Beta
বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪
মন্তব্য প্রতিবেদন

একজন সোনাজয়ীর অকালে চলে যাওয়া এবং কিছু প্রশ্ন

শুটার সৈয়দা সাদিয়া ‍সুলতানা অকালেই হারিয়ে গেলেন। ছবি: সংগৃহীত
শুটার সৈয়দা সাদিয়া ‍সুলতানা অকালেই হারিয়ে গেলেন। ছবি: সংগৃহীত
Picture of বদিউজ্জামান মিলন

বদিউজ্জামান মিলন

[publishpress_authors_box]

কিছু লিখব না বলে মনটাকে অনেক ক্ষণ বাধ দিয়ে রেখেছিলাম। পারলাম না। মেয়েটিকে নিয়ে কিছু কথা লিখতেই হবে। ওপরে যে ছবিটা দিয়েছি, চেয়ে দেখেন? চেহারায় মায়াবি স্নিগ্ধতা।

আপনি যদি ক্রীড়াঙ্গনের কেউ হন, এতক্ষণে জেনে গেছেন কার কথা বলছি। সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা। মাত্র ৩১ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। বিভিন্ন সূত্রের খবর সোমবার চট্টগ্রামের বাসার ব্যালকনি থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

অথচ সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সাদিয়া নিজের আগমনী গান শুনিয়েছিলেন ২০১০ সালে। ঢাকা এসএ গেমসে শুটিংয়ে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে নারী দলগত ইভেন্টে সোনা জিতেছিলেন। সে বছর দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসেও সোনা জেতেন শারমিন আক্তার রত্নাকে সঙ্গী করে। ২০১৩ সালের বাংলাদেশ গেমসেও সোনা জিতেছেন।

পেশাগত দায়িত্বের বাইরে মাঝে মধ্যেই কথা হতো সাদিয়ার সঙ্গে। উচ্ছ্বল। হেসে হেসে কথার জবাব দিতেন। শুটিং ফেডারেশনে গেলেও খুব প্রাণবন্ত দেখাতো তাকে।

২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকের আগের ঘটনা। রত্না, সাদিয়া, শারমিন আক্তার আর তৃপ্তি দত্তকে লন্ডনে ট্রেনিংয়ে পাঠায় বিওএ (বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে)। আমি সাদিয়ার ইন্টারভিউ করলাম টেলিফোনে। সেটা ছাপা হলো প্রথম আলোতে। সেই ইন্টারভিউ দেখে ঢাকায় প্রতিক্রিয়া দেখান বিওএর তৎকালীন ডিজি কর্ণেল ওয়ালীউল্লাহ। এই শুটার কেন আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, সে জন্য সাদিয়ার বাবা সৈয়দ সরওয়ার আলমকে খুব বকাবকি করেছিলেন ওয়ালীউল্লাহ। ভদ্রলোক আমার কাছে সেই অভিযোগ করে সেকি কান্না!

কি এক অজানা কারণে বিশেষ ট্রেনিং সংক্ষিপ্ত করে শুটারদের ঢাকা নিয়ে আসে বিওএ। এমনকি অলিম্পিকের বৃত্তি থেকেও বাদ দেওয়া হয় সাদিয়ার নাম।

লন্ডনে অলিম্পিকের তত্ত্বাবধানে ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলেন (বাঁ থেকে) সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা, তৃপ্তি দত্ত, শারমিন আক্তার ও শারমিন আক্তার রত্না। ছবি: সংগৃহীত

সে ঘটনা বাদ। এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। হঠাৎ একদিন শুনি সাদিয়াকে ক্যাম্প থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উনার বাবা। কারণটা রহস্যময়। এরপর শুনি সাদিয়ার জন্য বিয়ের পাত্র দেখা হচ্ছে। এটাও খবর পেলাম পাত্র সেনাবাহিনীর চাকুরে। বিয়ের দাওয়াতও পেলাম। যাওয়া হয়নি ব্যস্ততায়। তবে সাদিয়াকে শুভকামনা জানিয়েছিলাম।

ততদিনে সাদিয়া শুটিং ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ ২০১৭ সালে শুনি নিজের গায়ে নিজেই আগুন দিয়েছেন। চট্টগ্রাম হাসপাতাল থেকে ঢাকায় বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসার পর তাকে দেখতে যাই হাসপাতালে। অবশ্যই নিউজও করলাম। হাসিখুশি সাদিয়ার বদলে আগুনে পোড়া সাদিয়াকে দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। এটা ২০১৭ সালের অক্টোবরের ঘটনা।

