জাপানে জন্মসংখ্যা হ্রাস যেন কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। সরকারের প্রণোদনামূলক নানা পদক্ষেপও বাড়াতে পারছে না শিশু জন্মহার। টানা আট বছর ধরে দেশটিতে জন্মহার পড়তির দিকে। একদিকে ক্রমাগত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যাবৃদ্ধি, অন্যদিকে উদ্বেগজনকহারে জন্মহার হ্রাস- বিপরীতমুখী এই সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে জাপান সরকার।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিত্যক্ত বা ফাঁকা বাড়ির সংখ্যাবৃদ্ধি। জাপানজুড়ে বর্তমানে ফাঁকা বাড়ির সংখ্যা ৯০ লাখ। পরিত্যক্ত এসব বাড়ি দুর্যোগপরবর্তী উদ্ধারকাজে প্রতিবন্ধকতাসহ নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ আপাতত দেখছে না কর্তৃপক্ষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাপানের জনসংখ্যা কমতে কমতে এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সেখানে বাড়ির কোনও অভাব নেই। অভাব শুধু সেখানে বাস করা মানুষের।
জাপানিরা ফাঁকা বাড়িকে আকিয়া বলে। সাধারণত গ্রামাঞ্চলের পরিত্যক্ত আবাসিক বাড়িগুলোর ক্ষেত্রে এই পরিভাষা ব্যবহার করা হয়।
তবে কেবল গ্রামে নয়, টোকিও, কিয়োটোর মতো জাপানের প্রধান শহরগুলোতেও আকিয়ার সংখ্যা নেহাতই কম নয়।
জাপানে দিনকে দিন ফাঁকা বাড়ির সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে দেশটির কান্দা ইউনিভার্সিটি অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রভাষক জেফরি হল বলেন, “এটি জাপানের জনসংখ্যা হ্রাসের লক্ষণ। অতিরিক্ত ঘর নির্মাণ কিন্তু সমস্যা নয়। এসব ঘরে থাকার মতো মানুষ নেই, এটাই সমস্যা।”
জাপানের স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, দেশটির ১৪ শতাংশ আবাসিক ভবন ফাঁকা পড়ে আছে। এসব ভবনে কেউ থাকে না।
আবাসিক এসব ভবনের তালিকায় সেকেন্ড হোম আছে। আবার নানা কারণে বাসিন্দাদের অস্থায়ীভাবে ফেলে যাওয়া ঘরও আছে। যেমন দেশের বাইরে কাজ করা জাপানিরা তাদের ঘরগুলোতে তালা মেরে কর্মস্থলে চলে যান। ফলে সেগুলো ফাঁকাই পড়ে থাকে।
অস্থায়ী এসব ফাঁকা ঘরের সঙ্গে অবশ্য আকিয়ার ঠিক তুলনা চলে না। কারণ এসব ঘরের সবগুলোই শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত থাকে না। কোনও না কোনও সময় মালিকরা ফিরে এসে ঘরগুলোতে আবার বসবাস শুরু করেন। কিন্তু প্রাণের স্পন্দনের অভাবে মনুষ্যবিহীন আকিয়াকে ধ্বংসের পথে হাঁটা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আকিয়ার ক্রমাগত সংখ্যাবৃদ্ধি জাপান সরকার ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করছে। যেমন ভূমিকম্প ও সুনামি প্রবণ জাপানে দুর্যোগ দেখা দিলে উদ্ধারকর্মীদের ঝুঁকি বাড়ায় আকিরা। এছাড়া যত্নের অভাবে সম্ভাব্য বিপদ ডেকে আনে পরিত্যক্ত এসব ঘর। আর জীর্ণ শহরগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগও এর মাধ্যমে ব্যাহত হয়।
অতিরিক্ত ঘরের সংকট
দালানকোঠার মতো স্থাবর সম্পত্তি সাধারণত উত্তরাধিকার সূত্রে পায় পরের প্রজন্ম। কিন্তু জাপানে প্রজনন যে হারে কমছে, তাতে সেখানে উত্তরাধিকার খুঁজে পাওয়াই দুরূহ হয়ে পড়েছে।
