বড় ধরনের যেসব দুর্নীতি কারণে রাষ্ট্র বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর সঙ্গে জড়িতদের কোনও ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ার করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নতুন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন।
আর সাত দিনের মধ্যে নিজেদের সব সম্পদের হিসাব দেওয়া হবে বলেও অঙ্গিকার করলেন তিনি।
আগের দুদক চেয়ারম্যানের পদত্যাগের প্রায় দেড় মাস পর মঙ্গলবার মোমেনকে এই সংস্থার চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
বুধবার ঢাকার সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে যোগদান শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখী হন মোমেন। তিনি বলেন, “যে কাজগুলো করব, আশা করি, জনপ্রত্যাশা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সময় জনগণের প্রত্যাশিত বিষয়গুলো কী কী হতে পারে- যেসব বিষয়ে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে, যেসব বিষয়ে রাষ্ট্র বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং যারা এই কাজগুলো করেছেন, তারা যাতে শেষ পর্যন্ত ছাড় না পান, আমরা চেষ্টা করব সেই কাজটা যেন সঠিকভাবে, ন্যায়পরায়ণভাবে, যথাযথভাবে তদন্তের মাধ্যমে সমাপ্তি করতে পারি।”
এ কাজ করতে গিয়ে কারও দ্বারা প্রভাবিত যাতে না হতে হয়, সেই বিষয়টিও খেয়াল রাখা হবে জানান সাবেক এই সচিব। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮২ ব্যাচের সদস্য আবদুল মোমেন এর আগে গত ১৭ আগস্ট সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন।
তিনি বলেন, “তবে এমন না হয় যে, অসমাপ্ত তদন্ত বা বায়াস্ট (পক্ষপাত) কোনও তদন্ত কিংবা কোনও রাজনৈতিক বা অন্য কোনও মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে কাজ না করি, সেটি আমরা লক্ষ্য রাখব।”
দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ, ন্যায়নিষ্ঠ ও আইন মেনে কাজ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নতুন দুদক চেয়ারম্যান গণমাধ্যমের সহযোগিতাও চেয়েছেন।
তিনি বলেন, “সবাই যদি সাহায্য করেন, আমরা (দুর্নীতি) কমাতে সক্ষম হব। দুর্নীতি একেবারে নির্মূল করতে পারব- সেরকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। আমরা যেন সাধ্যমতো কাজ করতে পারি।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতন হয়েছে, এর মাধ্যমে নব বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে এবং তা প্রকৃতভাবেই ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’ বলে উল্লেখ করের দুদক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “বৈষমের সূচনা মূলত দুর্নীতিতে। যদি আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত না হতাম, বৈষম্য সৃষ্টি অনেক কম হতো। সুতরাং আমরা যদি দুর্নীতিকে কাট করতে পারি, কমিয়ে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে বৈষম্য ক্রমাগত কমিয়ে আসবে।”
দুদক নিয়ে বাজারে প্রশ্ন আছে
দুদক নিয়ে বাজারে অনেক প্রশ্ন আছে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান আবদুল মোমেন বলেন, “দুদক সমাজেরই একটি অংশ, কাজেই সমাজ যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, দুদকও খানিকটা দুর্নীতিগ্রস্ত হতেও পারে। সেক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করব, যাতে আমরা এই চেঞ্জিংটা করতে পারি।”
এক সময় নিজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল এবং দুদকের দীর্ঘ তদন্তে তা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন বলেনও সাংবাদিকদের জানান সাবেক সচিব আবদুল মোমেন।
“এ রকম বেশকিছু অভিযোগ আমারই দিকে আছে, সেটাও আপনারা দেখবেন। যে কারও বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে ন্যায়নিষ্ঠভাবে আপনারা সেটা বিবেচনা করবেন, পর্যালোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে আসবেন।”
পরে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় যে, তিনি বিমানের এমডি থাকা অবস্থায় শত কোটি টাকার দুর্নীতির একটি অভিযোগ ছিল, দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার গুঞ্জনের মধ্যে এই অভিযোগ সম্প্রতি আবারও উঠে এসেছে। এ অভিযোগের কারণে দুদকের কাজে প্রত্যাশা পূরণের অন্তরায় হবে কি না—এমন প্রশ্ন রাখা হয় দুদকের নতুন চেয়ারম্যানের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “কী বলেন, শত কোটি হাজার কোটি! আমি শুরুতেই বলেছিলাম, আমার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। আমার বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে সেই অভিযোগ এসেছে। ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এর ওপর বহু তদন্ত হয়েছে। তদন্ত হয়ে ২০২৩ সালে দুদক থেকে অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়নি, সেই প্রত্যয়ন দুদকই করেছে। সেটি কিন্তু ৫ আগাস্টের পরে নয়, আরও অনেক আগে।
“সেটিও যদি না হয়, তারপরও যদি আপনাদের সন্দেহ থাকে, অভিযোগগুলো তো আপনাদের হাতেই আছে, আপনারা কেন তদন্ত করছেন না? করুন আপনারা।”
সাত দিনের মধ্যে সম্পদের হিসাব দেবেন
মঙ্গলবার দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে নতুন দুই কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাফিজ আহসান ফরিদ।
নতুন দুদক চেয়ারম্যান ও অন্য দুই কমিশনারের প্রতি তাদের সম্পদ বিবরণী প্রকাশের বিষয়ে টিআইবি থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়াম্যান বলেন, “আমি একেবারে স্পষ্টভাবে বলি, আগামী সাত দিনের মধ্যে নতুন যে কমিশন, এ কমিশনের হিসাব আপনারা পেয়ে যাবেন। আগামী সাত দিনের মধ্যে স্থাবর-অস্থাবর যা আছে, আপানারা পেয়ে যাবেন।”
এ সময় পাশে থাকা নতুন নিয়োগ পাওয়া কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী এ বিষয়ে একমত কি না, চেয়ারম্যান জানতে চাইলে তিনিও ‘অবশ্যই একমত’ বলে জানান।
অনেকের অভিযোগ দুদকের কাছে হয়রানির শিকার হয়েছেন, আপনি এমন কোনও কিছু মোকাবেলা করেছেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “আমি তাহলে সহজভাবে বলি, আমার ৯ সালের (২০০৯) অভিযাগ যদি ২৩ সালে (২০২৩) সালে সমাপ্ত হয়, তদন্ত কিংবা অনুসন্ধান, তাহলে এটিই তো একটি হয়রানি।”
হয়রানি দূর করার জন্য এই কমিশন কী কাজ করবে—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের কাজ শুরু করতে দেন, আমার মনে হয়, এই মুখের প্রতিশ্রুতি চেয়ে পরবর্তী সময়ে আপনাদের সঙ্গে যখন দেখা হবে, আমরা কাজের মধ্যেই প্রমাণ করব, হয়রানি কমাতে পেরেছি কি না, তদন্তে গতি আনতে পেরেছি কি না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করতে পেরেছি কি না।”
প্রভাবমুক্ত থাকার প্রতিশ্রুতি
নতুন কমিশন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করবে জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “জনগণ ও এই সরকারের চাওয়া হচ্ছে, এগিয়ে যাওয়া। এখন রাজনৈতিক সরকারও নেই, রাজনৈতিক প্রভাবিতও করবে না। আমরাও প্রভাবমুক্ত থেকে ন্যায়নিষ্ঠভাবে কাজ করে যাব।”
রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা হয়েছে, আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় অব্যাহতিও পেয়ে চান—এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “যদি রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা হয়, তাহলে সেই মামলাটি তো ভুয়া মামলা। মামলা হবে অপরাধের ওপরে। রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা হওয়ার সুযোগ নেই।”
মঙ্গলবার তিন সদস্যের কমিশন নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। তবে বুধবার চেয়ারম্যান আবদুল মোমেন ও কমিশনার জজ মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী যোগ দিলেও শিগগিরই অন্য কমিশনার হাফিজ আহসান ফরিদ কমিশনে যোগ দেবেন বলে জানানো হয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ক্রমশ জোরাল হয়ে ওঠে।
এরপর থেকে ব্যাপক রদবদল দেখে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। সেই ধাক্কায় গত ২৯ অক্টোবর পদত্যাগ করেন দুদকের আগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ও দুই কমিশনার সাবেক জেলা জজ জহুরুল হক ও সাবেক সচিব আছিয়া খাতুন।