সাদিয়া হঠাৎ করে যেন ক্রীড়াঙ্গন থেকে নির্বাসনে চলে গেলেন। কিন্তু এই নির্বাসন কেন? পরিবার থেকে বলা হচ্ছিল, সাদিয়া মানসিকভাবে অসুস্থ। তারুণ্যের চপলতা ছিল না তাঁর মধ্যে। তবে নির্দিষ্ট কোনও রোগও ছিল না। নানা কারণে বিষণ্নতায় ভোগা। হতাশাও ছিল।

রত্নার সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে সাদিয়ার।

চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের ঢিল ছোড়া দূরত্বে সাদিয়াদের বাসা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে তখন যতটুকু জানতে পেরেছিলাম, সাদিয়া স্বাভাবিক কথাবার্তাই বলতেন। হয়তো অবসরে বসার ঘরের আলমারিতে সারি সারি পদক দেখে ডুব দিতেন পুরনো স্মৃতিতে। কমনওয়েলথে সোনা জয়ের ছবিটা যেন জীবন্ত হয়ে আছে দেয়ালে। সাদিয়াকে অনেকে প্রশ্ন করেছেন, শুটিংয়ে আর ফিরবেন না?

তিনি ছোট্ট করে উত্তর দিতেন, “মনে হয় না। আমি আর আগ্রহ পাই না খেলায়।” আগ্রহে এই ভাটা কেন? তিনি বলতেন, “আসলে খেলা আর ভালো লাগে না, আমি আর খেলব না।”

সাদিয়ার বাবা সৈয়দ সরওয়ার আলম তবুও আশায় বুক বাঁধতেন, “খেলবে খেলবে। অচিরেই সে ফিরে আসবে। অসুস্থ ছিল তো, তাই একটু দূরে আছে। এখন সে অনেকটা সুস্থ।”

কিসের অসুস্থতা সাদিয়ার? কেন সে অসুস্থ হয়েছিল। কি এমন অসুস্থতা যে তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হতো? বিশ্বের কোথাও নিয়ে কি সাদিয়ার মানসিক চিকিৎসা দেওয়া যেত না?

কমনওয়েলথে সোনা জয়ের পর চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস) বলেছিল সাদিয়াকে সংবর্ধনা দেবে, দেয়নি। কর্তাদের মৌখিকভাবে প্রতিশ্রুতি ছিল, অন্তত পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে স্বর্ণকন্যাকে। কিন্তু সাদিয়া কানাকড়িও পাননি। বাবার কণ্ঠে ছিল আক্ষেপ, “আমি সিজেকেএসের কর্মচারী, আমার মেয়েকে সংবর্ধনা বা আর্থিক সহায়তা কেন দেবে বলেন!”

ঢাকা এসএ গেমসে সোনা জয়ের হাসি সাদিয়ার। ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘদিন সাদিয়ার বাবা সিজেকেএসে চাকরি করছেন। তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের জন্মই এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের কোয়ার্টারে। হাটহাজারীর এই মানুষটি পরিবার নিয়ে স্টেডিয়ামে কাটিয়েছেন প্রায় ৩৫ বছর।

এমএ আজিজের গ্যালারির ধূলিকণা গায়ে মেখে সাদিয়ারা বড় হয়েছেন। তাঁর তিন ভাই ঘুম থেকে উঠেই শুনেছেন ব্যাডমিন্টনের শাটল কর্কের আওয়াজ। ওঁরা তিনজনই ব্যাডমিন্টন খেলেন। বড়জন সৈয়দ সাজ্জাদ উল্লাহ সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসে ব্যাডমিন্টনে মিশ্র দ্বৈতে সোনা জিতেছেন, এখন কোচ। মেজোজন সৈয়দ সিবগাত উল্লাহ ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন। ছোটজন সৈয়দ সাফাই উল্লাহও ব্যাডমিন্টন খেলে। সাদিয়ার ছোট বোন সৈয়দা সায়েমা সুলতানাও শুটার।

সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত।

সরওয়ার আলমের অনেক গর্ব। গড়ে তুলেছেন একটা নিখাদ ক্রীড়াপরিবার। কিন্তু সাফল্য এনে দেওয়া সাদিয়ার খোঁজ কেউ রাখেনি। সিজেকেএস, শুটিং ফেডারেশন—কেউ না। সত্যিই বাংলাদেশের আশ্চর্য এক ক্রীড়াঙ্গন। সোনার মেয়েকে ভুলে যেতে সময় লাগল না এতটুকু!

সব শেষে বলব- সাদিয়াকে হয়তো একদিন চিরতরে ভুলে যাবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। এভাবেই সাদিয়ারা যুগে যুগে হারিয়ে যায়। সাদিয়ার জন্য এক ফোঁটা চোখের জল।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত