Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

ভারতের পারিবারিক সঞ্চয়ের নাটকীয় পতনের নেপথ্যে কী

Loan Feature
[publishpress_authors_box]

সঞ্চয়ী জাতি হিসেবে ভারতের সুনাম অনেকদিনের। দেশটির জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় উপার্জনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জমিয়ে রাখতেন। প্রয়োজনে নিত্যদিনের অনেক খরচ কমিয়েও এই প্রবণতা অব্যাহত রাখতেন তারা।

কিন্তু ভারতীয়দের এই চেনা রূপে কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটেছে।

রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ভারতের নিট পারিবারিক সঞ্চয় ৪৭ বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্নে।

পারিবারিক নিট বা প্রকৃত সঞ্চয় হলো- ওই পরিবারের মোট অর্থের বিপরীতে ব্যাংক আমানত, কোম্পানির শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, বন্ড ও অন্যান্য লাভজনক ব্যবস্থাপত্রে বিনিযোগ। তবে মোট অর্থের হিসাবে তাদের সব ঋণ বাদ দিতে হবে।

২০২৩ সালে ভারতের সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালে তা ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে সঞ্চয়ের হার ২ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে। একজন অর্থনীতিবিদ এই পতনকে ‘নাটকীয়’ বলেছেন।

২০২৩ অর্থবছরে ভারতের গৃহস্থালি ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এটি ১৯৭০ এর দশকের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

দেশটির পরিবারগুলো তাদের ভোগ্যব্যয় পূরণে মূলত ঋণের উপরই বেশি নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ায় পারিবারিক সঞ্চয়ের পরিমাণ কমছে। কারণ মানুষ যখন বেশি ঋণ নেয়, তখন তাদের আয়ের একটা বড় অংশ ঋণ মেটাতে চলে যায়। এতে সঞ্চয়ের জন্য খুব একটা টাকা হাতে থাকে না।

মতিলাল ওসওয়াল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের অর্থনীতিবিদ নিখিল গুপ্তার মতে, ভারতে বাড়তে থাকা পারিবারিক ঋণের একটি বড় অংশ হলো নন-মর্টগেজ ঋণ। এই ঋণের জন্য কোনও সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হয় না। ভারতের পরিবারগুলো ব্যবসা ও কৃষিক্ষেত্রে এই ঋণ নেয়।

২০২২ সালে ভারতে নন-মর্টগেজ ঋণের পরিমাণ অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সমান ছিল। আর যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ অন্য অনেক শীর্ষস্থানীয় দেশকে ছাড়িয়ে যায়।

গুপ্তার মতে, ভারতের পরিবারগুলোতে ক্রেডিট কার্ড, ভোগ্যপণ্য, বিবাহ, চিকিৎসাসহ ইত্যাদির জন্য যে ঋণ নেওয়া হয় তা মোট ঋণের ২০ শতাংশের কম। তবে এর হার ক্রমশ বাড়ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কম সঞ্চয় ও বেশি ঋণের ঘটনা ভারতীয় অর্থনীতির জন্য কী বার্তা দিচ্ছে, যেখানে ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।

অধিকহারে ঋণগ্রহণ ও ব্যয় ভারতের ভবিষ্যত অর্থনীতির জন্য কোনও চাপের ইঙ্গিত দিচ্ছে কিনা, তাই এখন পর্যালোচনার বিষয় অর্থনীতিবিদদের জন্য।

এবিষয়ে নিখিল গুপ্তা বলেন, “ভারতের অনেক ভোক্তাই ভবিষ্যতে আয় বৃদ্ধির ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী। কিছু ভোক্তা আবার ভবিষ্যতের ভাবনা না ভেবে বর্তমানেই ভালো জীবনযাপন করতে চান। ব্যয় সম্পর্কে ভারতীয় মানসিকতায় কী কোনও পরিবর্তন এসেছে? সেটা হতে পারে।”

অর্থনৈতিক বিপর্যয় বা সংকটের সময় অনেকে প্রয়োজন বা হতাশার কারণেও ঋণ নেয়। এতে ঋণ খেলাপি হওয়ার শঙ্কা বাড়ে। এই পরিস্থিতিতে, ঋণদাতাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে: তারা কেন ঝুঁকিপূর্ণ ঋণগ্রহীতাদের ঋণ দিতে থাকে?

নিখিল গুপ্তার মতে, ঋণগ্রহীতাদের সম্পর্কে সরকারি পর্যায়ে বিস্তারিত তথ্যের অভাব একটি বড় সমস্যা। ঋণগ্রহীতারা কী কাজ করে? তাদের আয়ের উৎস কী? কতজন ঋণগ্রহীতা ঋণ নিয়েছে? ঋণ নিয়ে তারা কী করছে? তাদের ঋণ শোধ করার ইতিহাস কেমন? এসব প্রশ্নের উত্তর সহজে পাওয়া যায় না।

মতিলাল ওসওয়ালের গবেষক গুপ্তা ও তানিশা লাধা গত দশকে পরিবারিক ঋণ বাড়ার কারণগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন। এতে দেখা যায়, ঋণ বাড়ার প্রধান কারণ ঋণগ্রহীতাদের সংখ্যা বৃদ্ধি। অর্থাৎ আগের চেয়ে বেশি মানুষ এখন ঋণ নিচ্ছে। প্রত্যেক ঋণগ্রহীতার ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে ঋণ দেওয়া অর্থনীতির জন্য বেশি সুবিধাজনক বলে মনে করা হয়।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, ভারতীয় পরিবারগুলোর ঋণ সেবা অনুপাত (ডিএসআর) প্রায় ১২ শতাংশ। ঋণ সেবা অনুপাত হলো আয়ের সেই অংশ যা ঋণ পরিশোধে ব্যবহৃত হয়। ভারতের এই ডিএসআর নরডিক দেশগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চেয়ে এটি বেশি। এসব দেশে পরিবারিক ঋণের পরিমান অনেক বেশি।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় সঞ্চয় হ্রাস ও ঋণ বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ কাটাতে চেষ্টা করে। মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, মহামারীর পর কম সুদের হারের সুযোগ নিয়ে অনেকে গাড়ি ও বাড়ি কেনা, শিক্ষার জন্য ঋণ গ্রহণ করছে। ক্রমবর্ধমান ঋণগ্রহণ শুধু সঞ্চয় হ্রাসের ইঙ্গিত নয়, বরং ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান ও আয়ের সম্ভাবনার প্রতীকও বটে।

ভারত সরকার যদিও কম সুদের হারের কারণে ঋণ গ্রহণ বৃদ্ধিকে ইতিবাচকভাবে দেখছে, তবে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ জিকো দাসগুপ্ত ও শ্রীনিবাস রাঘবেন্দ্র সতর্ক করেছেন।

দ্য হিন্দুতে তাদের লেখা নিবন্ধে বলা হয়, সঞ্চয় হ্রাস ও ঋণ বৃদ্ধির সমন্বয় ‘ঋণ পরিশোধ ও আর্থিক ভঙ্গুরতার’ সৃষ্টি করে। তাদের মতে, ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা ব্যক্তি ও পরিবারের জন্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যদি ভবিষ্যতে আয় বা কর্মসংস্থানের অবনতি হয়, তাহলে ঋণ পরিশোধে সমস্যা হয়।

জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম মাথাপিছু আয় থাকা ভারতে ক্রমবর্ধমান ঋণের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ রথিন রায়।

তিনি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, সরকার মৌলিক সেবা ও ভর্তুকি সরবরাহের জন্য ঋণ করছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষেরা প্রয়োজন বা ভোগের জন্য ঋণ করছে। এই দ্বি-মুখী ঋণ গ্রহণের ফলে দেশে আর্থিক সঞ্চয়ের পরিমাণ আরও কমছে এবং ঋণের সুদহার বাড়ছে।  

গবেষক গুপ্তা ও লাধা মনে করেন না যে, চলতি বছরে ভারতের উচ্চ ঋণ গ্রহণের মাত্রা দেশের আর্থিক বা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এই প্রবণতা দীর্ঘস্থায়ী হলে উদ্বেগ রয়েছে।

ব্যবসায়িক পরামর্শক ও লিলিপুট ল্যান্ড বইয়ের লেখক রামা বিজাপুরকার বলেন, “ভারতীয় ভোক্তারা উন্নত জীবনযাপনের জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। কিন্তু অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও আয়ের অনিশ্চয়তা তাদের এই আকাঙ্ক্ষা পূরণে বাধা সৃষ্টি করে।”

মূল কথা, ভারতীয় ভোক্তাদের সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতার মধ্যেই ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত