Beta
মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫

আলিফ হত্যা : পদত্যাগ করে কেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাইল আইনজীবীদের কমিটি

আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ।
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ।
[publishpress_authors_box]


তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সহিংসতা তদন্তে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি।

হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে হাজির করার পর তার অনুসারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছিলেন আলিফ।

এরপর সংবাদ সম্মেলন করে আইনজীবী সমিতি প্রশাসনের তদন্তের বাইরে নিজেরাই ঘটনা খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছিল। ৯ ডিসেম্বর গঠিত হয় সেই তদন্ত কমিটি; কমিটির সবাই চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য।

১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সেই কমিটির প্রতিবেদন জমার সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। ২০ ডিসেম্বর এসে জানা গেল, কমিটির সবাই পদত্যাগ করেছেন। একইসঙ্গে সেই ঘটনা তদন্তে জেলা জজকে প্রধান করে একটি বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছেন পদত্যাগী সদস্যরা।

তারা কেন পদত্যাগ করলেন, কেনইবা নিজেরা তদন্ত না করে কেন বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনের সুপারিশ করলেন, তা নিয়ে বেশ আলোচনা তৈরি হয়েছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান ও সাবেক পিপি আবদুস সাত্তার যুক্তি দেখাচ্ছেন, ঘটনার সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রশাসন ও আদালতের কর্মকর্তারাদের সম্পৃক্ত থাকার সম্ভাবনা থাকায় এই পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আবদুস ছাত্তার বিএনপি সমর্থক। সদস্য সচিব কাশেম কামালও বিএনপি সমর্থক। তিনি সমিতির বর্তমান কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন জাফর ইকবাল, মো. মাঈনুদ্দিন সোহেল ও মোহাম্মদ ইবনু।
পদত্যাগের কারণ জানতে চাইলে আবদুস সাত্তার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি নিজে একটি দলের রাজনীতি করি, আবার আমি সিনিয়র আইনজীবীও।

“এই ঘটনায় ইতোমধ্যে ছয়টি মামলা হয়েছে, চলছে তদন্ত। সেই মামলা এখন দেশে-বিদেশে চাঞ্চল্যকার মামলা হিসেবে আলোচিত হয়েছে। এখন আমরা আইনজীবীরা যদি তদন্ত করি, সেটি নিরপেক্ষ নাও হতে পারে। তাই আমরা সরে দাঁড়ালাম।”

সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে চট্টগ্রামের এক বিএনপি নেতার করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। তার প্রতিবাদে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনগুলো বিক্ষোভ করে। ভারত সরকারও তার মুক্তির দাবি জানায়।

২৬ নভেম্বর চিন্ময়কে কারাগারে পাঠানোর আদেশ হওয়ার পর আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ শুরু করে তার অনুসারীরা। এক পর্যায়ে তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। আইনজীবীরাও বিক্ষোভে নামেন। এক পর্যায়ে আদালত এলাকা সংলগ্ন সেবক কলোনির কাছে কুপিয়ে হত্যা করা হয় আলিফকে।

প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে আদালতে নেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে হাজির করা হয় বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে। সেদিনই তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

আলিফ হত্যার ঘটনায় তার বাবা জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন। এছাড়া পুলিশের ওপর হামলা, কাজে বাধাদান এবং আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের ওপর হামলা ও হাতবোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় আরও পাঁচটি মামলা হয়েছে। সেই মামলাগুলো পুলিশ তদন্ত করছে। ছয়টি মামলায় ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ৪০ জন। তাদের মধ্যে হত্যায় জড়িত অভিযোগে ১০ জন গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছে।

আইনজীবী সাত্তার বলেন, “ঘটনার আগে-পরে অনেকগুলো কারণ বিশ্লেষণ করে আমার কাছে মনে হয়েছে, ঘটনার সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রশাসন ও আদালতের কর্মকর্তারাও সম্পৃক্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে তাদের সবাইকে তদন্তে আনা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। এটা জেলা জজের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় কমিটির পক্ষেই সম্ভব। তাই আমরা সেই প্রস্তাব আইনজীবী সমিতিকে দিয়েছি।”

তদন্তে নেমে এখন আইনজীবীরা সরে দাঁড়ানোয় প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি আইনজীবী সদস্যদের সঙ্গে আলাপ না করেই কমিটিতে নাম দেওয়া হয়েছিল? নাকি তারা চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার তদন্তে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না?

আইনজীবী সাত্তার বলেন, ঘটনার আগে-পরে মিলিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন তাদের সামনে এসেছে।

“চাঞ্চল্যকার মামলার আসামিদের আদালতে হাজিরের ক্ষেত্রে ভোরে ভোরে আনার প্রচলন আছে। কেন চিন্ময় কৃঞ্চ দাসকে আদালতে আনা হলো সকাল ১০টার পর? আর সেই মামলার ভার্চ্যুয়ালি শুনানি করলে এই ঝামেলা হতো না। কিন্ত সেটি করা হয়নি কেন? চিন্ময় কৃঞ্চ দাসের অনুসারীদের আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়ার আগাম গোয়েন্দা তথ্য ছিল কি না?”

তিনি আরও বলেন, “(চট্টগ্রামের) আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের হতে গেলে প্রিজন ভ্যানের মুখ হতে হবে পূর্বমুখী। কিন্তু সেখানে প্রিজন ভ্যানের মুখটি উল্টো দিকে পশ্চিমমুখী কেন ছিল? প্রিজন ভ্যানের ভেতরেই চিন্ময়ের কাছে হ্যান্ডমাইক কীভাবে গেল? পুলিশ হেফাজতে থেকে কীভাবে তিনি বক্তব্য দিলেন? সেগুলো অনেক বড় প্রশ্ন তদন্তের জন্য।

“আর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে কোনো জামিন আবেদন নামঞ্জুর হলে বা রিজেক্ট হলে তার নকল কপি নিতে ৪-৫ দিন পর্যন্ত দরকার হয়। কিন্তু ইসকন নেতা চিন্ময় দাসের মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন রিজেক্ট (নামঞ্জুর) হওয়ার পর এক ঘণ্টার মধ্যে সার্টিফাইড কপি বা নকল পেয়ে গেলেন! ওইদিন আবার সঙ্গে সঙ্গে মিস কেস দাখিল করে শুনানির জন্য তারিখ পেয়ে গেলেন! ফলে এসব প্রশ্ন তদন্তে আসতে হবে। সেদিন আদালত প্রাঙ্গণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নীরব ছিল।”

“ঘটনার দিন একাধিক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার। সাধারণ কেউ তদন্ত করলে সেটি ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। তাছাড়া আমাদের কমিটিতে যারা আছেন সবাই আইনজীবী। তাই আমাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকবে। এ কারণে আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই,” বলেন সাত্তার।

এদিকে আইনজীবী সমিতির একাধিক নেতা বলেছেন, আলোচনা না করেই তদন্ত কমিটিতে কারও কারও নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ফলে দেখা গেছে, কমিটি গঠনের এক সপ্তাহ পর ১৭ ডিসেম্বর সচিবসহ কমিটির চার সদস্য পদত্যাগ করেন। কমিটি প্রধানও তা জানতেন না। এরপর ১৯ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন তদন্ত কমিটি প্রধান। অর্থাৎ কমিটি গঠনের পর একটি সভাও হয়নি।

“এই মামলা দেশে-বিদেশে মনিটর হচ্ছে। তাছাড়া পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা সেদিন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। ফলে তদন্ত তাদের বিরুদ্ধে করাটাও অনেক কঠিন। এই কারণে উটকো ঝামেলায় পড়ার চেয়ে সরে দাঁড়ানোই শ্রেয় বলে তারা মনে করেছেন,” বলেন এক আইনজীবী।

পদত্যাগের বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তাদের পদত্যাগপত্র আমার পেয়েছি। তারা যে কারণ দেখিয়েছেন এবং যে সুপারিশ করেছেন, সেই বিষয়গুলো আমরা আমলে নিয়েছি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা ২৬ ডিসেম্বর সভা ডেকেছি। সেখানেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত