যে উপদেষ্টা বলেছেন গ্যাসের দাম বাড়ালে শিল্পে খুব একটা প্রভাব পড়বে না তাকে হা-মীম গ্রুপের যেকোনও একটি কারখানা দিতে চান গ্রুপটির কর্ণধার এ কে আজাদ।
বুধবার ‘ইনভেস্টমেন্ট প্রসপেক্ট অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক এক সেমিনারের বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেওয়ার সময় এ প্রস্তাব দেন তিনি।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সভাপতি দৌলত আক্তার মালা। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান চৌধুরী আীশক মাহমুদ বিন হারুন।
হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ দেশের ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০১০-১২ মেয়াদে।
বিতর্তিক দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোয়নয়ন প্রত্যাশী ছিলেন তিনি। না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ফরিদপুর-৩ (সদর) আসন থেকে নির্বাচন করে জয় পান শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপটির কর্ণধার এ কে আজাদ, যে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর।
সম্প্রতি গ্যাসসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবীর খান ও খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার গ্যাস ও ভ্যাট বাড়ানোর প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর খুব বেশি পড়বে না বলে জানিয়েছেন।
এ নিয়ে পাঁচ দিন আগে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবীর খান ফেইসবুকে পোস্টও দিয়েছেন।
সেখানে তিনি লিখেছেন, “পেট্রোবাংলার গ্যাসের মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তাবটি ভুলভাবে প্রচার করা হচ্ছে। বিদ্যমান শিল্পে গ্যাস এর মূল্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের মূল্য ৩০ টাকাই থাকছে।
“যারা অতিরিক্ত বা নতুন শিল্পে গ্যাস নিতে চান তাদের বাড়তি মূল্য দিতে হবে। কেননা আমাদের দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। ফলে এলএনজি আমদানী করতে হচ্ছে। সঞ্চালন ব্যয় সহ যার মূল্য ইউনিট প্রতি ৭০ টাকার মতো। তার উপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ।”
“কোন সরকারই ৭০ টাকায় গ্যাস কিনে শিল্পকে ৩০ টাকায় দিতে পারেনা। এমনিতেই গ্যাস খাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ ২০,০০০ কোটি টাকা।উল্লেখ্য বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ৩২,০০০ কোটি টাকা। বিগত সরকারের বিদ্যুৎ খাতের দুর্বৃত্তায়নের ফলশ্রুতি এটি।”
“সকল বিষয় বিবেচনায় ও সকলের মতামত নিয়ে, সরকার নয়, বিইআরসি বাড়তি গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করবে।”
তবে এর আগে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের দুর্নীতি-লুটপাটের কথা তোলেন।
এছাড়া গত রবিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ভ্যাট বৃদ্ধি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও ভ্যাট ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব খুব একটা পড়বে না বলে দাবি করেন।
অনুষ্ঠানে কোনও উপদেষ্টার নাম না উল্লেখ করে এ কে আজাদ বলেন, “আমি কালকে (মঙ্গলবার) টেলিভিশনে দেখছিলাম অলরেডি অ্যাডভাইজার সাহেব বলছেন যে, গ্যাসের দাম যদি ৭৫ টাকা হয় তাহলে খুব একটা ইম্প্যাক্ট পড়বে না। তাহলে আমার ইন্ডাস্ট্রিটি ওনারে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম।
“সত্যি যদি উনি আমার ইন্ডাস্টিটি নেন, পাবলিকলি বললাম, আমি ওনাকে দিয়ে দেব। যিনি বলেছেন খুব একটা ইম্প্যাক্ট পড়বে না, যে ইন্ডাস্ট্রিটা ওনার পছন্দ উনি নিয়ে নিক…… চালাক, আমি হেল্প করব।”
তিনি বলেন, “আজকে যারা ভ্যাট বসাচ্ছেন, বিভিন্ন পণ্যের ওপরে তারা কস্ট এনালাইসিস করেন নাই।”
এসময় গত রবিবারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ রপ্তানি তথ্য তুলে ধরে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “গত ৯ তারিখে প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী দেশে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হইছে গত বছরের তুলনায় ৩৬ শতাংশ কম। মৌলিক কাঁচামাল ১২ শতাংশ কম। তার মানে এখন যে কাঁচামাল দরকার সেটাই আমি আমদানি করতে পারছি না। মোট আমদানি কমেছে ১১ শতাংশ।”
একই সময়ে রপ্তানি কমার হিসাব তুলে ধরে তিনি বলেন, “রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এক্সপোর্ট নেগেটিভ।”
“এই যে সমস্ত নেগেটিভের ওপরে আপনি যখন এসব জিনিস বাড়াচ্ছেন, তার ফলাফল তো আপনি চিন্তা করেন নাই”, যোগ করেন এ কে আজাদ।
বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কর্ণাটক, বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও গুজরাট এই পাঁচ রাজ্যে বিনিয়োগকারীকে বিনিয়োগের ৪০ শতাংশ, সর্বোচ্চ ৫০ কোটি রুপি অনুদান দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া শিল্পের জন্য জমি কিনলে ২৫ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে। শিল্পে একজন নারীর কর্মসংস্থানের জন্য ৬ হাজার রুপি এবং একজন পুরুষের কর্মসংস্থানের জন্য ৫ হাজার রুপি দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গ টেনে এ কে আজাদ বলেন, “আমি শুনেছি ব্যবসায়ীরা হুমড়ি খেয়ে ওখানে বিনিয়োগ করছেন। কারণ ৫ বছর এই সুবিধা পাবেন বিনিয়োগকারী। আর আমারে যদি বলেন, গ্যাসের দাম ৭৫ টাকা কর, প্রতি বছর ট্রেডলাইসেন্স রিনিউ কর। এগুলো আদৌ দরকার আছে কি না?”
তিনি বলেন, “বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারত আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার পরও ভারতে এসব সুবিধার বিপরীতে আমাদের ওপর উল্টা অসুবিধা চাপানো হচ্ছে। আমি একজন ব্যবসায়ী, মানে আমি একজন অপরাধী। আমাকে কীভাবে চুষে চুষে খাবে…।
এ কে আজাদ বলেন, “গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে ওনাদের চিন্তা করা উচিত গ্যাস কে কে ব্যবহার করেন এবং কেন ব্যবহার করেন। তার পণ্যের উৎপাদন ব্যয় এখন কত। এটা বাড়ালে কত হবে। রপ্তানি বা অভ্যন্তরীণ- যে পণ্যই হোক তার কস্টটা যেন ওনারা অ্যানালাইসিস করেন ভ্যাটটা বসানোর আগে।”
এসময় বিভিন্ন পর্যায়ে নানা ধরনের অনিয়মে ৪০ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আসলে সব সরকারের চরিত্রই এক। গত সরকার বলেছিল গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করবে। কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি।”
সেমিনারে প্রধান অতিথিরি বক্তব্যে বিডা চেয়ারম্যান চৌধুরী আীশক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, ভ্যাটের বিষয়টি নিয়ে তারা এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি মালয়েশিয়ার উদাহরণ টেনে বলেন, “মালয়েশিয়ায় উৎপাদিত গ্যাসের ৭০ শতাংশই শিল্পে ব্যবহার হয় এবং গ্যাসের বরাদ্দ শিল্প মন্ত্রণালয়ই করে থাকে।”
শিল্পে গ্যাস সরবরাহ সংকট নিয়ে উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ প্রসঙ্গে বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা আপাতত রাষ্ট্রায়ত্ত বন্ধ শিল্প কারখানাগুলো বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের কাছে ছেড়ে দেওয়া যায় কি না চিন্তা করছি। কারণ এখানে ইতিমধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ সুবিধা রয়েছে। ফলে কারখানাগুলো দ্রুত উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব।”
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান ট্রেড লাইসেন্সের কেন লাগবে ব্যবসা করতে সে প্রশ্ন রাখেন।
তিনি বলেন, “ব্যবসা করতে গেলে আমার ট্রেড লাইসেন্স লাগবে কেন? কেউ কি জানে কেন আমাদের ট্রেড লাইসেন্স লাগে? অনেক কোম্পানির ট্রেড লাইসেন্স আমার আছে। কিন্তু আমি জানি না এই ট্রেডলাইসেন্স কেন লাগে। ট্রেড লাইসেন্স একেবারে অ্যাবোলিশ করে দেওয়া উচিত।”
ডিসিসিআই সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, “ট্রেড লাইসেন্স হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব আহরণের একটা খাত। তাহলে আপনি আমার ব্যাংক থেকে প্রতি বছর টাকাটা কেটে নেন। কেন এটা প্রতিবছর রিনিউ করতে হবে? কেন এটা নিয়ে প্রতিবছর দপ্তরে যেতে হবে?”
বিষয়টি দেশের ব্যবসা খাতের প্রতিবন্ধকতার একটি কারণ বলে অভিহিত করেন তিনি।
ডিসিসিআইর সাবেক এই সভাপতি বলেন, “স্বপ্নবাজ উদ্যোক্তা, ব্যাক টু ব্যাক এলসির সুযোগ এবং বন্ডেড ওয়্যার হাউজ সুবিধা- এই তিনটির রসায়নে আজ পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বড় রপ্তানিকারক দেশ।”
বন্ডেড ওয়্যার হাউজ সুবিধা দিয়ে যখন সফলতা পাওয়া গেল তখন সরকার এই সুবিধা সম্প্রসারণ করল না কেন- এ প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “অন্যান্য খাত যেমন- চামড়াজাত পণ্য, বিদ্যুৎ খাত, অটোমোবাইল খাত এসব খাতকে কেন দিলেন না কেন?
এসময় দেশে শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে সব শিল্পের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের দাবি জানান আবুল কাশেম খান।
লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশের সিইও মোহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, “নতুন বিনিয়োগ আনতে দেশের বাইরে গিয়ে রোড শো করা হয়েছে। অথচ দেশেরে বিদ্যমান বিনিয়োগের পরিস্থিতি বোঝার প্রয়োজন ছিল। তাদের চ্যালেঞ্জগুলো সনাক্ত করার দরকার ছিল। বিনিয়োগকারীদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেই। অথচ এই বিনিয়োগকিারীরাই বৈদেশিক বিনিয়োগে দেশের পক্ষে কাজ করবে।
তিনি বলেন, “নীতি ঠিক নেই, আইনশৃঙ্খলা ঠিক নেই, নতুন একটা উদ্যোগ নিতে গেলে ২৩ থেকে ২৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিতে হয়। ট্রড লাইসেন্সের মতো কাজগুলো করা সময় সাপেক্ষ। এসব অসুবিধা দূর করতে হবে।”
এফবিসিআই এর প্রশাসক হাফিজুর রহমান বলেন, “স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করলে দস্যুরা নিয়ে যায়। দোকান দিলে চাঁদাবাজরা মিলে যাবে। এই অনিশ্চয়তা নিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, “দেশে বিনিয়োগের পথ সুগম করতে ট্যাক্স হ্যাভেন না হলেও একটু সুবিধা দিতে হবে, যাতে ব্যবসা করতে গিয়ে কিছু পুঁজি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে না হয়।”
ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিডার হেড অব বিজনেস ডেভলপমেন্ট নাহিয়ান রহমান রচি।