আমি মনে করি বাংলা ব্যান্ড মিউজিককে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে কোক স্টুডিও সঠিক প্ল্যাটফর্ম।”
এবার গানের দিকে তাকানো যাক।
গানের একেবারে শুরুতে কয়্যার শিল্পীদের কণ্ঠে শোনা যায় একটি (Hum) হাম। লোয়ার নোটে গাওয়া এই হামটি গানে এনে দেয় ভক্তিভাব। গসপেল সংগীতে এমন হামের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। তানপুরা এবং সনতুরের সঙ্গত গানে যোগ করে প্রার্থনা সঙ্গীতের আবহ।
হামের মাঝেই প্রবেশ করে পলাশের কণ্ঠ। এবারও হাম, তবে নরডিক স্টাইলে। এবার গানটি পূজার বেদী থেকে যেন রওনা দেয় সমুদ্রের বিশালতার দিকে। একটি ছোট বাঁক অথচ কম্পোজিশনের চরিত্রে নিয়ে আসে বিরাট বদল। মূল গানটির সঙ্গে যাদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে এই বদল জরুরি ছিল।
সমুদ্রে দর্শনে ‘অবাক সুখের কান্না’র অভিজ্ঞতার সঙ্গেই যে এর শ্রোতাদের বেড়ে ওঠা। ফলে এই অংশটুকু বাদ দিয়ে বাবনার কণ্ঠ প্রবেশ করলে বরং গানের বিশ্বাসযোগ্যতা কিছুটা হারাতো। লিরিকে স্রষ্টার প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসায় জীবন আলিঙ্গনের সুখের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। গানের বিভিন্ন পর্যায়ে সমবেত শিল্পীদের হামের ব্যবহার সেই ভক্তিভাব ধরে রেখেছে। ক্লাসিক রক-প্রেমীদের এই বিষয়গুলো ভালো না লেগে উপায় নেই।
যদিও গানের মাঝামাঝি পর্যায়ে গিটারে ওভারড্রাইভের ব্যবহার আছে। যার মধ্য দিয়ে গানটি চড়ে যায় এক স্কেল থেকে অন্য স্কেলে। অর্থাৎ গানটির স্কেলের সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটে। গিটার হারমোনিক্সের ব্যবহারও এখানে বৈচিত্র্য যোগ করেছে। এই পুরো পরিবর্তন এবং পলাশের কণ্ঠের প্রবেশ, গানে ভক্তিভাবের রাশ কিছুটা টেনে ধরে।
১৯৯৪ সালে প্রকাশ এই গানের মূল সংস্করণে ২ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের একটি ইন্সট্রুমেন্টাল আছে। যার শুরুটা সাইকেডেলিক এক গিটার সলো দিয়ে। গিটার সলোর পরেই গাঙচিলের ডাক। আর তারপরই আইকনিক সেই কিবোর্ড পিস। এই দুইয়ের মিলন গানটির গীতিকাব্যময়তাকে দেয় বিশেষ দ্যোতনা। গানের দৃশ্যকল্পে যেন এঁকে দেয় বালুকাবেলায় গাঙচিল উড়ে যাওয়ার এক শান্ত ছবি। যদিও কোক স্টুডিও সংস্করণে এই ইন্সট্রুমেন্টাল অংশটি রাখা হয়নি। কোন কোন শ্রোতার মতে এতে গানের মূল আবেদন অনেকটাই নাকি নষ্ট হয়েছে।
এ বিষয়ে আমরা কথা বলেছিলাম ওয়ারফেইজের ড্রামার এবং প্রতিষ্ঠাতাকালীন সদস্য শেখ মনিরুল আলম টিপুর সঙ্গে।
টিপু বলেন, “এখানে অনেক বিষয় ছিল। গানটা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাখতে হবে। অহেতুক লম্বা করতে চাইনি। আর ৬-৭ মিনিটের মধ্যে কতটা কম্প্যাক্টভাবে গানটা উপস্থাপন করতে পারি সেই বিষয়টা ছিল। অরিজিনাল ভার্সনটা আপনি শুনেছেন অলরেডি। ওটা ক্লাসিক ভার্সন। তারপর গাঙচিলের ডাক, অনেক বিষয় আছে। বাট এখানে আমরা যেটা করেছি, কোক স্টুডিওর প্ল্যাটফর্ম অনুযায়ী, এখানে ওই ফিউশনটা আমরা ক্রিয়েট করেছি। গিটার সলোটা এবং ইন্ট্রোটা বাদ দিয়ে। গিটার ইন্ট্রোটা অনেক লম্বা অরিজিনাল গানে। অত ইয়েতে আমরা যাইনি। এভাবে আমরা জিনিসটা করেছি যেন সাড়ে ৬-৭ মিনিটের মধ্যে একটা কমপ্যাক্ট সং আমরা দিতে পারি।”
ওয়ারফেইজের বর্তমান লিড ভোকাল পলাশের এই গানে কণ্ঠ দেওয়া নিয়ে অনেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কারও কারও মতে পলাশের কণ্ঠ এই গানের সঙ্গে ‘একেবারেই যায়নি’। আবার কেউ কেউ বলছেন পলাশের কণ্ঠে ‘নষ্ট হয়েছে পুরো গানের আবেদন’।
এনিয়ে টিপু বলেন, “পলাশ আমাদের বর্তমান লিড ভোকাল। ওর অংশগ্রহণ জরুরি ছিল।”
গানটির মূল এবং কোক স্টুডিও সংস্করণ নিয়ে ড্রামার টিপুর কাছে একটি তুলনামূলক মতামত চাওয়া হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেন, “অবাক ভালোবাসা বাংলা ব্যান্ড মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির কালজয়ী গান। এটা নতুন করে করা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। ১৯৯৪ সালে আমরা করেছি যেটা- ওইটা এক আঙ্গিকে ছিল। সে সময় আমরা যেভাবে ফিল করেছি, সেভাবে করেছি।
“ওখানে বাবনা, রাসেল আলী আর আমি এই তিনজন মিলে গানটি কম্পোজ করেছি। রাসেলের অনেক বড় অবদান ছিল অরিজিনালটায়। কোক স্টুডিও একটা ডিফারেন্ট প্ল্যাটফর্ম। ওদের একটা নিজস্ব আঙ্গিক আছে, স্টাইল আছে, ওইভাবে জিনিসটা করতে হবে। ওইটা আমরা ব্রেইনস্টর্ম করে, রিসার্চ করে যতটুকু করা যায় নতুন জেনারেশনের জন্য — এটা কিন্তু খুব ইমপর্টেন্ট — নতুন জেনারেশনের জন্য আমরা করেছি। যারা ক্লাসিক লিসেনার আছেন তাদের জন্য পুরানটা তো আছেই, প্লাস নতুন জেনারেশনের জন্য কোকস্টুডিওর প্ল্যাটফর্ম অনুযায়ী আমরা কাজটা করেছি। গানকে যতটুকু সম্ভব ঠিক রেখে। আর এখানে আরেকটা ইমপর্টেন্ট পার্ট হলো ফার্স্টটাতে বাবনা একা গেয়েছে, আর এখানে গেয়েছে বাবনা এবং পলাশ।”
সাধারণ শ্রোতাদের সমালোচনার বিষয়টি শেখ মনিরুল আলম টিপু বেশ সহজভাবে নিয়েছেন। তার মতে, মানুষের দ্বিমত থাকবেই। প্রতিটি কাজেই দ্বিমত থাকে। তবে তিনি এ-ও মনে করেন যে বেশিরভাগ মানুষই রিমেক সংস্করণটি ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন।
তার মতে, মূল গানটির সঙ্গে অনেক মানুষের স্মৃতি জড়িত। ফলে ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত মূল গানটি অনেক মানুষের কাছে ‘ভিন্ন আবেদন’ নিয়েই বেঁচে থাকবে।
টিপু বলেন, ‘অবাক ভালোবাসা’ গানটির কোক স্টুডিওর সংস্করণ মূলত ‘নিউ জেনারেশনের জন্য’ নির্মাণ করা হয়েছে।