Beta
রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতালটির সব রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট

hospital
[publishpress_authors_box]

দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল ঢাকার মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল। এখানে রোগীদের চিকিৎসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে ছয়টি। যদিও এ মুহূর্তে সবগুলোই বিকল।

কেবল রেডিওথেরাপি মেশিনই নয়, এই হাসপাতালে গত তিন বছর ধরে কোনও এক্সরে করা যায় না। ২০১০ সালের পর থেকে হয়নি এমআরআই।

ফলে দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল দাবি করা হলেও আদতে এটি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ফলে বাড়ছে রোগীদের ভোগান্তি। বিশেষ করে যারা সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল, যাদের বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয়বহুল চিকিৎসা করানোর সুযোগ নেই তারা পড়েছেন বিপাকে।

দেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশই হয় ক্যান্সারে। প্রতি লাখ মানুষে ১০৬ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত, যাদের ৯৩ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৭৫ বছর।

এই গবেষণার প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, দুই লাখ মানুষের ওপর চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৩৮ ধরনের ক্যান্সার রয়েছে। ক্যান্সার রোগীর মধ্যে ২ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু। ৫ দশমিক ১ শতাংশ রোগীর বয়স ৭৫ বছরের বেশি।

দেশের মানুষ যে পাঁচটি ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন সেগুলো হলো স্তন ক্যান্সার, ঠোঁট ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার, পাকস্থলি এবং স্বরযন্ত্রের ক্যান্সার এবং জরায়ুমুখ ক্যান্সার।

আবার কেবল পুরুষরা আক্রান্ত হচ্ছেন শ্বাসনালী, পাকস্থলী, ফুসফুস, মুখ ও খাদ্যনালীর ক্যান্সারে। নারীরা স্তন, জরায়ুমুখ, মুখ, থাইরয়েড এবং ওভারি ক্যান্সারে।

হাসপাতালে দূর্ভোগ

দেশে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সেই অনুপাতে সহজলভ্য হয়নি চিকিৎসা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যত রোগী রয়েছে, সে অনুপাতে চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং চিকিৎসক অপ্রতুল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোগী সংখ্যার অনুপাতে দেশে প্রায় ৩০০টি রেডিওথেরাপি মেশিনের প্রয়োজন হলেও সরকারি ও বেসরকারি মিলেয়ে রয়েছে মাত্র ৩৭টি। আবার এর বেশিরভাগই নষ্ট।

সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন বেশ কয়েকজন চিকিৎসক। তবে তারা কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি।

তারা বলছেন, বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতালে দেশের নানা প্রান্ত থেকে রোগীরা আসেন রেডিওথেরাপির জন্য। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই হাসপাতালে স্থাপিত চারটি মেশিন নষ্ট রয়েছে। বাকি দুই মেশিন দিয়ে এর আগে অপ্রতুল হলেও প্রতিদিন প্রায় ২০০ এর কিছু বেশি রোগীকে থেরাপি দেওয়া হচ্ছিল।

কিন্তু গত বছরের শেষ সপ্তাহে একজন রোগীকে থেরাপি দেওয়ার সময় একটি মেশিন নষ্ট হয়ে যায়, ঠিক পরের দিনই নষ্ট হয় অন্যটিও। ফলে এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওথেরাপি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সরকারি এই হাসপাতালে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায় রেডিওথেরাপির সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করা যায়। বেসরকারি হাসপাতালে যার খরচ এর কয়েকগুণ। দেশের বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদি এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে তাদের জন্য সরকারি হাসপাতালটিই শেষ ভরসা।

জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালে গিয়ে চোখে পড়ল রোগীদের অবর্নণীয় দুর্ভোগ। বিশেষ করে যাদের রেডিওথেরাপি দিতে হবে, তারা জানেন না কীভাবে বা কবে আদৌ এই চিকিৎসা নিতে পারবেন।

হাসপাতালে কথা হয় কুড়িগ্রাম থেকে আসা রহিমা বেওয়ার সঙ্গে। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রহিমা কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর ঘুরে এসেছেন এই হাসপাতালে। চিকিৎসকরা তাকে রেডিওথেরাপির জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সেটাই এখন অনিশ্চিত।

রহিমার ছেলে কাইয়ুম মুন্সী সকাল সন্ধ্যাকে বললেন, “বেইচে দেওয়ার মতো কিছু নাই, ছিল দুইটা গাভী। গাভীর দুধ বিক্রি করে যা পেইতাম তাই দিয়ে সেদিনকার বাজার হইতো। কিন্তু সেইটা বিক্রির পর এখন আর কিছু নাই। ভাইবেছিলাম মায়ের চিকিৎসা করায়ে বাড়িত ফিরমু। কিন্তু এইখানকার যা অবস্থা, বাড়িতেই ফিইরে যাইতে হইবে।”

পাশেই ছিলেন রোজিনা আক্তার। এর আগে এই হাসপাতাল থেকে পাঁচটি থেরাপি নিয়েছিলেন। এবার এসে শুনলেন মেশিন নষ্ট। কবে ঠিক হবে তাও কেউ বলতে পারছে না।

তিনি বললেন, “আমার আরও ১০টা থেরাপি বাকি। বেসরকারিতে তো যাইতে পারবো না। জানি না কবে আবার থেরাপি নিতে পারবো।”

রোজিনা বললেন, আগের পাঁচটি রেডিওথেরাপি ধারদেনা করে দিয়েছিলেন, কিন্তু এবার ধার দেওয়ার মতোও আর কেউ নেই। তাই ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন চিকিৎসার বিষয়।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

স্তন ক্যন্সার নিয়ে বহুবছর ধরে কাজ করছেন হাসপাতালটির সাবেক অধ্যাপক ও বর্তমানে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যান্সার হাসপাতালের প্রকল্প সমন্বয়ক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।

ক্যান্সারাক্রান্ত রোগীদের কোনও পর্যায়ে বা সব রোগীদেরই রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগীর কখনও না কখনও রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়। তবে বেশি প্রয়োজন হয় স্তন ক্যান্সার, জরায়ুমুখ ক্যান্সার আর মস্তিস্কের ক্যান্সারে। এ থেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সারের কোষগুলোকে মেরে ফেলা হয়।”

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি জানান, সাধারণত ব্রেস্ট ক্যান্সারে ১৫টি, সার্ভিক্যাল ক্যান্সারে ২৫টির মতো রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়।

ক্যান্সারের চিকিৎসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট হওয়ায় বিপাকে রোগীরা।

যদিও নষ্ট হয়ে যাওয়া এসব মেশিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানান জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবির।

তিনি বলেন, “মেশিনগুলো ঠিক করার জন্য যোগাযোগ হয়েছে তাদের সঙ্গে (উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান)। তারা দ্রুতই এগুলো মেরামত করে দেবে বলে জানিয়েছে আমাদের।”

আগামী মাসের শুরু অথবা চলতি মাসের শেষের দিকেই মেশিন ঠিক করা হতে পারে বলে জানালেন তিনি।

অবশ্য মেশিন নষ্ট থাকার কারণে রোগীদের দুর্ভোগের কথা স্বীকারও করলেন এই চিকিৎসক।

“সেবা না পেয়ে চলে যাচ্ছে মানুষ। এটা আমাদের সবার জন্য দুর্ভাগ্যজনক।”

একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতালটির রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানান, আগামী মাসে অর্থাৎ মার্চ নাগাদ নতুন দুটি রেডিওথেরাপি মেশিন চালু হবে। বিষয়টি নিয়ে তারা কাজ করছেন।

এ সময় তিনি বলেন, “যে চারটি রোগের চিকিৎসার জন্য রোগীরা বিদেশে যায় তার মধ্যে ক্যান্সারকে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে ক্যান্সারের ওষুধে করের ক্ষেত্রে রেয়াতও করা হয়েছে। এতে ওষুধের দাম অন্তত ১০ শতাংশেরও বেশি কমে আসবে।”

অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদারের পরামর্শ হলো, সরকারি মেশিন কেনার সময় চুক্তিতে ‘আর্জেন্ট সার্ভিস’ যোগ করতে হবে। এতে দ্রুত মেশিন ঠিক করা যাবে।

তিনি বলেন, “আমরা দেখি যে বেসরকারি হাসপাতালের কোনও মেশিন নষ্ট হলে সেটা খুব দ্রুত, কোথাও কোথাও এক সপ্তাহের ভেতরেরও সেগুলো ঠিক করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর লেগে যাচ্ছে।

“এই অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। মেশিন নষ্ট হবেই, কিন্তু নষ্ট হবার পর যেন দিনের পর দিন না লেগে যায়, সেজন্য ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির সময়েই এখানে ‘আর্জেন্ট সার্ভিস’ যুক্ত করতে হবে। তাহলে দেশের মানুষের সরকারি হাসপাতালে ভোগান্তি কমবে, মানুষ চিকিৎসা নিতে পারবে।”

ক্যান্সারের চিকিৎসায় সময়ক্ষেপন করা চলবে না জানিয়ে তিনি বলেন, “যত দ্রুত চিকিৎসা সঠিক সময়ে হবে, ততই আরোগ্যের পথে তার এগিয়ে থাকা হবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত