সরকারের দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ৯০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা মূল্যের সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মন্ত্রী ও এক প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, তার স্ত্রী, তিন ছেলেসহ পরিবারের ৬ সদস্যের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে।
সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মির্জা আজম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুটি এবং সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ সংস্থাটির কর্মকর্তারা মামলাগুলো করেন বলে দুদকের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আক্তার হোসেন জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলায় অর্থ পাচারের অভিযোগও আনা হয়েছে।
জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে দুদকের উপপরিচালক মো. ফজলুল হক বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এতে জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে ৬১ কোটি ৪২ লাখ ৫৬ হাজার টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এছাড়া তিনি নিজের নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে ৩৪টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ১৪৩ কোটি টাকা জমা ও ১১৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা তোলার মাধ্যমে সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন বলেও মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
আরেকটি মামলায় জাহিদ মালেকের স্ত্রী শাবানা মালেকের ৩ কোটি ১১ লাখ ৪৯ হাজার, ছেলে রাহাত মালেকের ১১ কোটি ৪৯ লাখ ৮৪ হাজার, ছেলের স্ত্রী সাকিবা মালেকের ৯ কোটি ২৮ লাখ ৯৪ হাজার, মেয়ে সাদিয়া মালেকের নামে ১ কোটি ৮৬ লাখ ৯৮ হাজার এবং আরেক মেয়ে সিনথিয়া আকমলের নামে ২ কোটি ৩৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।
দ্বিতীয় মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধলব্ধ কর্মকাণ্ডসহ প্রভাব খাটিয়ে পরিবারের সদস্যদের নামে অবৈধভাবে সম্পদ গড়তে সহায়তা করার জন্য জাহিদ মালেককেও আসামি করা হয়েছে।
এইচ এম এরশাদ সরকারের মন্ত্রী আব্দুল মালেকের ছেলে জাহিদ মালেক ২০১৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারে ছিলেন। মানিকগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হয়ে আসা জাহিদ মালেক তিনি দুই বার প্রতিমন্ত্রী ও এক বার মন্ত্রী হন। গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে তিনি অপ্রকাশ্য।
মির্জা আজম ও তার স্ত্রী দেওয়ান আলেয়ার নামে ৬৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দুটি করেন দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন।
মির্জা আজমের বিরুদ্ধে মামলায় ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। তার মেয়ে মির্জা আফিয়ার আজম অপির নামেও ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৮৩ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ থাকার কথাও বলা হয়েছে মামলায়।
এছাড়া মির্জা আজমের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে ৬০টি ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময় ৭২৫ কোটি টাকা জমা ও ৭২৪ কোটি টাকা উত্তোলনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার কথাও বলা হয়েছে মামলাতে।
মির্জা আজমের স্ত্রী দেওয়ান আলেয়ার নামে ২৩ কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজার টাকার মূল্যের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে আরেকটি মামলায়। এতে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ২০টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ১৮১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা জমা ও উত্তোলেন করে সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
জামালপুর থেকে একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য মির্জা আজমও সরকার পতনের পর থেকে অপ্রকাশ্য। তিনি বিদেশে চলে গেছেন বলে ধারণা করা হয়।
জুনাইদ আহমেদ পলক ও তার স্ত্রী আরিফা জেসমিনের বিরুদ্ধে ১৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুটি মামলা করেছে দুদক। দুদকের উপপরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম বাদী হয়ে মামলা দুটি করেন। একটি মামলায় কেবল পলক আসামি। অন্য মামলায় তার সঙ্গে স্ত্রীকেও আসামি করা হয়েছে।
পলকের বিরুদ্ধে ৮ কোটি ৭৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং স্ত্রী আরিফা জেসমিনের বিরুদ্ধে ৯ কোটি ৫৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
নাটোরের সাবেক সংসদ সদস্য পলক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কয়েকদিন পরই গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার সরকারের সময় বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সাবেক-বর্তমান আমলা, পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের ফাইল খুরেছে দুদক।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিশনেই এসব অনুমোদন দিয়েছিল। তাদের মধ্যে এর আগে কেবল সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পরিবারের সদসদ্যের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়।
গত ২৯ অক্টোবর সেই কমিশনের চেয়ারম্যান ও অন্য দুই কমিশনার পদত্যাগ করলে আইনগত কারণে পরবর্তীতে নতুন করে কোনও অনুসন্ধান, মামলা দায়েরসহ দুদকের গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছিল না।
গত বুধবার সাবেক সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেন দুদক চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করলে দেড় মাস পর বৃহস্পতিবার থেকে পুরোপুরি সচল হয়েছে দুদক। প্রথম দিনেই সাবেক তিন মন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা হলো।