Beta
শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪

নিবন্ধ

অমর্ত্য সেনের দেখায় লেখায় বাংলার নদী

অমর্ত্য সেনের আত্মজীবনী ‘হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: আ মেমোয়ার’

অমর্ত্য সেনের শৈশবের বেশিরভাগটাই কেটেছে ঢাকায়। পুরান ঢাকার ওয়ারিতে দাদার বাড়ি ‘জগৎ কুটির’ কেবল তার দাদাবাড়ি হয়েই থাকেনি, হয়ে উঠেছে তার সুবিখ্যাত আত্মজীবনীর নাম। নিজেকে যেমন ‘ঢাকার ছেলে’ বলে পরিচয় দিতেন তেমনি আত্মজীবনীতেও লিখেছেন ‘আমি জানতাম আমি ঢাকারই ছেলে’। এই ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা যাতায়াতের সুবাদে প্রমত্তা পদ্মা-গঙ্গার সঙ্গে চেনা-জানা হয়ে গিয়েছিল শৈশবেই। নদীময় সেসব দিন গভীর ছাপ ফেলেছিল তার জীবনে। নোবেলজয়ী এই বাঙালি অর্থনীতিবিদের আত্মজীবনী থেকে ছেলেবেলার নদীস্মৃতি তুলে এনে অমর্ত্যর দেখায় লেখায় বাংলার নদী আর তার মনোনদীর তালাশ করেছেন আহমেদ জাভেদ।       

অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তাঁর আত্মজীবনী ‘হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: আ মেমোয়ার’ [জগৎ কুটির: এক স্মৃতিগাথা] বইয়ে অবিভক্ত বাংলার নদ-নদীর এক ব্যতিক্রমী বিশ্লেষণ করেছেন। ছেলেবেলায় ঢাকা, কলকাতা এবং বার্মার মান্দালয়ে পরিবারের সঙ্গে যাতায়াতের মধ্য দিয়ে বাংলার নদ-নদী-সমুদ্রের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে। তাঁর কোমল হৃদয়ে বাংলাঞ্চলের নদীর রূপ-বৈচিত্র গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে। এই অভিজ্ঞতা প্রাথমিকভাবে এ অঞ্চলের নদ-নদী নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করলেও ধীরে ধীরে তিঁনি পঠন-পাঠনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে নিজের উপলব্ধির সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে মিলিয়ে নেন। নদীকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের সাহিত্য ও পুরাণের আলোচনা তিঁনি এনেছেন, এমনকি সাহিত্য সমালোচক, দেশি-বিদেশি কবির কবিতায় নদীর বিষয়টি যেভাবে এসেছে তারও পর্যালোচনা তিঁনি করেছেন। অবধারিতভাবে এসেছে রবীন্দ্রনাথের নদীকেন্দ্রিক লেখার কথা, কবি ও কথাসাহিত্যিক রুডিয়ার্ড কিপলিঙ, ধ্রুপদী বাংলা সাহিত্যের মনসামঙ্গল কাব্যের গল্প, সাহিত্যিক হুমায়ুন কবীরের উপন্যাস ‘নদী ও নারীর’ আলোচনা এবং সাহিত্য-সমালোচক জাফর আহমদ রাশেদের আলোচনার কথাও উল্লেখ করেছেন অমর্ত্য সেন।

প্রথমেই বলতে হয় অমর্ত্য সেনের আত্মজীবনীর ভাষার কথা। এ বইয়ে তাঁর ইংরেজি ভাষার আবহটি বেশ সহজ সরল। কথপোকথনের ঢঙে লেখা। তাঁর ভাষার ভেতর ঢুকলেই এক সুমধুর কাব্যিক আবেশ পাঠকের মনকে মোহিত করে ফেলে।

আত্মজীবনীর প্রথম ভাগে, দ্বিতীয় অধ্যায়টি তিনি শুরু করেছেন পদ্মা নদীর কথা দিয়ে:

‘‘প্রমত্ত পদ্মা নদী থেকে ঢাকা খুব বেশি দূরে নয়। সুপ্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত গঙ্গা নদীর যে দুটি বড় শাখা নদী রয়েছে পদ্মা হলো তার একটি। ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষজন গঙ্গা নদীকে ‘দ্য গেঞ্জেস’ বলেন। গঙ্গা নদীটি বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। অতীতে উত্তর ভারতের প্রাচীন শহরগুলো—যার মধ্যে বেনারস ও পাটনার মতো ঐতিহ্যবাহী পুরনো শহর ছিল— সেসব সবই বৃহত্তর বাংলাঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত ছিল। পদ্মা নামটি সংস্কৃত ভাষার শব্দ। সংস্কৃত এই শব্দটিই পরে বাংলা ভাষায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। পদ্মা শব্দটির অর্থ একটি ফুলের নামে— পদ্ম ফুল। পদ্মা নদী বঙ্গোপসাগরে শেষ হবার আগে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আরামে অলসভাবে নিজেকে প্রসারিত করতে পেরেছে। গঙ্গার অন্য শাখাটির নাম হলো ভাগিরথী। ভাগিরথী নদী অবশ্য পদ্মার মতো অতোটা আরাম পায়নি। সে সোজাসুজি দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। তার চলার পথ এতই সোজা যে, সে সরাসরি কলকাতা শহরের উপর দিয়েই চলে গেছে। বঙ্গোপসাগরে গিয়ে নিজের সমাপ্তি ঘোষণা করলেও তাকে ঘুরতে হয়েছে কম। অল্প পথ অতিক্রম করেই সে বঙ্গোপসাগরের দেখা পেয়েছে।’’

তাঁর নদীকথা কেবল সুন্দর বর্ণনাতে আবদ্ধ থাকেনি, শৈশবের অভিজ্ঞতার সঙ্গে উঠে এসেছে সমাজে ও সাহিত্যে নদী নিয়ে পূর্ববাংলা আর পশ্চিমবাংলার জনমনস্তত্ত্বের কথাও:

‘‘বাংলা সাহিত্যে ভাগিরথী ও পদ্মা নদী বেশ বড় পরিসর নিয়ে আছে। ভাগিরথী ও পদ্মা কোনটির মহত্ত্ব বেশি তা নিয়ে রেশারেশি রয়েছে। আমার মনে পড়ে, আমরা তখন ঢাকায় থাকি, ঢাকার বালক হিসেবে পদ্মা নদীকে আমার পদ্ম ফুলের মতো সুন্দর লাগে, একথা বলায়, আমার কলকাতার বন্ধুটি গাল ফুলিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়।’’

কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে তরুণ অমর্ত্য সেন, ১৯৫৮।

অমর্ত্য সেনের নদীকথাই নয় কেবল তাঁর আত্মজীবনী বুঝতে হলে আমাদের তাঁর মনোদেশে বহতা গভীর নদীটির সন্ধান করা দরকার। আত্মজীবনীর নামের মাঝেই সে নিশানা আছে। অমর্ত্য সেন কেন বইটির নাম ‘হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: আ মেমোয়ার’ বা ‘জগৎ কুটির: এক স্মৃতিগাথা’ রাখলেন? অমর্ত্যের দর্শনের দিকটি বোঝা না গেলে এর জবাব পাওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সেনের দৃষ্টিভঙ্গিটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছাড়া আমরা সে সন্ধান পাব না। জগৎ কুটিরের মুখবন্ধে বিষয়টি তিঁনি পরিষ্কার করেছেন:

‘‘দিল্লিতে থিতু হবার পর, আমি আমার জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকানোর সময় পাই। আমার নিজের জীবনকে তখন নানা ধরনের অভিজ্ঞতায় ভরপুর মনে হয়। আমি তখন বুঝতে পারি যে, পৃথিবীর সভ্যতা ব্যাখ্যায় দুটি ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। একটি ধারার দৃষ্টিভঙ্গি ‘খণ্ডিত’। এই দৃষ্টিকোণের আওতায় বিভিন্ন সময়ের সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও তার প্রকাশভঙ্গিগুলোকে আলাদা আলাদা সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ধারার ব্যাখ্যায় বিভিন্ন সময়ের সভ্যতার অংশগুলোর মধ্যে প্রতিকূল সম্পর্ক দেখানো হয়। বর্তমান সময়ে এই দৃষ্টিভঙ্গিটি বেশ প্রচলিত— যেটি ‘সভ্যতার সংঘাত’ নামে আমাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করেছে।’’

বলা বাহুল্য, এই খণ্ডিত চিন্তাধারার প্রতি অমর্ত্যের নিজের আগ্রহ নেই। তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে তিঁনি তুলে ধরেছেন এভাবে:

‘‘[অপরপক্ষে] অন্যধারাটি হলো ‘অন্তর্ভূক্তিমূলক’ দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিকোণের আগ্রহ হলো বিভিন্ন সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশভঙ্গিগুলোকে চূড়ান্তভাবে একটি সভ্যতার অঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করা। এটিকে বিশ্বসভ্যতা নাম দেয়া যায়। এই বিশ্বসভ্যতার গাছটি সৃষ্টি হয়েছে সমগ্র মানবজাতির পরস্পর সম্পর্কিত আন্তজীবন-যাপনের মাধ্যমে— বিভিন্ন জায়গায় শেকড় ও শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দিয়ে যা নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় ফুল ফুটিয়েছে। নিশ্চিতভাবেই, আমার এ গ্রন্থটি যদিও সভ্যতার প্রকৃতির যুক্তিসিদ্ধ অনুসন্ধানে নিবেদিত নয়, কিন্তু, পাঠক হিসেবে আপনি দেখবেন যে, পৃথিবীর যা কিছু অবদান তার ব্যাখ্যায় খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে বরং সভ্যতার অন্তর্ভূক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আমার সহমর্মিতা রয়েছে।’’

আমার মনে হয়, অমর্ত্য সেনের এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রভাব এবং সর্বোপরি নিজের পঠন-পাঠন। যেসব ব্যক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁর মানস গঠনে সাহায্য করেছে তাঁর মধ্যে রয়েছেন তাঁর পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক আশুতোষ সেন ও মা নৃত্যশিল্পী অমিতা সেন, সংস্কৃত ভাষা ও ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রে নামকরা পণ্ডিত নানা ক্ষিতিমোহন সেন এবং মেধাবী মৃৎশিল্পী ও দক্ষ ধাত্রী নানী কীরণবালা। তবে দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বলতে হবে সর্বাগ্রে। আত্মজীবনীতে তিনি জানাচ্ছেন, জন্মের পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর মা অমিতা সেনকে বলেন:

‘‘ ‘শিশুর নামের ক্ষেত্রে অতি-ব্যবহারে জীর্ণ নামগুলোর পুনরাবৃত্তি বেশ একঘেয়ে বিষয়।’ এই বলে রবীন্দ্রনাথ নিজেই আমার জন্য একটি সুন্দর নতুন নাম প্রস্তাব করেন। আমাকে দেওয়া সেই নাম হলো অমর্ত্য। সংস্কৃত ভাষায় অমর্ত্য অর্থ হলো অমর। সংস্কৃত ভাষায় এর বিপরীতার্থক শব্দ হলো মর্ত্য। মর্ত্য শব্দের অনেক অর্থের মধ্যে একটি অর্থ হলো মৃত্যু। অর্থাৎ মর্ত্য মানে, আমাদের এই পৃথিবী— যেখানে মানুষ মরে যায়। কিন্তু অমর্ত্য হলো এমন মানুষ যে মরবে না—যে স্বর্গ থেকে আগত।’’

অমর্ত্য সেন। আলোকচিত্র: দ্য হার্ভার্ড গেজেট।

রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববীক্ষা ছাড়াও অমর্ত্যের জীবনে প্রভাব রয়েছে তাঁর দাদা-দাদীর—

দাদা, আদালতের বিচারক সারদা প্রসাদ সেনের এবং দাদী বিদুষী জগৎলক্ষ্মীর। এছাড়া চাচাতো ভাই বসু প্রসাদ সেন, চাচাতো বোন তাঁর মীরাদিদি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন পরীক্ষাগারের কর্মী করিম চাচা, সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েল (এরিক আর্থার ব্লেয়ার), মাহাত্মা গান্ধী, জওহারলাল নেহরু, আল বিরুনী ও মান্দালয়ের প্রিয় আয়াদি’র কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠান ও শহরের মধ্যে কলকাতা শহর, কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকান ও কফি হাউসের আড্ডা, তাঁর সহপাঠী-বন্ধুদের কথা বলেছেন তিনি। বিশেষভাবে বলতে হবে ১৯০১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী, বোলপুরের ব্যতিক্রমধর্মী বিদ্যাপীঠ শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত গ্রন্থাগারের গ্রন্থগুলোর মতো সমৃদ্ধ এক জগৎ, অর্থনীতির শিক্ষক ভবতোষ দত্তসহ অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন রমনার কথা, পুরান ঢাকার ওয়ারি, সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, বার্মার মান্দালয় শহর ও মান্দালয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইরাবতী নদী, গঙ্গা ও পদ্মা নদী আর সেখানে পরিবারের সঙ্গে নৌভ্রমণ ও বার্মায় যাতায়াতের কথা, বঙ্গোপসাগর ও হিমালয়ের স্মৃতির কথা।

অমর্ত্যের দাদা আদালতের বিচারক সারদা প্রসাদ সেন পুরান ঢাকায় একটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। সারদা প্রসাদ এ বাড়িটির নামকরণ করেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী জগৎলক্ষ্মীর নামে। অধ্যাপক সেনের ভাষায়: ‘‘আমাদের পুরান ঢাকার বাড়িটির নাম ছিল ‘জগৎ কুটির’।… সুতরাং জগৎ কুটিরের অর্থ দাঁড়ায় আমার দাদীর ঘর বা জগৎ-এর কুটির।

কিছু বড় ঘটনার কথাও এখানে বলতে হবে। এরমধ্যে দশ বছর বয়সে বালক অমর্ত্যের চোখে দেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪২-৪৩-এর বাংলার দুর্ভিক্ষ বা ‘তেতাল্লিশের মন্বন্তর’, ছেচল্লিশের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও সাতচল্লিশের দেশভাগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীকালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও সেখানকার মার্কসবাদী শিক্ষক অধ্যাপক মরিস ডাব, গ্রামসিয়ান তাত্ত্বিক ও কেমব্রিজ গ্র্যাজুয়েট স্কুলের পরিচালক অধ্যাপক পিয়েরে স্রাফা এবং অধ্যাপক রবার্টসন।

মা-বাবার বড় সন্তান অমর্ত্য সেন। তাঁর ছোট বোন মঞ্জু। পরিবার তাদের ভাই-বোনকে অনুশাসনের বদলে স্বাধীনতা দিয়েছিল। ফলে, নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমের বাইরে মুক্তভাবে পারিপার্শ্বিক ছোট-বড় বিষয়গুলোর প্রতি মনোনিবেশ করতে তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন। এই স্বাধীনতা চর্চার ফলে অমর্ত্য তার সুপ্ত সম্ভাবনা ও ক্ষমতাগুলোকে বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিঁনি চলতেন তার ভালো লাগা ও পছন্দকে কেন্দ্র করে ও দ্বায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কৌতুহল মেটাবার জন্য তিনি স্বাধীনতার সদ্বব্যবহার করেছেন। ফলে তিঁনি নিজের সক্ষমতাকে বিকশিত করতে পেরেছেন।

অমর্ত্যের দাদা আদালতের বিচারক সারদা প্রসাদ সেন পুরান ঢাকায় একটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। সারদা প্রসাদ এ বাড়িটির নামকরণ করেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী জগৎলক্ষ্মীর নামে। অধ্যাপক সেনের ভাষায়: ‘‘আমাদের পুরান ঢাকার বাড়িটির নাম ছিল ‘জগৎ কুটির’।… সুতরাং জগৎ কুটিরের অর্থ দাঁড়ায় আমার দাদীর ঘর বা জগৎ-এর কুটির।’’

অমর্ত্য সেন। আলোকচিত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স।

কিন্তু আমরা জানি, ভাষা সরাসরি ব্যক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করলেও একইসঙ্গে এটি রূপক অর্থেও ব্যবহৃত হয়। অমর্ত্য এই বাড়ির নামের রূপক অর্থটিই নিয়েছেন। তাঁর মতে দাদা সারদা প্রসাদ জাতীয়তাবাদের প্রতি আবেগে অতোটা গা-ভাসিয়ে দেননি। এমনও হতে পারে বিচারকার্য পরিচালনায় ও রায় প্রদানে সারদা প্রসাদ পেশাগতভাবেই যেরকম নিরাবেগ থাকতেন, সেরকম আশপাশের জীবন জগৎ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও তখনকার চলমান প্রবল স্বদেশীধারার বাইরেও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশ পেয়েছে এই নামকরণের মধ্যে দিয়ে। হয়ত তিঁনি চলমান হানাহানি, সংঘাত ও হিংসার বিপরীতে এক শান্তিময় পৃথিবীর কথা ভাবতেন যেখানে প্রত্যেকে এই পৃথিবীকে নিজের আপন ঘর মনে করবেন— সেই আদর্শ ভবিষ্য পৃথিবীর সূচনা তিঁনি নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে চেয়েছিলেন যার কারণেই ঢাকার ওয়ারির বাড়িটির নামকরণ করেছিলেন ‘জগৎ কুটির।’

অমর্ত্য সেনও যে তাঁর দাদা সারদা প্রসাদ সেন, নানা ক্ষিতিমোহন সেন ও রবীন্দ্রনাথের ভাবধারার উত্তরাধিকার বহন করছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৯ সালে প্রকাশিত তাঁর সাড়াজাগানো সুলিখিত নীতি ও ন্যায্যতা গ্রন্থের ‘ন্যায্যতার দাবি’ অধ্যায়ের ‘কন্ঠস্বর ও সামাজিক চয়ন’ উপ-অধ্যায়ে উল্লিখিত এই উক্তির মাধ্যমে:

“মানবাধিকারের ধারণাটি দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সহভাগী মানবতার উপর। কোনও দেশের নাগরিকত্ব বা কোনও জাতিরাষ্ট্রের সদস্যতার ভিত্তিতে এগুলো গড়ে ওঠেনি; বরং এগুলোর ভিত্তি হচ্ছে প্রতিটি মানুষের দাবি বা স্বত্বাধিকারের ধারণা।’ [পৃ. ১৭৩ (বাং) ১০০ (ইং)]।

‘জগৎ কুটির’ থেকে আবারও দেখে নিই অমর্ত্যর নদীময় ছেলেবেলার কথা। মাত্র তিন বছর বয়সে অমর্ত্য সেনের প্রথম ভ্রমণ অভিজ্ঞতা হয় এবং সেসময়ে অবধারিতভাবে তা ছিল জলপথে। সময়টি সম্ভবত ১৯৩৬ সাল। কলকাতা থেকে বার্মার তৎকালীন রাজধানী রেঙ্গুন যাত্রা। তিঁনি বাবা-মার সঙ্গে জাহাজে চেপে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিচ্ছিলেন:

‘‘জাহাজের হুইশেলের শব্দে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি। শব্দটি ক্রমে ক্ষীণ থেকে চড়া হতে শুরু করে ধীরে ধীরে বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। হুইশেলের বিকট চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।’’

তাঁর একথাটিকেও আমরা রূপক হিসেবে নিতে পারি। রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত যে শিশুটির নাম অমর্ত্য— যা মর্ত্য নয়, অর্থাৎ মর্ত্যের মানুষের অমর্ত্য যাত্রায় প্রধান বিষয় হলো চেতনা— সেটির শুরু হলো ভ্রমণ দিয়ে তাও আবার জলপথ দিয়ে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দেয় যেখানে প্রধান চরিত্রের চিন্তার ভ্রমণ দেখানো হয়েছে, অনুন্নত চিন্তা-চেতনা থেকে উচ্চতর চিন্তাভাবনায় উপনীত হওয়াই মর্ত্যকে অমর্ত্যে নিয়ে যায়।

শান্তিনিকেতনে অমর্ত্য সেনের নিজের বাড়ির নাম ‘প্রতীচী’।

অমর্ত্যের ভাষায়:

‘‘আমার শৈশবের স্মৃতিগুলোর মধ্যে একটি দৃশ্যের কথা খুব মনে পড়ে।… হুইশেলের শব্দে যখন আমি জেগে উঠি ততক্ষণে আমাদের জাহাজটি কলকাতা থেকে গঙ্গা নদীর মধ্যে দিয়ে একশ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। সেসময়ে কলকাতা বন্দরেই বড় বড় সব জাহাজ নোঙর করত ও ছেড়ে যেত। বাবা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, আমাদের জাহাজটি এইমাত্র উন্মুক্ত সমুদ্রে [বঙ্গোপসাগরে] প্রবেশ করেছে এবং এভাবে কয়েকদিন চলার পর আমরা বার্মায় রেঙ্গুন বন্দরে পৌঁছে যাব। সমুদ্রযাত্রা কেমন হতে পারে তা নিয়ে এর আগে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে কীভাবে যাতায়াত করে সেসম্পর্কেও আমার আগাম কোনও ধারণা ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি একটি রোমাঞ্চকর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম— যখন মনে হচ্ছিল যে, আমার জীবনে এমন সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে যা আগে ঘটেনি। বঙ্গোপসাগরের স্থির গাঢ় নীল জলরাশিকে মনে হচ্ছিল আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ থেকে এইমাত্র বেরিয়ে নীল আভা সৃষ্টি করেছে।’’

তিন বছর বয়সে তাঁর এই বার্মাযাত্রা মান্দালয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবার চাকরি সূত্রে। অধ্যাপক আশুতোষ সেন তিন বছরের অতিথি অধ্যাপনার কাজ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং ওয়ারির বাসায় থাকতে শুরু করেন। তখন ছয় বছর বয়সে অমর্ত্যর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। সেখানকার কঠিন নিয়মানুবর্তিতা ও প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার পরিবেশে অমর্ত্য হাঁপিয়ে ওঠেন। তখন স্কুলের গ্রীষ্মকালীন ছুটি অথবা বার্ষিক পরীক্ষার ছুটির সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে বেড়াতে যেতেন শিশু অমর্ত্য। আরও পরে শান্তিনিকেতনে তার পাঠ শুরু হয়।  

অমর্ত্যের বর্ণনায়:

‘‘পূর্ববাংলায় বসবাসের সময় আমাদের জীবনকে নদী আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। আমার ছোটবেলার সেই পূর্ববাংলা হলো বর্তমান বাংলাদেশ। যখন আমরা ঢাকা থেকে কলকাতায় যেতাম— সেটি কলকাতার বড় শহর হোক কিংবা বা শান্তিনিকেতন হোক— গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে রেলগাড়িতে আমাদের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ করতেই হতো। সরাসরি সর্বশেষ গন্তব্যে পৌঁছবার কোনও ব্যবস্থা তখন ছিল না। প্রথমে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে যেতে হতো। নারায়ণগঞ্জ পৌঁছবার পর সেখান থেকে পদ্মা নদী দিয়ে স্টিমারে করে দীর্ঘ নৌপথের ভ্রমণ করতেই হতো। পদ্মার দুই ধারের অপরূপ বৈচিত্রময় দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে আমরা গোয়ালন্দ রেলস্টেশনে পৌঁছে গেছি তা খেয়ালই করতে পারতাম না। এই গোয়ালন্দ রেলস্টেশন থেকে রেলগাড়িতে উঠলে সোজা কলকাতায় পৌঁছে যেতাম।’

বাংলার নদ-নদীর সঙ্গে অমর্ত্য সেনের এই সংলগ্নতা ও হৃদয়বৃত্তির যোগকে ব্যাখ্যা করতে আমি বিংশ শতকের গোড়ার দিককার জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগারের (১৮৮৯-১৯৭৬) ইহজাগতিক-সত্তা বা জগৎ-মধ্যে-সত্তা (বিয়িং-ইন-দ্য-ওয়ার্ল্ড) ধারণাটির আশ্রয় নেব। হাইডেগারের এই ধারণাটি পাওয়া যায় ১৯২৭ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত বিয়িং এন্ড টাইম (সত্তা ও কাল) গ্রন্থে। হাইডেগার মানবঅস্তিত্বকে বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বশীল কোনও পদার্থ হিসেবে বোঝেননি। তিঁনি ব্যাক্তিকে বুঝেছেন তার নিজের সঙ্গে, পরিবেশের ও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্কসূত্রে। মানুষের অস্তিত্বের দুটি মৌলিক দিকের একদিকে রয়েছে তার সসীম চেতনা, কারণ, মানুষ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই সসীমত্ব প্রকাশ করে থাকে, এবং অন্যদিকে, তার চেতনায় দেশ ও কালের ক্ষণস্থায়িত্ব তার অস্তিত্বের মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রকাশ পায়। এখান থেকেই হাইডেগার ইহজাগতিক-সত্তা বা জগৎ-মধ্যে-সত্তা (বিয়িং-ইন-দ্য-ওয়ার্ল্ড) এর ধারণা নির্মাণ করেন। অর্থাৎ এটি যেন স্বকীয় সত্তারই বর্ধিত ও বিস্তৃত রূপ যেখানে নিজের সত্তার সঙ্গে অন্যান্য সত্তার, জগতের অন্যান্য প্রাণ-প্রকৃতি ও বস্তুজগতের সম্বন্ধ রয়েছে।

অমর্ত্য সেন তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে যেন এই কাজটিই করেছেন। দার্শনিক হাইডেগারের চিন্তায় মানুষের সত্তা কোনও বিশেষ কিছু থেকে উদ্ভূত নয়, বরং তার চেয়েও ব্যাপক ও মৌলিক প্রসঙ্গে প্রতিফলিত স্বকীয় সত্তা (বিয়িং-ইন-ইটসেল্ফ) হিসেবে। তাঁর অনুসন্ধানের অভিষ্ট ছিল সত্তা, অস্তিত্ব নয়। জগত ও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধই হলো মানুষের মূল বিষয়। এই সম্বন্ধ এড়িয়ে চললে মানুষ নিজেকে বস্তুতে পরিণত করে ফেলে। হাইডেগারের চিন্তায় বর্তমানই সবকিছু নয়, কারণ মানব সত্তা অতীত ও ভবিষ্যতের সঙ্গেও অঙ্গীভূত।

সম্ভবত একারণেই অধ্যাপক সেন বাংলার নদী নিয়ে লিখতে গিয়ে অ্যাডাম স্মিথের অর্থশাস্ত্রে বাংলাঞ্চলের আলোচনা, প্রচীন ধ্রুপদী মহাকাব্য, সমসাময়িক সাহিত্য ও এর সমালোচনা পর্যন্ত মানুষের পক্ষে সম্ভব কোনও কিছুই বাদ দেননি। আর এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একজন ছোট্ট বালকের চোখে দেখা নদী ও এর ভেতর বসবাস করা বিচিত্র সব প্রাণি ও নদীতীরবর্তী মানুষ ও প্রকৃতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।

সারা দুনিয়ায় বড় বড় সব ফোরামে বাংলাদেশ নিয়ে মর্যাদাপূর্ণ আলোচনা যাঁরা করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম অমর্ত্য সেন। আমি ইউটিউবে দেখেছি, বিশ্বের নামকরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অমর্ত্য সেন নিজেকে ঢাকার মানুষ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। তাঁর আত্মজীবনীতেও এটির প্রতিফলন দেখি:

‘‘আমি জানতাম আমি ঢাকারই ছেলে। কিন্তু অন্যসব শহুরে ছেলেমেয়েদের মতোই আমিও আসলে গ্রামের বাড়ি থেকেই ঢাকা শহরে এসে উঠেছি বলে অনেকে মনে করত— [তারা ভাবত] ‘মত্ত’ নামের ছোট্ট একটি গ্রাম থেকে এসেছি [‘মত্ত’ অমর্ত্যর দাদার পৈত্রিক বাড়ি হলেও তাঁর জন্ম শান্তিনিকেতনে]। এটি মানিকগঞ্জ জেলার একটি গ্রাম। ঢাকা শহর থেকে মানিকগঞ্জ কিন্তু খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু আমার ছেলেবেলায় সেখানে যেতে প্রায় আস্ত একটা দিন লেগে যেত। সেখানে যাবার বেশিরভাগ পথই পাড়ি দিতে হতো বিভিন্ন নদ-নদীর সর্পিল পথ ধরে, নৌকায় করে।’’

অমর্ত্যের ভাষায়:

‘‘পদ্মা নদীতে এই স্টিমার ভ্রমণ আমার কাছে সবসময়ই ছিল অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। প্রতি মুহূর্তে রূপ বদলানো বাংলার অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো উপভোগ না করে কোনও উপায় ছিল না। সেসব প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যেও ব্যস্ত গ্রামীণ জনপদের জীবনচিত্র চোখে পড়ে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যাদের স্কুলে যাওয়ার সময় হয়নি, তারা দৌড়ে নদীর ধারে এসে আমাদের নৌযাত্রার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে থাকত। এই তরতাজা আনন্দ খুঁজে পেয়ে তারা সুন্দর করে হাসত। বর্তমানে আমার মধ্যে উদ্বিগ্ন হওয়ার যে বাতিক আছে— সেটি তখন কাজ করত না। সেসব ছেলেমেয়েরা স্কুলে না গেলেও আমার তাদের নিয়ে কোনও চিন্তা হতো না। কিন্তু আমার আব্বা আমার মতো ছিলেন না। আব্বা আমাকে বলতেন যে, অধিকাংশ ভারতীয় শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, কারণ, যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক স্কুলই নেই। ভারতে স্কুল খুব অপ্রতুল।’’

পদ্মা নদীতে এই স্টিমার ভ্রমণ আমার কাছে সবসময়ই ছিল অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। প্রতি মুহূর্তে রূপ বদলানো বাংলার অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো উপভোগ না করে কোনও উপায় ছিল না। সেসব প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যেও ব্যস্ত গ্রামীণ জনপদের জীবনচিত্র চোখে পড়ে।

বাংলাদেশে এখনও মধ্যবিত্ত স্কুলপড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলের ছুটিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে দাদাবাড়ি/নানাবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার রেওয়াজ আছে। আমার ছেলেবেলাতেও তাই হয়েছে। পিতার কর্মসূত্রে আমরা শহরাঞ্চলে থাকলেও গ্রামের বাড়ির শেকড় আমরা কেউ ভুলতে পারি না। অমর্ত্য সেনের শৈশবও এর ব্যতিক্রম কিছু ছিল না।

তাঁর ভাষায়:

