জামায়াতে ইসলামী যখন ছিল চাপে, তখন দলটির ‘সংস্কারপন্থি’ একটি অংশ গড়ে তুলেছিল নতুন দল আমার বাংলাদেশ পার্টি বা এবি পার্টি। এই দলটির আত্মপ্রকাশ রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহলের সঙ্গে সন্দেহও তৈরি করেছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটায় জামায়াত চাপমুক্ত হওয়ায় চার বছর পর এবি শীর্ষনেতাদের পদত্যাগের ঘটনা নতুন করে গুঞ্জন তৈরি করেছে।
এবি পার্টির প্রয়োজন কি তবে ফুরিয়েছে? দলটি কি আবার জামায়াতের সঙ্গে মিলছে?- এমন সব প্রশ্নও আসছে।
এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু অবশ্য এসব গুঞ্জন উড়িয়ে দিচ্ছেন। জামায়াতের সঙ্গে ভেড়া কিংবা তাদের সঙ্গে জোট করার সম্ভাবনাও নাকচ করে দিচ্ছেন তিনি।
যেভাবে গঠিত হয়েছিল এবি পার্টি
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর এক যুগ আগে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর চাপে পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াত। দলটির শীর্ষনেতারা গ্রেপ্তার হন, সাজাও হয় তাদের।
তখন জামায়াত নেতৃত্বশূন্য হওয়ার পাশাপাশি সরকারের বাধায় কর্মসূচিও পালন করতে পারছিল না। সেই সময়ের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে জামায়াতের বর্তমান আমির শফিকুর রহমান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, “এটা ঠিক রাজনৈতিক দল এবং পক্ষ দফায় দফায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত দলের নাম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।”
২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। তারপর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্য দল হিসাবে জামায়াতের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার কথা যখন আওয়ামী লীগ বলছিল, তখনই আত্মপ্রকাশ ঘটে এবি পার্টির।
জামায়াত থেকে বেরিয়ে একদল ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করে তুলেছিল। এক বছর পর ২০২০ সালের ২ মে তা দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
ঢাকার বিজয় নগরে ‘সায়হাম স্কাই ভিউ’ টাওয়ারে ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলের ২২২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়।
আহ্বায়ক হন সাবেক সচিব, জামায়াত থেকে পদত্যাগী এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী। সদস্য সচিব হন জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত মুজিবুর রহমাম মঞ্জু। যুগ্ম আহ্বায়কদের মধ্যে ছিলেন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত মেজর আব্দুল ওহাব মিনার প্রমুখ।
সেই অনুষ্ঠানে আব্দুল ওহাবই তাদের দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার- এই তিনটি হচ্ছে তাদের দলের মূল নীতি। তাদের লক্ষ্য, বাংলাদেশকে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে উন্নীত করা।
এবি পার্টির এই উদ্যোগে সমর্থন ছিল ২০১৮ সালে জামায়াত ছেড়ে যুক্তরাজ্যে চলে যাওয়া ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের। তিনি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত জামায়াত নেতাদের প্রধান আইনজীবীর ভূমিকায়ও ছিলেন তিনি।
একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ- এই মত জানিয়ে জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি। একই মত জানিয়ে সেই ২০১৮ সালেই জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন মঞ্জু।
তারপরই বিকল্প দল গঠনের উদ্যোগ নেন মঞ্জু। দল গঠনের পর নির্বাচন করার জন্য ইসিতে নিবন্ধনের আবেদনও করে এবি পার্টি। কিন্তু তারা নিবন্ধন পায়নি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সম্প্রতি দলটি ইসির নিবন্ধন পায়। ফলে এখন তারা নির্বাচনে দলীয় পরিচয়ে অংশ নিতে পারবে। তারা নির্বাচনী প্রতীক পেয়েছে ঈগল।
শীর্ষ দুই নেতার পদত্যাগ, কৌতূহল
গত ৭ সেপ্টেম্বর এবি পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তাজুল।
পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১০ সালে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। তখন তাজুল ছিলেন ভিন্ন ভূমিকায়।
ট্রাইব্যুনালে আসামি জামায়াত নেতাদের আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছিলেন তাজুল। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতাদের আপিলের শুনানিতে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সঙ্গেও তিনি থাকতেন।
এখন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত ‘গণহত্যা’র জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে সেই ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখে দাঁড় করাতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানে গুরু দায়িত্ব দেওয়া হলো তাজুলকে।
এরপর গত ৮ অক্টোবর এবি পার্টির আহ্বায়কের পদ ছাড়েন সোলায়মান চৌধুরী। তিনি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছেন বলে এবি পার্টির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
সোলায়মান চৌধুরী নিজেও ফেইসবুকে লেখেন, “আমি এবি পার্টির আহ্বায়কের পদ ত্যাগ করেছি।” তবে তার কারণ জানাননি তিনি।
সাবেক সচিব সোলায়মান এক সময় জামায়াতের মজলিশে শূরা সদস্য ছিলেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি কুমিল্লা-৯ আসনে প্রার্থীও হয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জামায়াত ছাড়েন তিনি।
এক সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানও ছিলেন সোলায়মান। তারও আগে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ফেনীর জেলা প্রশাসক থাকাকালে সেখানে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আলোচিত হন তিনি।
ইতিহাসে পেছন দিকে তাকালে এবি পার্টি গঠনের সঙ্গে ১৯৭৬ সালে গঠিত ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগের (আইডিএল) মিল পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামী ছিল নিষিদ্ধ। ফলে তাদের রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর কোনও সুযোগ ছিল না।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পট বদলে গেলে ১৯৭৬ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রব্বানী পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা আইডিএল নামে ওই প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছিল। এর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আবদুর রহীমও ছিলেন।
১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের নেতারা আইডিএলের ব্যানারেই ভোটে অংশ নিয়েছিল। মুসলিম লীগের সঙ্গে আইডিএল ভোটে অংশ নিয়ে ২০টি আসনে জয়ী হয়েছিল। জয়ীদের মধ্যে রহীমসহ ছয়জন ছিল জামায়াতের।
ওই নির্বাচনের পর জামায়াত স্বনামে প্রকাশ্যে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আইডিএল গুরুত্ব হারায়। গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে এসে আইডিএলকে নিষ্ক্রিয় করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন রহীম বেঁকে বসেছিলেন। এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে জামায়াত ছাড়েন তিনি।
এবি পার্টি যখন গঠিত হয়েছিল, তখন নিবন্ধন হারানো জামায়াত নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি ছিল। ফলে কেউ কেউ ধারণা করছিলেন, এবি পার্টি আসলে জামায়াতের একটি ছদ্মাবরণ। পরিস্থিতি নাজুক হলে জামায়াত কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই দলটি গঠন করিয়েছে।
তবে ২০২০ সালের পর একটি নির্বাচনই হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচন অধিকাংশ দলই বর্জন করে। ফলে জামায়াতের অংশগ্রহণের প্রশ্ন আসেনি। তার আগে ২০১৮ সালের ভোটে জামায়াত নেতারা অংশ নিয়েছিলেন বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে।
নিবন্ধন হারানো জামায়াত নেতাদের যে শঙ্কা ছিল, তা ঘটেছিল সাম্প্রতিক আন্দোলনের মধ্যে। পতনের ঠিক আগে আওয়ামী লীগ সরকার ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসাবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পর সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে।
দাপটের সঙ্গে রাজনীতিতে ফেরা জামায়াতের কাছে দৃশ্যত বিকল্প রাখার কোনও প্রয়োজন এখন আর পড়ছে না। সেই সময়ে এবি পার্টিতে পদত্যাগ তাই কন্ম দিয়েছে কৌতূহলের।
যা বলছেন মঞ্জু
গঠনের পর থেকে এবি পার্টির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন। তার আগে চট্টগ্রাম কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
২০১৮ সালে বহিষ্কৃত হওয়ার সময় মঞ্জু জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য ছিলেন।
সোলায়মান পদত্যাগের পর এবি পার্টির ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের (এনইসি) জরুরি সভায় যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল ওহাব মিনারকে দলের আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। সদস্য সচিব পদে মঞ্জুই রয়েছেন।
শীর্ষ দুই নেতার পদত্যাগ নিয়ে মঞ্জু সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, রাষ্ট্র ও পার্টির প্রয়োজনে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
যুগ্ম আহ্বায়ক তাজুলের পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের কেউ যদি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ডাক পায়, পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সরকারি চাকরি করলে পার্টির পদে থাকতে পারবে না। তাকে চাকরির জন্য দলে থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে।”
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন শেষ হলে তাজুলের আবার দলে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান মঞ্জু।
সোলায়মান চৌধুরীর আহ্বায়কের পদ ছাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “উনি (সোলায়মান) আহ্বায়কের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। দল থেকে নয়। তিনি এখনও পার্টির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদে রয়েছেন।
“আগামীতে দলের কাউন্সিলে তিনি চেয়ারম্যান পদে লড়বেন। তার আগে উনি নিজের ইচ্ছায় এই পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।”
এবি পার্টি কি ভেঙে যাচ্ছে কিংবা জামায়াতের সঙ্গে মিলতে যাচ্ছে- সেই প্রশ্নে মঞ্জু হাসতে হাসতে বলেন, “এবি পার্টির ভাঙনের প্রশ্নই আসে না। জামায়াতের সঙ্গে জোট করারও কোনও সম্ভাবনাও নেই।”