Beta
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

আবু সাঈদকে এনবিআর চেয়ারম্যানের ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ বলা নিয়ে প্রশ্ন

পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ছবি এখন ব্যাপক আলোচিত।
পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ছবি এখন ব্যাপক আলোচিত।
[publishpress_authors_box]

জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত প্রথম শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদকে ‘খেতাবপ্রাপ্ত বীরশ্রেষ্ঠ’ বলেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।

শনিবার ঢাকার আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক আলোচনা সভার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসাবে রাখা বক্তব্যের শুরুতে তিনি স্মরণ করতে গিয়ে এই অভিধা দেন আবু সাঈদকে।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “আমি প্রথমেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল বীরশ্রেষ্ঠসহ সকল শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

“একই সাথে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সকল শহীদ, বিশেষ করে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত শহীদ আবু সাঈদসহ সকল শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং যারা আহত হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন হাসপাতালে, তাদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।”

এই গণআন্দোলনে সরকারের পতন ঘটার পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আবু সাঈদসহ নিহতদের আত্মদানকে স্মরণ করলেও তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব দেওয়ার কোনও ঘোষণা দেয়নি।

এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান কেন আবু সাঈদকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত’ অভিহিত করলেন, তার কোনও ব্যাখ্যা তিনি অনুষ্ঠানে দেননি। বিষয়টি জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে এনবিআরের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান আবদুর রহমান।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. আবু সাঈদের নিহত হওয়ার ঘটনা। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক ছিলেন তিনি।

গত ১৬ জুলাই রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ চলাকালে অস্ত্র তাক করা পুলিশের দিকে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ। গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজপথেই লুটিয়ে পড়েন তিনি।

আবু সাঈদের নিহত হওয়ার ভিডিও ও ছবি সোশাল মিডিয়ায় দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে এবং এই তরুণ হয়ে ওঠেন এই আন্দোলনের প্রতীক। অগুনতি মানুষ ফেইসবুকে অকুতোভয় আবু সাঈদের ছবি প্রোফাইল পিকচার/কভর ফটো করেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ও রাজপথের দেয়ালে দেয়ালে আবু সাঈদের ছবি আঁকা হতে থাকে।

গত ৫ আগস্ট েশখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিতে দেশে ফিরে ড. ইউনূস স্মরণ করেছিলেন আবু সাঈদকে। পরে তার কবর জিয়ারত করতে তিনি রংপুরেও গিয়েছিেলন।

কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আবু সাঈদকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত’ হিসাবে অভিহিত করা যায় কি না?

কেননা, বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের সর্বোচ্চ সম্মাননা বা খেতাব। ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা।

মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠ।

বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব কীভাবে এল

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিদান এবং তাদের মধ্যে আত্মত্যাগের প্রেরণা সৃষ্টির লক্ষ্যে বীরত্বসূচক খেতাব প্রদানের একটি প্রস্তাব মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী মে মাসের প্রথমদিকে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদে উপস্থাপন করেন। ১৬ মে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বীরত্বসূচক খেতাবের প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়।

বাংলাপিডিয়া লিখেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সভায় বীরত্বসূচক খেতাবের নামকরণ চূড়ান্ত করা হয়। এতে মর্যাদার দিক থেকে সর্বোচ্চ খেতাব হিসেবে নির্ধারিত হয়— বীরশ্রেষ্ঠ, এরপর উচ্চ পদমর্যাদার খেতাব— বীর উত্তম, তারপর প্রশংসনীয় পদমর্যাদার খেতাব— বীর বিক্রম এবং সবশেষ বীরত্বসূচক প্রশংসাপত্রের খেতাব— বীর প্রতীক।

১৯৭২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বীরত্বসূচক খেতাবের জন্য নির্বাচন করা হয়। ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ পূর্বের ৪৩ জনসহ মোট ৫৪৬ জন মুক্তিযোদ্ধা খেতাবের জন্য নির্বাচিত হন।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ইউনিট, সেক্টর, ব্রিগেড থেকে পাওয়া খেতাবের জন্য সুপারিশগুলো মুক্তিবাহিনীর উপ প্রধান এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে একটি কমিটি দ্বারা নিরীক্ষা করা হয়। এরপর ১৯৭৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই খেতাব তালিকায় স্বাক্ষর করেন।

১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর পূর্বে নির্বাচিত সকল মুক্তিযোদ্ধার নামসহ মোট ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন খেতাব প্রদান করা হয়। সেখানে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পান মোট ৭ জন (প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ)। বীর উত্তম খেতাব পান ৬৮ জন। বীর বিক্রম খেতাব পান ১৭৫ জন। আর বীর প্রতীক খেতাব পান মোট ৪২৬ জন। এরমধ্যে ২৯৪ জন সামরিক বাহিনীর। আর বাকি খেতাবপ্রাপ্তরা বাংলাদেশ রাইফেলস (বিজিবি) পুলিশ ও মুক্তিবাহিনী থেকে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা বা খেতাবপ্রাপ্ত সাত বীরশ্রেষ্ঠ হলেন— বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান (সিপাহী), বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল (সিপাহী), বীরশ্রেষ্ঠ নুর মুহাম্মদ শেখ (সিপাহী), বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (ক্যাপ্টেন), বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ (ল্যান্স নায়েক), বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন (স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ার), বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান (ফ্লাইট ল্যাফটেন্যান্ট)।

এরপর ১৯৯২ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয়ভাবে বীরত্বসূচক খেতাব প্রাপ্তদের পদক ও রিবন প্রদান করা হয়। ২০০১ সালের ৭ মার্চ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক পুরস্কার এবং সনদপত্র দেওয়া হয়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদ।

এখন যে কারণে কেউ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পেতে পারেন না                                            

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারণ সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী যোদ্ধাদের স্বীকৃতি হিসেবেও বীরশ্রেষ্ঠ ও অন্যান্য খেতাবগুলো দেওয়া হয়েছিল। তবে এই খেতাবগুলো সামরিক বাহিনীর খেতাব হিসাবে ছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব দেওয়ার পর দীর্ঘদিন দেশে আর কাউকে এমন খেতাব দেওয়া বন্ধ ছিল। কিন্তু, আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য সশস্ত্রবাহিনীর ১০৭ জনকে বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ৫ জন বীর উত্তম, ২০ জন বীর বিক্রম এবং ৮২ জন বীর প্রতীক খেতাব পান।

স্বাধীনতা যুদ্ধের খেতাবগুলো পরে সামরিক বাহিনীতে দেওয়া নিয়ে প্রশ্নও উঠেছিল।

এরপর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০১১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে এই খেতাবগুলোকে কেবল মুক্তিযুদ্ধে প্রদত্ত খেতাব হিসেবে সংরক্ষণ করে ভবিষ্যতের কোনও যুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বীরত্বের জন্য নতুন কিছু খেতাব দেওয়া সিদ্ধান্ত হয়।

ওই বৈঠকেই ভবিষ্যতের যুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বীরত্বের জন্য ‘বীর সর্বোত্তম’, ‘বীর মৃত্যুঞ্জয়ী’, ‘বীর চিরঞ্জীব’ ও ‘বীর দুর্জয়’ এই চার ধরনের পদক ও উপাধি দেওয়া যাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

ওই বছরের ২৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

বৈঠকে এসব পদকের জন্য ২ থেকে ৬ হাজার টাকা মাসিক ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে সেখানেও শর্ত ছিল খেতাব দিতে হলে ওই যুদ্ধ অবশ্যই বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত যুদ্ধ হতে হবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় আন্দোলনে নিহতরা অনুপ্রেরণা হয়ে থাকলেও তাদের কারও কোনও রাষ্ট্রীয় খেতাব বা সম্মাননা নেই।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত