অর্থনীতিবিদদের কড়া সমালোচনা করলেন ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু; রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেও ‘দরবেশ’ হতে চান না বলে জানিয়েছেন তিনি।
সোমবার ঢাকার পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন মিন্টু। অর্থনীতিবিষয়ক প্রতিবেদকদের সংগঠন শুধু তাকে নিয়েই এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মিন্টু বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যবসায়ী মহলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন তিনি।
অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদদের নিয়ে মিন্টু বলেন, “এসব অর্থনীতিবিদদের নিউ ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ বলব? না ওল্ড ক্ল্যাসিকাল অর্থনীতিবিদ বলব? জানি না।
“হঠাৎ করে বললো কিছু ব্যাংক বন্ধ হওয়া দরকার। আজকেও একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলো আর রাখার দরকার নেই। এই অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের সমস্যার একটি মূল কারণ।”
“এরা কি বলে না বলে! এরা একটা সম্পদও সৃষ্টি করে নাই। দুজন লোকের চাকরিও দিতে পারে নাই,” বলেন মিন্টু।
গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের শাসনকালে বাংলাদেশে আর্থিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা ছিল অর্থনীতিবিদদের অনেকের। বিশেষ করে ব্যাংক খাত যে লুটপাটের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, তা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনকারীদের কথায়ও উঠে আসছে।
ইআরএফে ৫ আগস্টের আগে ও পরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বর্তমান ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন মিন্টু। তিনি আওয়ামী লীগ সরকার আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রা নীতির সমালোচনা করেন।
মিন্টু বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছিল। একই সময়ে সরকারের রাজস্ব নীতি ছিল সম্প্রসারণমুখী। এর ফলে এক ধরনের ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।”
মুদ্রা নীতি প্রণয়নের জন্য একটি আলাদা কমিটি করার প্রস্তাব দেন ব্যবসায়ী নেতা মিন্টু, সেখানে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের্ রাখার কথা বলেন তিনি।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের পোশাক খাতের ১৬টি কোম্পানির মালিকানা বিক্রি নিয়েও নিজের মত জানান তিনি।
মিন্টু বলেন, “কারা বিক্রি করবে? কেন করবে? কোনও ব্যবসা-বাণিজ্য বা প্রতিষ্ঠান নৈতিকও না, অনৈতিকও না। এসব প্রতিষ্ঠান যারা চালায়, তারা যদি অনৈতিক হয়, আইন মেনে তাদের বিচার হওয়া উচিৎ। এ নিয়ে আমি কিছু বলব না।
“মালিকদের শাস্তি হোক, কিন্তু কোনও প্রতিষ্ঠান যেন বন্ধ না হয়। কোনও উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান, যেখানে হাজার হাজার লোক কাজ করে, তা নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার নেবে না, সেটা আশা করব।”
পুঁজিবাজার নিয়ে তিনি বলেন, “আমি মনে করি, পুঁজিবাজার ভালো হওয়া দরকার। আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে- আমি দরবেশ হতে চাই কি না?
“আমি এক সময় দরবেশের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী ছিলাম। এটা আমাকে যারা আগে থেকে চেনেন, তারা ভালো করেই জানেন। আমি কখনও পুজিবাজারে ট্রেড করিনি। আমার দরবেশ হওয়ার কোনও ইচ্ছা নাই।”
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে; তার প্রভাব পড়ছে বাণিজ্যেও।
দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে মিন্টু বলেন, “এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বর্তমানে ভারতের সঙ্গে আমাদের একটা মন–কষাকষি চলছে। এর কারণ, ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ভুলে গিয়ে শুধু একটি দলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। এখন সেই সরকার আর ক্ষমতায় নেই, এটা ভারতের জন্য মেনে নেওয়া কষ্টকর।
“বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নীতি হচ্ছে, আগে আপনি (ভারত) ৫ আগস্টের নীতিগত স্বীকৃতি ঠিকমতো দেন; এরপর আমরা ভবিষ্যতের দিকে আগাই। আমিও মনে করি, এটা যথাযথ চিন্তাধারা।”
প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে আত্মসম্মান রেখে সম্পর্ক রক্ষার পক্ষপাতি বিএনপি নেতা মিন্টু।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আগের তুলনায় ভালো হচ্ছে বলে মনে করেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এ সভাপতি।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা এক দিনে ঠিক হবে না। সরকার একদিকে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার এবং অন্যদিকে গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
ব্যাংক খাত নিয়ে মিন্টু বলেন, “আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো স্বল্প মেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেয়। এটা বিনিয়োগের জন্য ভালো না। আমাদের দরকার পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করা। তাহলে সেখান থেকে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ আসবে।”
শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করায় অর্থনীতির অন্য ভিত্তিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও এই ব্যবসায়ীর মত।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “সুদহার বাড়িয়ে টাকার সরবরাহ কমালে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ কমে যাবে। এতে পণ্যের সরবরাহ কমবে। অর্থাৎ মুদ্রা সরবরাহ কমাতে গিয়ে পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেওয়া হবে। আর পণ্য সরবরাহের ঘাটতি থেকে তৈরি মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হয়। সুতরাং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার পাশাপাশি দেশের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।”
পরিস্থিতির পুরোপুরি উন্নতি করতে হলে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রয়োজন মন্তব্য করেন মিন্টু।
তিনি বলেন, “একজন উপদেষ্টা বলেছেন যে তারা দায়িত্বে আছেন, ক্ষমতায় নেই। এটা তো ভয়ংকর কথা! গণতান্ত্রিক সরকারের জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকে। তাই অতিসত্বর নির্বাচন দেওয়া, অন্তত নির্বাচন নিয়ে একটা রোডম্যাপ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।”
বিএনপির এই নেতা চান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দেরি না করেই নির্বাচন দিক।
“যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, সেগুলো তারা (সরকার) এখনই করতে পারে। তবে সাংবিধানিক সংস্কারগুলোর বিষয়ে সবার সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি প্রস্তাব তৈরি করে দিতে পারে। তাতে ভবিষ্যতে যে-ই সরকারে আসুক, তারা ওই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবেন।”