বাংলাদেশের সবাই জানে, কবি কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় কবি; স্কুলে সবাই তাই পড়ে এসেছে। এখনও পাঠ্যবইয়ে তাকে জাতীয় কবিই লেখা আছে। সেই সঙ্গে রয়েছে তার বিদ্রোহী কবি পরিচয়টিও। বাংলাপিডিয়ায়ও লেখা আছে, কবি নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর গড়ানোর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসে কবি নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারির প্রস্তাব অনুমোদন পায় বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানিয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন আসছে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন? মুখে মুখে বলা জাতীয় কবির কি আনুষ্ঠানিক কোনও স্বীকৃতি ছিল না?
খুঁজে পেতে দেখা যায়, কবি নজরুলকে জাতীয় কবি বলা হলেও এর কোনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। বাংলাপিডিয়ায়ও তাকে শুরুতে জাতীয় কবি বলা হলেও এই স্বীকৃতির বিষয়ে কিছু লেখা নেই।
সংবিধান সংস্কারের চলমান উদ্যোগের মধ্যে সম্প্রতি কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আয়োজিত এক আলোচনা সভায় কবি নজরুলকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় কবি ঘোষণার দাবি ওঠে।
সেই অনুষ্ঠানের আলোচক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি নজরুল হচ্ছেন জাতীয় কবি। তবে কোথাও এটির ছাপ পাইনি।”
কবি কাজী নজরুলকে সংবিধানে ‘জাতীয় কবি’ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটকে সংবিধান সংস্কার কমিশনে চিঠি দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
তার দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজী নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সরকার। যে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে, নজরুলের লেখা গান-কবিতা সেই অভ্যুত্থানেরও প্রেরণা হয়ে ছিল।
কবি নজরুলকে নিয়ে অনেক কথা, অনেক গবেষণা হলেও তাকে জাতীয় কবি স্বীকৃতির কোনও দলিল না পাওয়ার কথা ২০২২ সালে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত এক কলামে লিখেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আসাদ উদ্দিন।
তিনি লিখেছিলেন, “সত্যিই কি কেউ বলতে পারবে কীসের ভিত্তিতে তাকে জাতীয় কবি দাবি করা হয়? কোনও দলিল কেউ দেখাতে পারবে?”
কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা চেয়ে আসাদ উদ্দিনসহ সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী রিট আবেদনও করেছিলেন।
কবি নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি লিখেছিলেন, “আজকের শিশু জানলেও যুগ যুগ পরের কোনও এক প্রজন্মের শিশুটি জানার সুযোগ নাও পেতে পারে। দূর ভবিষ্যতে কেউ চাইলে এটি চ্যালেঞ্জও করতে পারবে। কর্তৃপক্ষ মনে করলে আবার অন্য কাউকে জাতীয় কবি হিসাবে ঘোষণাও দিয়ে দিতে পারবে।”
জাতীয় কবি কথাটি এল কীভাবে?
কবি নজরুলের জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৪ মে ১৮৯৯) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তখন ভারত ভাগ হয়নি। বৈচিত্র্যময় জীবন পেরিয়ে আসা নজরুলের জীবনের একটি অংশ বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহে কেটেছে। নজরুল বিয়ে করেছেন প্রমীলা দেবীকে, যার বাড়ি কুমিল্লায়।
ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর নজরুল ভারতেই ছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের উদ্যোগে অসুস্থ ও নির্বাক কবিকে ১৯৭২ সালের ২৪ মে সপরিবারে বাংলাদেশে আনা হয়। তাকে রাখা হয়েছিল ধানমণ্ডির এক বাড়িতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। ভবনটির নাম দেওয়া হয়েছিল কবি ভবন, প্রতিদিন সেখানে জাতীয় পতাকা উড্ডীন থাকত। সেই ভবনটিই এখন নজরুল ইসস্টিটিউট।
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। সে বছরই তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মারা যাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পার্শ্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় কবিকে।
তবে নজরুলকে জাতীয় কবি হিসাবে ডাকার বিষয়টি জড়িয়ে অনেক আগে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর। সেদিন কলকাতার আলবার্ট হলে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়, যার উদ্যোক্তা ছিলেন ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, এস ওয়াজেদ আলী, হাবীবুল্লাহ বাহার প্রমুখ।
সর্বভারতীয় বাঙালিদের পক্ষ থেকে দেওয়া সেই সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। উপস্থিত ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ব্যারিস্টার ওয়াজেদ আলী এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ বিশিষ্টজন।
সেই অনুষ্ঠানেই কবি নজরুলকে ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই থেকে নজরুল মুখে মুখে হয়ে যান জাতীয় কবি।
অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন লিখেছেন, “মনে রাখা দরকার, সময়টি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের এবং কবির এ দেশে আগমনের চার দশকেরও বেশি আগের। এর বাইরে স্বাধীনতার আগে বা পরে আর কোনও ঘোষণার কথা সুনির্দিষ্টভাবে কেউ বলতে পারেন না। অর্থাৎ কলকাতার আলবার্ট হলের সেই ঘোষণাই প্রথম ও শেষ কথা।”
প্রয়াত লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের এক সাক্ষাৎকারের কথাও উল্লেখ করেন অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দি, তিনিও স্বীকার করেছিলেন, কলকাতার আলবার্ট হলের ওই ঘোষণা ছাড়া পরবর্তীকালে কাগজে-কলমে নজরুলকে জাতীয় কবি হিসাবে ঘোষণার কোনও দলিল নেই।
অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন লেখক-গবেষক ড. মোহাম্মদ আমীনের এক প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, তিনি যখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ছিলেন, তখন ১৯৭২ সালের মে (কবির বাংলাদেশে আসার সময়) থেকে নিয়ে ১৯৭৬ সালের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত সব গেজেট তিনি খুঁজে দেখেছেন। কোথাও তিনি নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণার গেজেট নোটিফিকেশন, প্রজ্ঞাপন বা অনুরূপ কোনো সরকারি আদেশ পাননি।
নজরুল বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম লিখিত ‘নজরুল-জীবনী’ গ্রন্থটিতেও নজরুলকে ‘জাতীয় কবি’ হিসাবে ঘোষণার কোনও দালিলক প্রমাণের উল্লেখ নেই।
তবে পাঠ্যবইয়ের মতো সরকারি অনেক দলিলে নজরুলকে জাতীয় কবি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আয়োজনে তাকে জাতীয় কবি হিসাবে লেখা ও বলা হয়। তার নামের সঙ্গে জাতীয় কবি ব্যবহার করে সংসদে একটি আইনও পাস হয়েছে। আইনটি হলো, ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৬’। অন্যদিকে ‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৮’ এও তাকে জাতীয় কবি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ নজরুলের কবিতা থেকেই বঙ্গবন্ধু নেন বলে শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কয়েক বছর আগে এক নিবন্ধে লেখেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা মাদারীপুরের স্কুলশিক্ষক পূর্ণচন্দ্র দাসের কারামুক্তি উপলক্ষে কালীপদ রায় চৌধুরীর অনুরোধে কাজী নজরুল ইসলাম ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতায় প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এছাড়া নজরুল ‘নবযুগ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তার ‘বাঙালির বাংলা’ নামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙালির জয় হোক। বাংলার জয় হোক।’ বঙ্গবন্ধু সেখান থেকেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি নিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে মুজিব বর্ষ পালনের সময় ২০২২ সালে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে। তার আগে হাই কোর্ট এমন আদেশ দিয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেই আদেশ স্থগিত চেয়ে সম্প্রতি আদালতে আবেদন হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সময় ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগানের প্রজ্ঞাপন হলেও কবি নজরুলের জাতীয় কবির প্রজ্ঞাপন হয়নি।
বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক, তেমনটি মনে করেন না অ্যাডভোকেট আসাদ উদ্দিন। তার মতে, পরোক্ষ স্বীকৃতি থাকার কারণে কারও হয়ত বিষয়টি নজরেই আসেনি।