‘‘নৌপথে গোয়ালন্দ ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে আবার ফেরার সময় গোয়ালন্দেই ফিরে আসা হলো আমার নদী-কেন্দ্রিক শৈশবের বাস্তব অভিজ্ঞতার একমাত্র ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। পূর্ববাংলায় বর্ষা ঋতুতে বিভিন্ন ছুটির দিনগুলোর বেশিরভাগই ছিল ভেজা ভেজা। দিনগুলো ছিল জলময়। ঢাকা থেকে দাদাবাড়ি মানিকগঞ্জের মত্ত-তে বিভিন্ন নদ-নদীর সর্পিল পথ ধরে, নৌকায় করে ছোট বড় খাল-বিল পাড়ি দিয়ে যাত্রাপথের অভিজ্ঞতাটি কেমন ছিল সেটি আমি এই বইয়ের আগের অংশে বর্ণনা করেছি। ওইটুকু পথ পাড়ি দিতে কত লম্বা সময়ই না লাগত। আব্বা-আম্মা ও ছোটবোন মঞ্জুসহ আমরা যখন বিক্রমপুরের সোনারঙে নানাবাড়ি যেতাম তখনও দাদাবাড়ি যাওয়ার কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হতো। পূর্ববাংলায় ঢাকার বেশ কাছেই ছিল বিক্রমপুর। কিন্তু কাছে হলেও নদী পথের সেই যাত্রায় কত যে খাল-বিল নদী-নালা পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছতে হতো তার কোনও হিসাব নেই। আমার নানা-নানী পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতন থেকে সোনারঙে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সোনারঙ ছিল আমার নানার পূর্বপূরুষদের বাড়ি। অর্থাৎ আমার নানার ‘মূল গ্রামের বাড়ি’ ছিল এই সোনারঙ গ্রামে। আমার নানার কর্মস্থল ও বসবাসের জায়গা ছিল শান্তিনিকেতনে। নানার পৈত্রিক বাড়ি সোনারঙ হলেও বাস্তবে আমার নানা তাঁর পরিবার নিয়ে সোনারঙ গ্রামে বাস করতেন না। তিঁনি থাকতেন সেখান থেকে বহুদূরে, শান্তিনিকেতনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার নানা ‘বাড়ি’ বলতে সোনারঙই বুঝতেন।’’

অমর্ত্য ভাষার ক্ষেত্রেও শেকড় সন্ধানী। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হলেও তিঁনি সংস্কৃত ভাষা জানতেন। আত্মজীবনীতে বিনীতভাবে সেকথা উল্লেখও করেছেন তিঁনি:

‘‘বাংলা ভাষার আদি উৎস সংস্কৃত ভাষা রপ্ত করতে পারা আমার জন্য অত্যন্ত গৌরবের। যখন আমি প্রথমবারের মতো সংস্কৃত পড়তে শুরু করি তখন ভারতীয় বস্তুবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। ভারতে বস্তুবাদী ভাবনার ভিত্তি ছিল লোকায়ত দর্শন। আর এই লোকায়ত দর্শনের ভিত্তিতেই সংস্কৃত ভাষার প্রাণরসায়ন তত্ত্ব সৃষ্টি হয়। ভারতে লোকায়ত দর্শন গড়ে ওঠে খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। সেখানে বলা হয় যে, ‘দৃশ্যমান এসব পদার্থগুলো যখন নির্দিষ্ট অবয়বে রূপান্তরিত হবে— তখনই বুদ্ধিবৃত্তির জন্ম হবে। কারণ, বুদ্ধিসৃষ্টির উৎস হিসেবে বস্তুগুলোর মিশ্রণে এসবের ভেতরকার উপাদানগুলোর নতুন ক্ষমতা সৃষ্টির উদ্দীপনায় বের হয়ে আসে। আর যদি উপাদানগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, তবে সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতাও লোপ পেয়ে যাবে।’ এই উদ্ধৃতিটি পড়ে তখন আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল; কারণ, আমি আমার জীবনে রসায়নের চেয়েও বেশি কিছু আশা করেছিলাম। আরও অনেক পরে, আমার বেড়ে ওঠার পর, জীবন সম্পর্কিত নানা তত্ত্ব জানার পরে, আমার ছেলেবেলার সেই স্মৃতিময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন পরীক্ষাগার ও করিম চাচার সেই স্নেহময় প্রদর্শনী আমার জীবনে আবার ভুতুড়েভাবে ফিরে আসলেও সেটি ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত।’’

অমর্ত্য সেন একদিকে যেমন আপন ইতিহাস ও সংস্কৃতির শেকড়-সন্ধানী তেমনি বিশ্বসভ্যতার অগ্রবর্তী অন্যান্য অংশগুলোকেও নিজের সত্ত্বার ভেতর ধারণ করে হয়ে উঠেছেন একজন অনন্য উজ্জ্বল বিশ্বনাগরিক।

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। সভাপতি, বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশন।

ইমেইল: ronieleo@gmail.com

আহমেদ জাভেদ। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত