সম্প্রতি সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তা নাশকতা বলে দাবি উঠেছিল খোদ সরকারের উপদেষ্টাদের তরফ থেকেই। তবে তদন্তে তেমন কোনও আলামত পাওয়া যায়নি। তার ১৫ দিনের মধ্যে সচিবালয়ের এক মাইলের মধ্যে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে অগ্নিকাণ্ড ঘটল।
ওই মাঠ থেকে অস্থায়ী আদালত সরিয়ে নিতে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে বৃহস্পতিবার ভোরে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে কেউ হতাহত না হলেও এজলাস কক্ষ পুড়ে যাওয়ায় আদালতের কাজ চলতে পারেনি।
বিডিআর বিদ্রোহের সময় পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার শনিবার এখানে পুনরায় শুরুর কথা ছিল।
আলিয়া মাদ্রাসার বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন, ভোরে বহিরাগত একদল এসে আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে আগুন লাগানো হয়েছিল, নাকি দুর্ঘটনাবশত আগুন লেগে গিয়েছিল, সে বিষয়ে পুলিশ এখনও কিছু বলছে না। ফায়ার সার্ভিসও আগুনের সূত্রপাতের বিষয়ে এখনও কিছু বলেনি।
২০০৯ সালে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিডিআরে বিদ্রোহের সময় পিলখানায় বাহিনীর সদর দপ্তরে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তা নিয়ে দুটি মামলা হয়। একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়, অন্যটি বিস্ফোরক আইনে।
এদুটি মামলায় আসামির সংখ্যা বিপুল হওয়ায় তার বিচার নির্বিঘ্ন করতে ঢাকার জজ আদালতের একটি বিশেষ এজলাস আওয়ামী লীগ সরকার স্থাপন করে বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসার এই মাঠে। সেখানে হত্যামামলার বিচার শেষে রায়ও হয়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এই এজলাসে দেওয়া রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৬০ আসামির হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৭ জন।
সেই মামলার আপিলের রায়ে হাই কোর্ট ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি ২৯ হাজার পৃষ্ঠার রায় দেয়। তাতে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে, যাবজ্জীবন দণ্ডিতদের ১৪৬ জনের সাজাও বহাল রাখে উচ্চ আদালত।
গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হাই কোর্ট গত মাসে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্তের জন্য কমিশন গঠনের আদেশ দেয়।
এদিকে হত্যামামলার বিচারকাজ বিচারিক আদালতে শেষ হলেও বিস্ফোরক মামলাটি ঝুলছিল। সেই মামলার বিচার বকশীবাজারের সেই অস্থায়ী আদালতে বৃহস্পতিবার পুনরায় শুরু হবে বলে বুধবারই আইন মন্ত্রণালয় জানায়।
যেখানে স্থায়ী কাঠামো বানিয়ে অস্থায়ী আদালতের বিচারকাজ চলছিল, সেই মাঠ আলিয়া মাদ্রাসা খেলার মাঠ হিসাবে ব্যবহার করলেও এর মালিকানা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারা অধিদপ্তরের দাবি এই মাঠটি তাদের; অন্যদিকে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দাবি, এটা তাদের।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার রায় এই অস্থায়ী আদালতেই হয়েছিল। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার বিচারও হয়েছিল এই আদালতে।
আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এই মাঠ থেকে আদালত সরানোর দাবি জানিয়ে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। আবার আদালতের কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত শুনে তারা বুধবার রাতে বিক্ষোভে নামে। তাদের বক্তব্য, এখানে আদালত চললে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। এর আগে বেশ কয়েকবার তারা সরকারি দপ্তরে এই কথা জানিয়েছিলেন, কিন্তু কোনও প্রতিকার পাননি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বুধবার রাত থেকে শিক্ষার্থীরা মাঠে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিল। সকালে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মোড়, পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার, বকশীবাজার অরফানেজ রোড ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয়।
এরমধ্যেই ভোরে আদালতে আগুন লাগে। তাতে এজলাস কক্ষের চেয়ার, টেবিল, এসিসহ সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
আলিয়া মাদ্রাসার বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের বলেন, ভোরে বহিরাগত একদল ঢুকে আদালতে আগুন দিয়ে যায়। তখন শিক্ষার্থীরা ফায়ার সার্ভিসে খবর দেন।
এই বহিরাগত কারা, সে বিষয়ে শিক্ষার্থীরা কিছু বলতে পারেনি।
আগুন লাগার খবর পেয়ে নেভাতে গিয়ে স্থানীয়দের বাধার মুখে পড়ার কথা জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা রাত ৪ টা ২২ মিনিটে প্রথমে আগুন লাগার খবর পাই। সঙ্গে সঙ্গে লালবাগ ফায়ার সার্ভিসের ২টি ইউনিট ঘটনাস্থলে রওনা দেয়। কিন্তু স্থানীয় মানুষ ফায়ার সার্ভিসকে আলিয়া মাদ্রাসার ভেতরে ঢুকতে দেয়নি।”
তিনি জানান, পরে পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তায় ফায়ার সার্ভিসের যখন ভেতরে ঢোকে, ততক্ষণে আগুন নিভে গেছে। এরপর সকাল ১১টা ৩৩ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে আসে।
লালবাগ ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগুনে এজলাস কক্ষের চেয়ার, টেবিল, এসিসহ সব কিছু পুড়ে গেছে।
আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে তদন্তের আগে কিছু বলতে রাজি হননি ফায়ার সার্ভিসের কোনও কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক আইনজীবী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সকাল থেকে আন্দোলন করছিল শিক্ষার্থীরা। বিচারকের গাড়িও আটকে দিয়েছিল তারা। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না আদালতে।”
পুলিশ ও সেনাবাহিনী সকালেই বকশীবাজারে যায়। তখনও আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সড়কে বিক্ষোভ করছিল। তবে দুপুরের আগেই সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেওয়া হয়।
ঘটনাস্থলে থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের চকবাজার অঞ্চলের সহকারী কমিশনার মো. মাহফুজার রহমান সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের দাবি কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
তবে অগ্নিকাণ্ডের কারণ কী, সে বিষয়ে সেখানে থাকা কোনও পুলিশ কর্মকর্তা কিছু বলতে রাজি হননি।
আলিয়া মাদ্রাসার আপত্তির মধ্যে এর আগে বিভিন্ন সময় ওই আদালতের এজলাস ভাংচুর করা হয়েছিল। গত ৩১ ডিসেম্বের সন্ধ্যায় একদল ব্যক্তি মাঠের সীমানা প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে আদালতের আসবাবপত্র ভাংচুরের পাশাপাশি মাঠে থাকা কিছু চেয়ারে আগুনও ধরিয়ে দিয়েছিল।
বৃহস্পতিবার আগুন লাগার পর দুপুরে অস্থায়ী বিশেষ আদালতের পোড়া এজলাস দেখতে যান ঢাকার মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক ইব্রাহিম মিয়া। তার নেতৃত্বেই এদিন এখানে বিচার চলার কথা ছিল।
বিচারক ইব্রাহিম গাড়ি থেকে নেমে আধা ঘণ্টাকাল সেখানে থেকে পোড়া এজলাস কক্ষ ঘুরে দেখেন। তার সঙ্গে রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের আইনজীবীদের পাশাপাশি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও ছিলেন। আইনজীবীরা তাকে বলেন, এখানে বিচারকাজ চলোর মতো পরিস্থিতি নেই।
পরে রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী আলহাজ বোরহান উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “আজকে প্রেক্ষাপটে আদালত পরিচালনা করার মতো পরিবেশ নেই। বিচারককে এটা অবহিত করা হয়েছে। মামলার পরবর্তী তারিখটা কবে হবে, আমরা ও আসামি পক্ষের আইনজীবীদের সাথে কথা বলে বিচারক ঠিক করবেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তারিখ নির্ধারণ করা হবে।”
এদিকে বকশীবাজারের এই ঘটনার মধ্যেই সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবির সাবেক সদস্যদের পরিবারের সদস্যরা বিক্ষোভে নেমেছেন।
তাদের দাবি, পিলখানা হত্যাকাণ্ডে হওয়া মামলায় দণ্ডিত সাবেক বিডিআর সদস্যদের কারামুক্তি, মামলার পুনঃ তদন্ত, ন্যায়বিচার নিশ্চিত, চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহাল-পুনর্বাসন করা।
বৃহস্পতিবার দুপরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হন তারা। তারপর তারা শাহবাগে অবস্থান নেন।
২০০৯ সালের রক্তাক্ত সেই বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নাম বিডিআর থেকে বদলে বিজিবি করা হয়, বাহিনীর পোশাকেও আসে পরিবর্তন।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রচলিত আদালতে হলেও বিদ্রোহের বিচার হয় বিডিআরের আদালতে। তাতে অসংখ্য সদস্যের সাজা হয় এবং সাজাপ্রাপ্তরা চাকরি হারান।