হতে পারতেন এই উপমহাদেশের সেরা নৃত্যশিল্পী, মনে মনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে পরিচয়টিই এগিয়ে রেখেছেন নিজে। কিন্তু মারা গেলেন কেবল ‘চিত্রনায়িকা’ পরিচয় সঙ্গী করে। বাংলা সিনেমার স্বর্ণসময়ে রুপালি জগতের সুপারস্টার নায়িকা অঞ্জনা রহমানের মৃত্যুতে নতুন বছরটি শোক দিয়ে শুরু হলো চলচ্চিত্র অঙ্গনে।
মাসখানেক রক্তের সংক্রমণজনিত রোগে ভুগে অবশেষে বিএসএমইউতে শুক্রবার গভীর রাতে মারা যান বাংলা সিনেমার ৫৯ বছর বয়সী এই নায়িকা।
গত শতকে ষাটের দশকে অঞ্জনার জন্ম ঢাকার ব্যাংক কলোনিতে, হিন্দু পরিবারে। বিয়ের সূত্র ধরে ধর্মান্তরিত হন। টাইটেল পাল্টে নামের শেষে ‘সাহা’র বদলে ‘রহমান’ ব্যবহার করা শুরু করেন । অঞ্জনার দুই সন্তান- কন্যা ফারজানা নিশি ও ছেলে মনি নিশাত। তারা মৃত্যুর সময় তার সঙ্গেই ছিলেন।
প্রয়াত এই চিত্রনায়িকার ক্যারিয়ারের কথা বাদ রেখে কেন আগে নাচের কথা এল সেটি তার বেড়ে ওঠা ও তারকা হয়ে ওঠার ইতিহাস বললেই পরিষ্কার হবে।
মাত্র ৫ বছর বয়সে মঞ্চে নাচতে উঠেছিলেন অঞ্জনা। নাচের প্রতি ঝোঁক থাকায় এবং সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্ম নেয়ায় এই নায়িকার বাবা-মা তাকে ভারতে নৃত্য শিখতে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ওস্তাদ বাবু লাল এর অধীনে নাচ শিখেন।
প্রয়াত অঞ্জনার নৃত্যে তিনটি জাতীয় পুরস্কার রয়েছে। ভরতনাট্যমে পারদর্শী এই অভিনেত্রীর ঝুলিতে ১০ বার আন্তর্জাতিক শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পীর পুরস্কার জেতার কৃতিত্বও রয়েছে। এর মধ্যে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের কৃতিত্বও রয়েছে। মহাদেশের ১০০ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ১৯৭৯ সালে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে সেরা নৃত্যশিল্পীর শিরোপা জয় করে নেন অঞ্জনা। তবে তার তিন বছর আগেই ১৯৭৬ সালে বাবুল চৌধুরী পরিচালিত সেতু চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করে ফেলেছেন তিনি।
যদিও মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমাটি ছিল শামসুদ্দীন টগর পরিচালিত দস্যু বনহুর। ওই একই বছর সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল। যা তাকে রাতারাতি সুপার স্টারে পরিণত করেছিল। তবে নাচের সূত্রেই নায়ক সোহেল রানার সঙ্গে অঞ্জনার দেখা হয়েছিল দুইবার এবং তার হাত ধরেই সিনেমায় আসা।
এখানে ঘটেছিল কাকতালীয় ব্যাপার। ৯ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলে নৃত্য পরিবেশন করতে গিয়ে প্রথম সোহেল রানার সঙ্গে পরিচিত হন। সেদিন ক্ষুদে অঞ্জনার প্রশংসা করেছিলেন এই নায়ক। ১৪ বছর বয়সে আবার ওই একই অনুষ্ঠানে দেখা হয় চলচ্চিত্র অঙ্গনের ড্যাশিং হিরো সোহেল রানার সঙ্গে। তিনি সরাসরি অঞ্জনাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন এবং সুযোগ করে দেন। শুরু হয় বড় পর্দায় অঞ্জনার পথ চলা। মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে ডিস্কো ড্যান্সারের বাংলা রিমেইকে অঞ্জনার অভিনয় ও নাচ প্রমাণ করে অঞ্জনার নৃত্যপ্রতিভা কতটা ছিল!
অভিনীত সিনেমার সংখ্যা ৩০০-এর বেশিই হবে। সবশেষ বড় পর্দায় অঞ্জনাকে দেখা গেছে ২০১৮ সালে ভুল নামের একটি সিনেমায়।
অভিনয়ে অনিয়মিত হলেও নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে সিনেমা বানিয়েছেন বেশ কয়েকটি।
অবশ্য ১৯৯২ সাল থেকেই অভিনয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলেন এই নায়িকা। তার কারণ হিসেবে গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলিউডের সঙ্গে তুলনা টেনে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এখানকার ফিল্মের চিত্রনাট্যতে সিনিয়র আর্টিস্ট-কেন্দ্রিক চরিত্রকে প্রাধান্য না দেওয়ার প্রবণতার কথা।
অঞ্জনার অভিনীত সিনেমার মধ্যে রয়েছে, চোখের মণি, মাটির মায়া, অশিক্ষিত, সুখের সংসার, জিঞ্জির, অংশীদার, অভিযান, মহান, আনারকলি, বিচারপতি, আলাদীন আলীবাবা সিন্দাবাদ, ও রাজার রাজা, বিস্ফোরণ, রাম রহিম জন, নাগিনা, পরীণিতা, ফুলেশ্বরী ইত্যাদি।
গত কয়েকদিন হলো সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমগুলো চিত্রনায়িকা অঞ্জনার গুরুতর অসুস্থতার খবর দিয়ে আসছিল।
অসংখ্যবার নাচের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন অঞ্জনা। ১৯৮৬ সালে পরিণীতা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। তবে একই বছর চিত্রনায়িকা আনোয়ারা রামের সুমতি -তে অভিনয়ের জন্য তার সঙ্গে যুগ্মভাবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেন। এছাড়া বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) এর বিবেচনায় সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন প্রয়াত অঞ্জনা। অভিনয় করেছেন ১৩টি ভাষার চলচ্চিত্রে।
আর এ জায়গাটিতেও প্রশ্নটি মনে আসা অবান্তর নয় যে, অঞ্জনা কি তবে নৃত্যশিল্পী হিসেবেই বড় ছিলেন? রুপালি পর্দার দারুণ শক্তির কারণে আমরা কি চিত্রনায়িকার পরিচয়ের আড়ালে কোনও ‘কিংবদন্তী’ নৃত্যশিল্পীকে হারালাম!