তাছাড়া তরুণ প্রজন্মের বড় অংশই গ্রামের চেয়ে শহরে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। উদ্ভূত পরিস্থিতি আকিয়ার সংখ্যাবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা জানান, পরিত্যক্ত কয়েকটি ঘর নিয়ে প্রশাসনিক জটিলতাও কম নয় কারণ নথিভুক্ত না হওয়ায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানে না, ঘরগুলোর মালিক কারা।
এ কারণে জাপান সরকারের পক্ষে গ্রামীণ জনপদগুলোকে (যেখানে বয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা বেশি) পুনরুজ্জীবিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি বিকল্প জীবনধারায় আগ্রহী জাপানি তরুণদের আকৃষ্ট করার সরকারি প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হচ্ছে।
জাপানের বিদ্যমান করনীতির কারণে আকিয়ার মালিকদের একাংশ মনে করেন, ভেঙে ফেলে পুনরায় নির্মাণের চেয়ে ফাঁকা ঘর যেভাবে পড়ে আছে, সেভাবে ফেলে রাখাই শ্রেয়।
মালিকরা যদি তাদের ফাঁকা ঘর শেষমেশ বিক্রি করার ব্যাপারে মনস্থির করেনও, তখন ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায় না-এমনটাই জানান প্রভাষক জেফরি হল। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “অধিকাংশ আকিয়া গণপরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা এমনকি মুদির দোকান থেকে দূরে অবস্থিত। তাই কেউ কিনতে চায় না।”
অতিমাত্রায় কম মানুষের সংকট
জাপানের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এক-দুই বছর নয়, বেশ কয়েক বছর ধরেই নিম্নমুখী। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় দেশটির জনসংখ্যা ৮ লাখেরও বেশি কমে ১২ কোটি ৫৪ লাখে নেমে এসেছে।
সরকারি তথ্য বলছে, জাপানে আট বছর ধরে শিশু জন্মহার হ্রাস পাচ্ছে। ২০২৩ সাল ছিল একনাগাড়ে জন্মহার হ্রাসের অষ্টম বছর।
জাপানে জন্মহার বছরের পর বছর ধরে ১ দশমিক ৩ শতাংশের কাছাকাছিতে আটকে আছে। স্থিতিশীল জনসংখ্যা ধরে রাখতে জন্মহার ২ দশমিক ১ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন।
গত সপ্তাহে জাপানের স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত ৪৩ বছর ধরে দেশটিতে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা কমতে কমতে রেকর্ড ১ কোটি ৪০ লাখে নেমে এসেছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অতিরিক্ত বাড়ি আর অতিমাত্রায় কম জনসংখ্যার জেরে সৃষ্ট সমস্যা থেকে জাপান সরকার অচিরেই বের হয়ে আসতে পারবে না। সময় লাগবে তাদের।
জাপানের টোকিও সিটি ইউনিভার্সিটির আর্টিটেকচার অ্যান্ড আরবান ডিজাইনের অধ্যাপক ইয়ুকি আকিয়ামা বলেন, “এ বছরের জানুয়ারিতে জাপানের ইশিকাওয়া অঞ্চলের নোটো উপদ্বীপে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। সে সময় ওই অঞ্চলের পরিত্যক্ত ঘরগুলোর কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয় বাসিন্দা ও উদ্ধারকর্মীদের।
“নোটো উপদ্বীপে প্রচুর আকিয়া ছিল। এসব আকিয়া কেবল এলাকার বাসিন্দা নয়, ভূমিকম্পের পর বাড়িঘর পুনর্নির্মাণেও প্রতিকূলতা তৈরি করে।”
এ বিষয়ে টোকিও সিটি ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক আরও বলেন, “জানুয়ারিতে ভূমিকম্প বা সুনামিতে ফাঁকা বাড়িগুলো ভেঙে পড়ায় উদ্ধার অভিযান কার্যক্রম জটিল হয়ে পড়ে। মালিকানা নিয়ে অস্পষ্টতার কারণে ভূমিকম্পের পর কর্তৃপক্ষ বুঝে উঠতে পারেনি, ক্ষতিগ্রস্ত ফাঁকা বাড়ির মধ্যে কোনগুলো তারা পরিষ্কার করবে। এতে পুনর্নির্মাণ কাজ বাধার সম্মুখীন হয়।”
তথ্যসূত্র: সিএনএন